ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনে সুফল পাবে জনগণ
অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আমরা জানি, জমি-জমা নিয়ে মূলত দেওয়ানী প্রকৃতির মামলা হলেও প্রকৃত অর্থে কোনো বিষয়ে অধিকারের দাবি বা ক্ষতিপূরণের দাবির জন্য যে মামলা করা হয়, তাকে দেওয়ানী মামলা বলে। দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮-এর ধারা ৯ অনুসারে, দেওয়ানী প্রকৃতির একটি মামলা মানে একটি মামলায় যখন মামলার মূল প্রশ্নটি সম্পত্তি বা শিরোনামের সাথে সম্পর্কিত। দেওয়ানী মামলা কার্যধারা সিভিল প্রসিডিউর অ্যাক্ট,১৯০৮ এর ধারা ১৫৮ এবং ৫১ আদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রধানত ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা ও সমাধান বা প্রতিকারের জন্য দেওয়ানী আদালতের দারস্ত হতে হয়। অপরপক্ষে, এই ভূমি সংক্রান্ত অপরাধবিষয়ক মামলা ফৌজদারী আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। দণ্ডবিধি আইন, ১৮৬০ এর অষ্টাদশ অধ্যায়ে ৪৬৩ থেকে ৪৭৭ ধারায় বিশেষভাবে আলোচনা করা আছে। এছাড়াও ওই আইনের ৪২০, ৪০৬ ধারাতেও এ সংক্রান্তে আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে। দণ্ডবিধির এ সকল ধারায় ভূমি সংক্রান্ত অপরাধীর সাজা ও বিচারপ্রার্থীরা বিচার পেতে পারে। ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ ও বিচারের জন্য দণ্ডবিধি আইন, ১৮৬০ এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত একটি আইন যোগ হয়েছে। আইনটির নাম ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩’।
এই আইনটি ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে কার্যকর হয়। এই আইনটির ৩ ধারায় বলা আছে- ‘এই আইনের বিধানাবলী অন্যান্য আইনের কোন বিধানের ব্যত্যয় না হইয়া উহার অতিরিক্ত হইবে’। এই আইনটি প্রণনের মূলত উদ্দেশ্য হলো ভূমি সংক্রান্ত নানাবিধ অপরাধ যেমন- ভূমির অবৈধ দখল, ভূমি সংক্রান্ত জাল-জালিয়াতি, অবৈধভাবে উচ্ছেদ, প্রতারণার মানসে কারো ভূমি নিজের বলে দাবি করা। এছাড়া ভূমি অপরাধের মাধ্যমে অসদুপায় ব্যবহার রোধকল্পে দ্রুত সুষ্ঠু প্রতিকার ও অপরাধীর সাজা নিশ্চিতে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটির বিধি প্রণয়ন এরই মধ্যে হয়েছে। তাই নতুন এই আইনটি কার্যকরে বা মামলা বিচারে আর কোনো বাধা থাকছে না। নতুন এই আইনটিতে মোট ২৭টি ধারা আছে। এই আইনের ১৯ ধারায় অপরাধের বিচার সংক্রান্তে আলোচনা করা হয়েছে। ধারা ৪ : ভূমি হস্তান্তর, জরিপ, রেকর্ড হালনাগাদকরণ বা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোনো কার্য ভূমি প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- অন্যের মালিকানাধীন ভূমি স্বীয় মালিকানাধীন ভূমি হিসাবে প্রচার করা, তথ্য গোপন করিয়া কোনো ভূমি, সম্পূর্ণ বা উহার অংশবিশেষ, কোনো ব্যক্তি বরাবর হস্তান্তর বা সমর্পণ করা, স্বীয় মালিকানাধীন ভূমির অতিরিক্ত ভূমি বা অন্যের মালিকানাধীন ভূমি, তদ্?কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হইয়া, কোনো ব্যক্তি বরাবর হস্তান্তর বা সমর্পণ করা, কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তি বলিয়া মিথ্যা পরিচয় প্রদান করিয়া বা জ্ঞাতসারে এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তিরূপে প্রতিস্থাপিত করিয়া কোনো ভূমি সম্পূর্ণ বা উহার অংশবিশেষ হস্তান্তর বা সমর্পণ করা, মিথ্যা বিবরণ সংবলিত কোনো দলিল স্বাক্ষর বা সম্পাদন করা, কর্তৃপক্ষের নিকট মিথ্যা বা অসত্য-তথ্য প্রদান করা ইত্যাদি।
