তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এবং পরিবর্তিত কর্মজগৎ

সেলিম জাহান

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাসে অতীতে দুটো শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল। প্রথম শিল্পবিপ্লব চালিত হয়েছিল বাষ্পীয় ইঞ্জিন দ্বারা এবং দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকাশক্তি ছিল বৈদ্যুতিক শক্তি। তিন দশক ধরে বিশ্বে আরেকটি বিপ্লব ঘটেছে। সেটি হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব। এর সঙ্গে ঘটেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের অন্যতম ফল হচ্ছে তথ্য এবং সংখ্যা সম্পৃক্ত একটি অর্থনীতি। এ অর্থনীতিতে মানুষে মানুষে তথ্যের বিনিময় আগের চেয়ে অনেক বেশি এবং দ্রুততরভাবে করা যায়। এ অর্থনীতি মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করার বিরাট সুযোগ করে দিয়েছে। আজকের দুনিয়ায় ‘অ্যাপ অর্থনীতির’ অন্তর্ভুক্ত বহুসামগ্রী এবং পণ্যের আদান-প্রদান অনেকটা অদৃশ্যভাবেই হচ্ছে। বেশির ভাগ তথ্য-উপাত্ত আন্তর্যোগের মাধ্যমেই একের থেকে অন্যতে পৌঁছায়- প্রায়ই চৌকশফোনে। বর্তমান বিশ্বে ৫৫০ কোটি মানুষ আন্তর্যোগের সঙ্গে যুক্ত এবং ৪৯০ কোটি মানুষ চৌকশফোনের মালিক। এর ফলে যেভাবে মানুষ কাজ করে, উদ্ভাবন করে, ব্যবসা করে, পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে, তার সবটাই পাল্টে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তি কাজের জগৎকেও বদলে দিয়েছে এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে।

বৈশ্বিক আন্তর্যোগ চলাচল ২০১৯ সালের ২৪০১ এক্সাবাইট থেকে ২০২৪ সালে ৫২৯১ এক্সাবাইট পর্যন্ত বেড়েছে- গড়ে বছরে ২২ শতাংশ বৃদ্ধি। বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বৈশ্বিক পণ্য উৎপাদন এবং বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দশ বছর আগে ২০১৪ সালে বৈশ্বিক পণ্যের বাণিজ্য ছিল ১৯ লাখ কোটি ডলার আর সেবা বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ কোটি ডলার। ২০২৪ সালে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩১ লাখ কোটি ডলার এবং সাত লাখ কোটি ডলার। আজকের বৈশ্বিক বাণিজ্যে জ্ঞানসম্পৃক্ত পণ্যবাণিজ্যের অংশ ক্রমবর্ধমান, পুঁজিঘন বা শ্রমঘন পণ্যের বাণিজ্যের তুলনায় যার প্রবৃদ্ধি হার এক দশমিক তিন গুণ বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে জ্ঞানসম্পৃক্ত পণ্য বাণিজ্য বিশ্বের মোট পণ্য বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ।

সুতরাং যাদের আজকের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার মতো সম্পদ ও দক্ষতা আছে এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে যারাই মূল্যবর্ধন করতে পারছেন, তারাই বর্তমান তথ্য ও সংখ্যাসম্পৃক্ত অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নতি করছেন। কারণ, এ অর্থনীতি দক্ষতাভিত্তিক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। প্রযুক্তির এ পরিবর্তনে কম দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কম এবং সুদক্ষ শ্রমিক বা পেশাজীবীর চাহিদা বেশি। সংজ্ঞাগতভাবেই উচ্চ মানসম্পন্ন মানবিক পুঁজির প্রতি এই পরিবর্তনের পক্ষপাত বেশি এবং এর ফলে কর্মসুযোগে একটা মেরূকরণ ঘটছে। বিশ্বে ২০২২ সাল নাগাদ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কাজের ক্ষেত্রে ১৩ কোটি নতুন কাজের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য একই সময়ে স্বয়ংক্রিয়করণ ও নতুন প্রযুক্তির কারণে সাত কোটি কাজ খোয়া গেছে। নতুন যেসব কাজের জন্য বেশি চাহিদা লক্ষ্য করা গেছে, তার মধ্যে আছে উপাত্ত বিজ্ঞানী ও বিশ্লেষক; ই-বাণিজ্য এবং সামাজিক মাধ্যম বিশেষজ্ঞ; প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী ব্যবস্থাপক; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষণ বিশেষজ্ঞ।

