রাজধানীজুড়ে বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে কারা?

মাহমুদ সালেহীন খান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমানে দেশে আন্দোলন এবং পাল্টা আন্দোলনের এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী দফায় দফায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করছে, রাজপথ দখল করে তারা নিজেদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রয়েছে যান চলাচল বন্ধ করা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, এবং ব্যাপক সম্পত্তির ক্ষতি। এই কারণে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। রাজধানীসহ সারা দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, এ বিশৃঙ্খলার পেছনে আসলে কারা কাজ করছে? কারা আন্দোলনকারীদের উস্কানি দিচ্ছে? স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেন সহিংসতা থামানোর জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না? গত সোমবার ‘মেগা মানডে’ নামে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, যেখানে দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলা চালিয়ে কলেজটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এর আগে ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচি ঘোষণা করে সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজসহ তিনটি কলেজে হামলা চালানো হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। সরকারের উপদেষ্টা এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মনে করছেন কেউ বা কিছু একে ইন্ধন দিচ্ছে। আরও অনেকের ধারণা, বর্তমান সরকারের কিছু অংশ এসব আন্দোলনে সাহায্য করছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রও রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নভাবে আন্দোলনকারীদের উস্কানি দেয়া হচ্ছে এবং এতে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত থাকতে পারেন। এছাড়াও, ভারতীয় মিডিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উস্কে দেয়া হচ্ছে। এমনকি আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকেও এসব অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। কিছু কিছু কর্মসূচিতে শোনা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের অনুসারীরা সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, মিত্ররা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটাতে রাজপথে ছিল, তারা এখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে। তাদের অতিরিক্ত বিপ্লবী কর্মসূচি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। শত চেষ্টার পরেও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। তাদের এগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতির কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। কারণ, কোনো অ্যাকশনে গেলে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সব পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনিব্যবস্থা নেয়া হবে। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা অভিযোগ করছেন, যারা সরকারের সুবিধা পাচ্ছে না, তারা এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলছে। এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘এতগুলো ঘটনা একদিনে ঘটতে পারে না, যদি না এর পেছনে বড় কোনো পরিকল্পনা থাকে। আমাদের ধারণা- এখানে অনেক পক্ষের পরিকল্পনা কাজ করছে। সরকার সফলভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে চাচ্ছে, কিন্তু অনেকেই তা হতে দিতে চায় না এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে কাজ করছে। আমরা মনে করি, পুলিশে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন এসেছে। প্রশাসনে স্থবিরতা কাটানোর জন্য আমরা একটি বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করছি। তবে, আমরা সন্দেহ করছি, এসব ঘটনা ঘটে আমাদের মনোযোগ এসব দিকে আকর্ষণ করার জন্য কি না। আমরা তদন্ত করছি, এ ঘটনার সঙ্গে দেশে অথবা বিদেশে কারা জড়িত। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কিছু দুর্বলতা ছিল, আর সে কারণে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় গতকাল রাতে রাজধানীর রূপায়ণ টাওয়ারে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দেশের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে তারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া, আওয়ামী লীগ ও প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বক্তারা বলেছেন- কেউ যেন তাদের উস্কানিতে পা না দেয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শান্ত রাখতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।

গত দুই দিন ধরে রাজধানীর ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসকের গাফিলতিতে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক কলেজে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত রোববার, রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং সরকারি কবি নজরুল কলেজে একসঙ্গে তাণ্ডব চালায় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। অনলাইনে ‘সুপার সানডে’ ঘোষণা দিয়ে তারা এই তাণ্ডব চালায়, যার ফলে সোহরাওয়ার্দী কলেজ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা করে ওই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঘোষণা অনুযায়ী তারা মাতুয়াইলে গিয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালায়, আর সেই কলেজও পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এছাড়া, রাজধানীর সেন্ট গ্রেগরি কলেজেও হামলা চালানো হয়। এদিকে, গত রোববার রাতে ঢাকা পলিটেকনিক এবং বুটেক্সের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, গতকাল শাহবাগে লাখো মানুষের জমায়েতের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেছে একটি সংগঠনের। ওই সংগঠনটি, ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান’ বাংলাদেশ নামে পরিচিত, দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজনকে গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের ১ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছিল এবং ঢাকায় আসার দায়িত্বও তারা নিয়েছিল। বিনিময়ে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। তবে, ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এসে তারা বাধার মুখে পড়ে এবং শাহবাগে জমায়েত হতে পারেনি। যদি এসব হামলা ও সংঘর্ষের পেছনে কোনো ইন্ধন থাকে, তবে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা তাদের পরিকল্পনার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পরে তাদের নিজ নিজ এলাকায় ফেরত পাঠানো হয় এবং ৪ জনকে আটক করা হয়। এছাড়া, ঢাকা ও এর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আটক করে। জানা গেছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শাহবাগে বসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা। ওই কর্মসূচির মূলহোতাকেও আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে বেশ কয়েকটি সংগঠন ও সাধারণ মানুষ। তারা পত্রিকা দুটিকে ইসলামের শত্রু ও ভারতের দালাল বলে দাবি করছে। এর আগে শুক্রবার, ডেইলি স্টারের সামনে তারা জুমার নামাজ আদায় করে। গত রোববার, প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে তারা নামাজ পড়ার পাশাপাশি ভোজের আয়োজনও করে। এরপর পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ ঘটে এবং ৪ জনকে আটক করা হয়। গতকালও তারা কাওরান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এখানেই শেষ নয়, কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। তারা প্রায় প্রতিদিনই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করছে, ফলে নগরবাসী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এই আন্দোলনেও আওয়ামী লীগ এবং সরকারবিরোধী কিছু গোষ্ঠীর ইন্ধন থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বুধবার, একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা এই সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে অভিযান চালায়। সংঘর্ষের মাঝে পুলিশের লাঠিপেটায় অনেকেই আহত হন। এর আগে, ৭ কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করে সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। কয়েক দফা সড়ক অবরোধ করে চলা এই কর্মসূচি নগরবাসীর জন্য তীব্র ভোগান্তি সৃষ্টি করে। একই সময়ে, সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে কয়েকদিন ধরে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এদিকে, বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামায়াতের দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে। অন্যদিকে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করছে। এ ক্ষেত্রেও বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর ইন্ধন থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল, সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। পরে, সংগঠনটির অনুসারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে। এর আগে তারা ডিবি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে, শাহবাগ থেকে ইসকন সদস্যদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয় একদল লোক। এমন পরিস্থিতিতে, গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘অনেক মিত্রই আজ হঠকারীর ভূমিকা পালন করছে। আমরা আমাদের ব্যর্থতা স্বীকার করি, শিখছি এবং তা কাটানোর চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাম ও ডান মানসিকতার কিছু নেতা বা ব্যক্তি সরকারে নিজেদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে না পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী আবেগ ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড দেশের অস্থিরতা বাড়িয়েছে।’ জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সারজিস আলম এক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘দেশ, দেশের মানুষ এবং জনগণের সম্পদ আগে।

যদি কেউ বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করে, সে যে পরিচয়েরই হোক না কেন, দেশের স্বার্থে তাদের প্রতিহত করা এবং জনমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কাজ।’ আরেক স্ট্যাটাসে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘শত চেষ্টার পরেও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। তাদের এগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতির কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। কারণ, কোনো অ্যাকশনে গেলে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সকল পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সামাজিক মাধ্যমে আসিফ মাহমুদের পর একই স্ট্যাটাস নিজের ফেসবুক প্রোফাইলেও আপলোড করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ‘যদি এসব হামলা ও সংঘর্ষের পেছনে কোনো ইন্ধন থাকে, তবে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে।’