এ সকল অপরাধের জন্য অপরাধীর অনধিক ৭ (সাত) বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। ওই আইনের ধারা ৫ : ভূমি জালিয়াতি সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ওই আইনে ভূমি হস্তান্তর, জরিপ, রেকর্ড হালনাগাদকরণ বা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো কার্য ভূমি জালিয়াতি সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- কোনো ব্যক্তির ক্ষতি বা অনিষ্ট সাধন করিবার বা কোনো দাবি বা অধিকার সমর্থন করিবার অথবা কোনো ব্যক্তিকে কোনো সম্পত্তি পরিত্যাগ বা চুক্তি সম্পাদন করিতে বাধ্য করিবার অথবা প্রতারণা করা যাইতে পারে এইরূপ অভিপ্রায়ে কোনো মিথ্যা দলিল বা কোনো মিথ্যা দলিলের অংশবিশেষ প্রস্তুতকরণ, কোনো দলিল বা উহার অংশবিশেষ এইরূপ কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্ববলে প্রস্তুত, স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত বলিয়া বিশ্বাস করিবার অভিপ্রায়ে, যে ব্যক্তি কর্তৃক বা যে ব্যক্তির কর্তৃত্ববলে উহা প্রস্তুত, স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত হয়নি বলিয়া, সে জ্ঞাত বা অবগত, অথবা এইরূপ কোনো সময়, যে সময় উহা প্রস্তুত, স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত হয়নি বলিয়া, সে জ্ঞাত বা অবগত, অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে অনুরূপ দলিল বা উহার অংশবিশেষ প্রস্তুত, স্বাক্ষর, সিলমোহর বা সম্পাদন, কোনো দলিল সম্পাদিত হইবার পর আইনানুগ কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে, অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে, উহার কোনো অংশ কর্তন করা বা অন্য কোনোভাবে উহার কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশের পরিবর্তন, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কোনো মিথ্যা দলিল প্রস্তুতকরণ, অসাধু বা প্রতারণামূলকভাবে কোনো ব্যক্তিকে কোনো দলিল স্বাক্ষর, সিলমোহর, সম্পাদনা বা পরিবর্তন করিতে বাধ্য করা ইত্যাদি।
এ সকল অপরাধের জন্য অপরাধীর অনধিক ৭ (সাত) বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। উল্লেখিত ৪ ও ৫ ধারা দুটি আমলযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য। এই ধারার মামলা স্থানীয় এখতিয়ারভুক্ত আদালতে দায়ের করা যাবে এবং বিচার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট করবেন। অত্র আইনের অধীন অপরাধসমূহের মামলা থানায় এফআইআর বা এজাহার এর মাধ্যমে রুজু করা যাবে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ বিনা পরোয়ানায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। ৪ এবং ৫ ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য, অন্যান্য ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য।
চলতি মাসের ৭ নভেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এর আগে ভূমি মন্ত্রণালয় গত ২৪ অক্টোবর বিধিমালা জারি করে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভূমিবিষয়ক প্রতারণা ও জালিয়াতি সংক্রান্ত অপরাধ রোধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এর ধারা ৬ এর উপ-ধারা (১) এর বিধান অনুসারে, আপাতত বলবৎ কোনো আইনের অধীন দায়ের করা কোনো মামলায় কোনো দলিল প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত বা প্রস্তুতকৃত মর্মে প্রমাণিত হলে, বিচারিক আদালত ওই মামলার রায় বা আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও জেলা রেজিস্ট্রার বরাবর প্রেরণ করবেন। প্রতারণা বা জালিয়াতির অভিযোগ বিচারার্থ প্রেরণে আইনের ধারা ৬ এর উপ-ধারা এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, ভূমি হস্তান্তর, জরিপ, রেজিস্ট্রেশন, রেকর্ড হালনাগাদকরণ বা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রমে প্রদর্শিত বা উপস্থাপিত কোনো দলিল বা তথ্যের বিষয়ে প্রতারণা বা জালিয়াতি করা হয়েছে মর্মে বিশ্বাস কবার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জবাব প্রদানের জন্য নোটিশ দেবেন।