২০৩০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ বিশ্বের মোট কাজের ৩০ শতাংশ এবং মোট অল্পদক্ষ কর্মীর ৪৪ শতাংশ স্বয়ংক্রিয়করণের বলি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। নতুন নতুন উপায়ে কাজ করার পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে তথ্য ও সংখ্যাভিত্তিক অর্থনীতিতে কাজের প্রকৃতি বদলে গেছে। এসব নতুন কাজের পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে নমনীয় কর্মপদ্ধতি, নতুন পদ্ধতিতে যোগাযোগের উপায়, নতুন নতুন পণ্যসামগ্রী এবং নতুন নতুন দক্ষতার চাহিদা। বহিঃউৎসায়ন এবং বৈশ্বিক মূল্যসংযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মী ও উৎপাদককে একটি বৈশ্বিক আন্তর্যোগে সম্পৃক্ত করে নবতর প্রযুক্তি অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের পূর্ববর্তী প্রবণতাগুলোকেও আরো জোরদার ও গভীরতর করেছে। এসব প্রক্রিয়া কাজের প্রকৃতি ও পরিধিকে নতুন রূপ দিয়েছে। ফলে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন।। আসলে বিভিন্ন কর্মপরিধিতে শ্রমবাজার আজ বৈশ্বিক।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের শ্রম আজ নানা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সহজলভ্য। ফলে আজ কাজের জন্য বৈশ্বিক মঞ্চে কর্মজীবীরা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কর্মচাহিদা ও কর্মণ্ডইচ্ছুকদের মধ্যকার ভৌগোলিক বাধাগুলো দূর করে নতুন প্রযুক্তিগুলো এ জাতীয় প্রতিযোগিতাকে তীব্র করেছে। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে একটি উদ্বৃত্ত থাকার কারণে কর্মণ্ডইচ্ছুকদের মাঝে এই প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়। বৈশ্বিকভাবে বহু খাতে উৎপাদন প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মজীবীদের ভৌগোলিক স্থানান্তর করার প্রয়োজন পড়ে না।

আন্তর্যোগ কিংবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা চাহিদারও নানা রূপান্তর ঘটেছে। ভোক্তাদের প্রত্যাশা হচ্ছে কম মূল্যের ভোগ্যপণ্য পাওয়া, নতুন নতুন সামগ্রীর ভোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী লাভ করা। এই পরিবর্তিত প্রবণতায় সস্তা এবং নবতম পণ্যসামগ্রী ভোক্তার দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উৎপাদকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো একটি নমনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, যেখানে শ্রম ব্যয়সহ সব উৎপাদন ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হয়। এর ফলে এমন একটি কর্মের জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সৃষ্টিশীলতা, দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেসব কর্মী এই নতুন কর্মজগতে কাজ করার জন্য উপযুক্ত, তারাও কর্মনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন।

বর্তমান বিশ্বে প্রতি পাঁচজন কর্মীর মধ্যে মাত্র একজন স্থায়ী চুক্তির ভিত্তিতে একটি পূর্ণকালীন কাজে নিযুক্ত। যারা মজুরি কিংবা বেতনভিত্তিক কাজে নিয়োজিত, তাদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই হয় খণ্ডকালীন কর্মী কিংবা অস্থায়ী পদে নিয়োজিত। বিশ্বের শ্রমবাজারে যারা বেকার, তাদের ৩০ শতাংশের বেকারত্ব ভাতার নিরাপত্তা রয়েছে। যে কর্মজগতে নমনীয় কর্মব্যবস্থাই নিয়ম, সেখানে কর্মীর জীবনের স্থিতাবস্থা একটি কঠিন বিষয়। সাধারণত তথ্য-সংখ্যাসম্পৃক্ত অর্থনীতির সঙ্গে উচ্চ প্রযুক্তির কর্মকাণ্ডকেই সম্পৃক্ত করা হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে তথ্য-সংখ্যাসম্পৃক্ত অর্থনীতি কৃষিকাজ থেকে রাস্তার ফেরিকর্ম সব রকমের অনানুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডকেও প্রভাবিত করে। ইথিওপিয়ার কৃষকরা কফির দাম জানার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশেও নারী উদ্যোক্তারা প্রতিবেশীদের মূল্যভিত্তিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন।

ভারতে যেসব কৃষক আবহাওয়া তথ্য ও কফির দাম জানার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাদের মুনাফা আট শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে তথ্যের সহজলভ্যতার কারণে ভোক্তার দেয় মূল্য চার শতাংশ হ্রাস পায়। মালয়েশিয়া, মেক্সিকো ও মরক্কোতে যেসব ক্ষুদ্র বা মধ্যম আকারের ব্যবসায়ী আন্তর্যোগ ব্যবহার করেন, উৎপাদন ব্যয় ও পণ্য বিনিময় ব্যয় কমার কারণে তাদের উৎপাদনশীলতা আট শতাংশ বেড়ে গেছে। আন্তর্যোগাযোগ এবং সচল প্রযুক্তির প্রসার প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ দু’ভাবেই নতুন কাজ সৃষ্টি করে। প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে তাদের শ্রম চাহিদার কারণে নতুন কাজ সৃষ্টি করে। এগুলোকে সহযোগিতাকারী আন্তর্যোগাযোগ স্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং হিসাবনিকাশ রক্ষণাবেক্ষণ ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন কাজ সৃষ্টি করে। মোবাইল ফোনের কারণে কৃষি সম্প্রসারণ সেবার কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। যেমন- কেনিয়ার ‘আই কাউ’ প্রকল্প, যেখানে চাষিরা তাদের পশুদের প্রজনন চক্র নিরীক্ষণ করে সেসব পশুর প্রজনন সম্ভাবনাকে সর্বাধিক কার্যকর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন। তথ্যসেবার মাধ্যমে কর্ম সুযোগের সঙ্গে কর্মণ্ডইচ্ছুকরা সংযুক্ত হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে মোবাইল ফোনের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে কর্মনিয়োজন ১৫ শতাংশ বেড়েছে এবং এ বৃদ্ধির বেশিরভাগই নারী।

লেখক : ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন

দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ জাতিসংঘ উন্নয়ন

কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।