মুনতাহার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং কিছু কথা

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সিলেটের কানাইঘাটে নিখোঁজ শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের সন্ধান ও উদ্ধারের আশায় সারা দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছিল, শেষ পর্যন্ত বাড়ির পাশ থেকেই সাড়ে ৫ বছরের এই শিশুর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ১০ নভেম্বর রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাড়ির পার্শ্ববর্তী খালে পুতে রাখা মুনতাহার লাশ উঠিয়ে প্রতিবেশীর পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে গলায় রশি পেঁচানো মুনতাহার লাশ উদ্ধারসহ ঘটনার সাথে জড়িত আলিফজান বিবিকে আটক করা হয়। মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে কানাইঘাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধারসহ একই বাড়ির মৃত ময়না মিয়ার স্ত্রী আলিফজান বেগম (৫৪), কুতুবজান বেগমকে (৭০) আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন মুনতাহার লাশ পাওয়ার পর হত্যাকারী আলিফজান বিবির বসতঘরটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এর আগে থানা পুলিশ শনিবার গভীর রাতে আলিফজান বিবির মেয়ে নিখোঁজ মুনতাহার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শামীমা বেগম মার্জিয়াকে আটক করে।

মার্জিয়াকে থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে আসার পর পুলিশের ভয়ে আলিফজান বিবি বসত ঘরের পাশে একটি নর্দমায় পুতে রাখা মুনতাহার লাশ তুলে রাত সাড়ে ৩টার দিকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের পুকুরে ফেলার চেষ্টার সময় আব্দুল ওয়াহিদসহ আরো কয়েকজন হাতে নাতে তাকে আটক করেন। এর আগে ৩ নভেম্বর দুপুরবেলা শিশু মুনতাহা জেরিন তার বাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের বাড়ির শিশুদের সাথে খেলতে যায়। ওইদিন বিকেল পর্যন্ত শিশু মুনতাহা বাড়িতে ফিরে না আসলে তাকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে কানাইঘাট থানায় পিতা শামীম আহমদ মেয়ের নিখোঁজের জিডি করেন। মুনতাহা নিখোঁজের পর থেকে থানা পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তার আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার সবাই সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও নিখোঁজ মুনতাহার কোনো সন্ধান পাননি। ফুটফুটে সুন্দর শিশু মুনতাহা নিখোঁজের সংবাদ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

সারাদেশের মানুষ নিখোঁজ মুনতাহাকে ফিরে পেতে ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দেন এবং অনেকে স্বইচ্ছায় খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। এলাকার সকলের আশা ছিলো নিখোঁজ মুনতাহার সন্ধান পাওয়া যাবে এবং সে জীবিত অবস্থায় তার বাবা-মার কোলে ফিরে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ জানান, শিশু মুনতাহার এক সময়ের গৃহ শিক্ষিকা ছিল আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা আক্তার মার্জিয়া। কিন্তু মার্জিয়ার খারাপ আচরণের কারণে মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ তার মেয়ে মুনতাহাকে পড়াতে নিষেধ করেন। এতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে মার্জিয়া। মুনতাহার বাবা-মার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গত ৩ নভেম্বর মুনতাহাকে কৌশলে মার্জিয়া এবং তার মা আলিফজান বিবি তাদের বসত ঘরে নিয়ে যায়।

এখানে নিয়ে যাওয়ার পর মুনতাহার মুখের মধ্যে ওড়না ঢুকিয়ে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দি করে ঘরের মধ্যে রাখে হত্যাকারীরা। এরপর গভীর রাতে হত্যাকারীরা মুনতাহার লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে বসতঘরের পাশে খালের নর্দমায় পুতে রাখে। একাধিকবার মুনতাহার পরিবারের লোকজন মার্জিয়াসহ তার পরিবারের কাছে মুনতাহার নিখোঁজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে একেক সময় একেক ধরনের কথা বলতে থাকে তারা। মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে থানা পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। মার্জিয়াকে থানায় নিয়ে আসার পর তার মা আলিফজান বিবি নিহত মুনতাহার পুতে রাখা লাশ তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাড়ির পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে আলিফজান বিবিকে হাতে নাতে আটক করেন স্থানীয়রা।

আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে শামিমা বেগম মার্জিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের মৃত ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুন রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগমকে (৩০) পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়া ৪ জনকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। শিশু মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে নিয়ে আসলে সেখানে আত্মীয়-স্বজনরা ভেঙ্গে পড়েন। এলাকার শত শত লোকজন মুনতাহার ঘাতকদের ফাঁসির দাবি জানান। উল্লেখ্য, এ জাতীয় অমানবিক ঘটনা দেশের প্রায় গেল ১৫ থেকে ১৬ বছর সর্বত্র অহরহই ঘটেছে। বরগুনা জেলা শহরে মাত্র ক’বছর আগে ক’জন সন্ত্রাসী একজনকে দিনে দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করল। বিচারের রায়ে হাইকোর্টের মন্তব্য ছিল, দিনে দুপুরে প্রকাশ্য সন্ত্রাসীদের লোকটাকে মেরে ফেলার দৃশ্য ভিডিও করল লোকজন; কিন্তু কেউ যুবককে বাঁচাতে বাধা দিল না, এগিয়েও আসলো না। সমাজটা কোথায় যাচ্ছে? হ্যাঁ, আমরাও বলি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এত অবনতির কারণ কী? কেন আজ কিছু মানুষ অমানুষের মতো অপরাধ করে চলেছে।

আমাদের মনে হয়, নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণই হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা। মানুষ নামের এসব নরপশুর দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তির ব্যবস্থা কি করা যায় না, যাতে অন্যরা এ জাতীয় অপরাধ করতে সাহস না পায়? আমরা সবাই বলে থাকি, দেশের সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হচ্ছে আইন- শৃঙ্খলাজনিত স্বাভাবিক পরিবেশ ও সুস্থ পরিস্থিতি, অথচ সেরূপ পরিস্থিতির নিশ্চয়তার জন্য প্রচেষ্টা কি চালানো হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তবে ফলাফল কোথায়? আসলে আমরা মুখে যা বলি কার্যক্ষেত্রে তাতে বিশ্বাসী নই। দেশের জনগণকে সকল শক্তির, সকল ক্ষমতার উৎস বলা হলেও এই দেশ ও সমাজে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেয়া হয়। তারা অপরাধ করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে থাকে। জুলুম ও জালেমকে যেখানে আমাদের ঘৃণা করা উচিত, সেখানে আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু নীরবই থাকি না, বরং তাদের পক্ষে কথা বলি, নিরপরাধ বলে বিবৃতি, বক্তৃতা দিয়ে থাকি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আর শাস্তির কঠোর বিধানই অপরাধ দমনের একমাত্র উপায়।

এই লেখাটি যখন শেষ পর্যায়ে ঠিক তখন আমার মনে হলো সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সলের কথা। তিনি আমেরিকাতে গিয়েছিলেন সরকারি সফরে। ওয়াশিংটন বিমান বন্দরে ভিভিআইপি লাউঞ্জে সেখানকার এক সাংবাদিক বাদশাহকে প্রশ্ন করেছিলেন, বাদশা ফয়সল আপনারা বলেন ইসলাম খুব সুন্দর ধর্ম, শান্তির ধর্ম কিন্তু আমরা দেখতে পাই আপনাদের দেশে বিভিন্ন শহরে এমনকি মক্কা-মদিনাতেও শিরচ্ছেদ করা হয়। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? প্রতি উত্তরে মহামান্য বাদশাহ বলেছিলেন, হ্যাঁ এটা সত্য, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে সম্ভাব্য কম সময়ের ভেতর সাক্ষী-প্রমাণ নিয়ে কোরআন-হাদিসের আলোকে অপরাধের মাত্রানুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়। এতে কারও কারও অপরাধোর মাত্রা ওই পর্যায়ের হলে শিরচ্ছেদ করা হয়, এতে অন্যরা অপরাধ করতে সাহস পায় না, ফলে সৌদি আরবে অপরাধপ্রবণতা খুবই কম, এমনকি গভীর রাতে একজন সুন্দরী যুবতী রাস্তা দিয়ে একা হাঁটলেও কেউ তার গায়ে হাত দেবে না, বস্তাবন্দি করে কোটি কোটি ডলার, পাউন্ড বা রিয়াল নিয়ে হাঁটলে কেউ ছিনতাই বা ডাকাতি করতে সাহস পাবে না।

এতে প্রমাণিত হয়, আমাদের দেশে অপরাধের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য যে কোনো দেশ থেকে কম আর আপনিই বলুন, আপনাদের দেশে প্রতি মিনিটে কতটা ছিনতাই, ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে থাকে? বাদশাহ ফয়সলের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শুনে প্রশ্নকারী সাংবাদিক বিস্মিত হয়ে গেলেন। আমাদের দেশেও যদি অপরাধীদের সম্ভাব্য কম সময়ের ভেতরে বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অপরাধপ্রবণতা অবশ্যই হ্রাস পাবে।

সাংবাদিক-কলামিস্ট