ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দোসররা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে একের পর এক নানা ইস্যু সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ধারাবাহিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অনেকগুলো এমন অপতৎপরতা ছাত্র-জনতা রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে উস্কানিমূলক ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির তৎপরতা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। স্বৈরাচারের দোসররা কি এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটো চালকদের আড়ালে নামিয়ে ঢাকা শহরকে অচল করে দিতে চাইছে?
উল্লেখ্য, ঢাকায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া অবৈধ রিকশা, বিশেষত ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটো রিকশার কারণে যানজট ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ঢাকার যানজট নিরসনকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার-এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলেও সড়ক-মহাসড়কের সংযোগস্থল, প্রবেশপথ ও আভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো থাকে এসব রিকশা-অটোর দখলে। লাখ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটো চলে ইলেক্ট্রিক চার্জিংয়ে। বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে লোড শেডিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে এসব অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার দায় রয়েছে। আনরেজিস্টার্ড গাড়ির লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক শহরের যানজট বৃদ্ধি, দুর্ঘটনা ও জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে চলেছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে জনস্বার্থে উচ্চ আদালত ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটো নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকদিন কিছুটা তোড়জোড় দেখালেও কিছুদিন পর অবস্থা আবার তথৈবচ হয়েছে। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে রাজনৈতিক চাঁদাবাজির কারণেই এসব অবৈধ যানবাহন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটো বন্ধে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনার আলোকে মঙ্গলবার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোর বিরুদ্ধে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারই জের ধরে মঙ্গলবার থেকে গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার প্রায় সব প্রান্তে রিকশা চালকরা রাস্তায় অবরোধ ও তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে ঢাকা অবৈধ রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা বন্ধে আদালতের নির্দেশনা ও সরকারের উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হয়েছে। সে সব ব্যর্থতার পেছনে সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্ত প্রভাবশালী চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কোনো সংশ্রব না থাকলেও রাজপথে অটোচালকদের সহিংস তাণ্ডব, রাস্তা অবরোধ এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টির পেছনে পরিবহন সেক্টরে ঘাপটি মেরে থাকা পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ইন্ধন ও নেপথ্য ভূমিকার অভিযোগ অগ্রাহ্য করা যায় না। শহরের বিভিন্ন স্থানে অটো চালকদের অবরোধের মুখে যানজটে লাখ লাখ মানুষকে যখন চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তখন একই সময়ে তিতুমীর কলেজ এবং সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে নেমে সংঘাতে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। একেকটি পক্ষ যখন তখন রাস্তায় নেমে সহিংসতা ও জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা নিষ্ক্রিয় বা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। দেশকে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে হলে জনজীবনে বিশৃঙ্খলা ও সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে নানামুখী ষড়যন্ত্র অবশ্যই রুখে দিতে হবে।
আদালতের নির্দেশ অনুসারে গত মে মাসেও সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হলে তাদের রাস্তা অবরোধসহ কঠোর আন্দোলনের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সব রাস্তায় ব্যাটারিচালিত-অটোরিকশা চলাচলের সুযোগ দেয়া হয়। এখন পতিত স্বৈরাচারের পরিবহন মাফিয়া সিন্ডিকেট প্রকাশ্যে না থাকলেও হাজার হাজার অটোরিকশা চালককে উস্কে দিয়ে ঢাকার জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টির কারসাজিতে লিপ্ত রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনে পরিবহন সেক্টরের বিপুল জনশক্তিকে বিরোধীদল দমন ও সরকারের দুঃশাসনের সহযোগী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করার কারণেই এই সেক্টরের সংস্কার ও উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, এ সপ্তাহে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একজন অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অটোরিকশার ধাক্কায় নিহত হয়েছে। সহপাঠী আফসানা করিমের মৃত্যুতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেছে এবং ৮ দফা দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শিক্ষার্থীদের ৮ দফার বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও চলমান বাস্তবতায় ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা, অটোরিকশার যথেচ্ছ চলাচল বন্ধ করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। একদিকে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, বিভিন্ন ইস্যুতে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের রাজপথ দখল ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টির অপতৎপরতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনের দুর্বল অবস্থান পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। তবে সবক্ষেত্রে ছাত্র-জনতা সক্রিয় সজাগ ও সচেতন রয়েছে। হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও পরিবর্তনের প্রত্যাশা পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ব্যর্থ করে দিতে পারবে না। হাজার হাজার অটো চালকের রুটি-রুজির অবলম্বন একটি স্পর্শকাতর বিষয় হলেও গাড়ি ভাংচুর, বাসাবাড়িতে হামলা, যানজট, জনদুর্ভোগ ইত্যাদি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অটোচালকদের রাজধানীর দুই কোটি মানুষকে জিম্মি করে রাখার বিষয়টি কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না।