এতে বলা হয়েছে, অবৈধ দখল প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণে আইনের ধারা ৭ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, আইনানুগভাবে দখলদার কোনো ব্যক্তিকে উপযুক্ত আদালত বা কর্তৃপক্ষের আদেশ ব্যতীত তার দখলীয় ভূমি হতে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত করবার চেষ্টা করা হলে বা হুমকি প্রদান করা হলে অথবা তাকে ওই ভূমির দখল বা প্রবেশে বাধা প্রদান করা হলে তিনি এতদুদ্দেশ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ আবেদন করতে পারবেন। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, অবৈধভাবে দখলচ্যুত ব্যক্তির দখল পুনরুদ্ধারের আবেদন পদ্ধতি ও নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইনের ধারা ৮ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো ব্যক্তিকে উপযুক্ত আদালত বা কর্তৃপক্ষের আদেশ ব্যতীত তার দখলীয় ভূমি থেকে উচ্ছেদ বা দখলচ্যুত করা হলে তিনি তাতে উল্লিখিত দলিলাদিসহ তার পূর্ব-দখলীয় ভূমিতে দখল পুনর্বহাল করবার নিমিত্ত এতদুদ্দেশ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আবেদন করতে পারবেন।
দখল পুনরুদ্ধারে আইনের ধারা ৮ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, নালিশী ভূমির দখল হস্তান্তরে প্রতিপক্ষ বরাবর প্রদত্ত আদেশ প্রাপ্তির ১৫ (পনের) দিনের মধ্যে প্রতিপক্ষ দখল হস্তান্তরে ব্যর্থ হলে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনকারীকে দখলে পুনর্বহাল করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তার আদেশ প্রদান করতে পারবেন। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা জনসাধারণের ব্যবহার্য ভূমির ক্ষতিসাধন বা শ্রেণি পরিবর্তন এবং অবৈধভাবে মাটির উপরি-স্তর কর্তনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণে আইনের ধারা ১১, ১২ ও ১৩ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কার্য করেন, তাহলে কেন তার বিরুদ্ধে আইনের ধারা ১৪ এর অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে মর্মে জেলা প্রশাসক বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করবেন।
এতে আরও বলা হয়, বিধিমালার অধীন কোনো নোটিশ বা আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সর্বশেষ বসবাসের ঠিকানায় রেজিস্টার্ড ডাকযোগে, জিইপি বা অনুমোদিত কোনো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রেরণ করা যাবে। নকল সরবরাহ প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ করে এ আইনের অধীন প্রদত্ত আদেশ, নথি ও দলিলাদির সার্টিফাইড কপি এবং সত্যায়িত ফটোকপি নকল হিসেবে সরবরাহ করা যাবে। বাস্তবায়ন প্রতিবেদন প্রেরণ ও পর্যালোচনা আইন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণের জন্য বিভাগীয় কমিশনারগণ প্রতি মাসের ১০ (দশ) তারিখের মধ্যে মাসিক প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবেন। বিভাগীয় কমিশনারগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনান্তে সরকারের কাছে, প্রয়োজনে, সুপারিশ দাখিলের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ৭ (সাত) সদস্যের কমিটি থাকবে।
(সূত্র : ঢাকা পোস্ট,৭ নভেম্বর,২০২৪)। এই আইনে মামলা দায়েরের তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। নতুন এই আইনটি প্রণয়নের ফলে বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে, ভূমি সংক্রান্ত অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা যাবে। ভূমি নিয়ে বিরাজমান বিভিন্ন অপরাধের বিচার সুনিশ্চিতভাবে দ্রুত হবে। দেশের অধস্তন আদালতে মামলাজট কমাতে অনন্য ভূমিকা রাখবে। এই আইনটি সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারিভাবে সাধারণ জনগণকে অবগত করাতে হবে।
আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা