নির্যাতন শব্দটি শুনলেই আমরা ধরে নেই নারী ও শিশু নির্যাতনের কথা। সেটাই স্বাভাবিক। শত শত যুগ ধরে সমাজে নারী ও শিশুর ওপর বর্বর অত্যাচার ও বৈষম্য হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই বছরজুড়েই আলোচনায় থাকে নারী ও শিশু নির্যাতন। কিন্তু পুরুষ নির্যাতন শব্দটি সম্ভবত কোনো আলোচনাতেই থাকে না! এটা এখনও এই শতাব্দীর সবচেয়ে কম ব্যবহৃত শব্দ এবং প্রচলিত। কারণ এই সমাজে পুরুষ নির্যাতন বলে কিছু নেই এটাই ধরে নেয়। অথচ ঘটনা এর বিপরীত। এখন সমাজে ঠিক উল্টোটা ঘটছে। যার শিকার হয়ে হাজার হাজার পুরুষ মানসিক কষ্টে দিনযাপন করছে। কারণ এই সমাজ, সমাজের আইন বা মানুষ কেউ পুরুষের নির্যাতনের কথা শোনার জন্য বসে নেই। কোনো পত্রিকা পুুরুষ নির্যাতনের খবর করছে কমই। মাস গেলেই নারীর উপর নির্যাতনের তালিকা প্রকাশ করে; কিন্তু কত সংখ্যক পুরুষ ঠিক একই সময়ে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলার স্বীকার হয়ে কারাগারে আছেন, কারাগারে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন অথবা যৌতুক নির্যাতন মামলা ভয়ে সংসারে মা-বাবাকেও দেখতে পারছেন না। এসব পরিসংখ্যান হয় না। হয়তো হবেও না।
আধুনিক সমাজ সমতা বলতে নারীর অগ্রাধিকার বোঝায় পুরুষের অধিকার বোঝায় না! আশ্চর্য কিন্তু এটাই চরম সত্য। ঠিক এই কারণেই আমি পৃথিবীর সেই সব পুরুষদের বিপক্ষে যারা মুখ বুঝে এসব নির্যাতন সহ্য করছেন। নির্যাতন সহ্য করার বিষয় না।
এটা বলা লজ্জার কিছু না। পুুরুষের উপর করা নির্যাতন প্রায় ক্ষেত্রেই হয় মানসিক। ফলে তা প্রায় অদৃশ্য। প্রমাণ করাও তো প্রায় দুঃসাধ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে এবং শতকরা হারে তা নারী নির্যাতন থেকে কম না। শুধু তা বাইরে না আসার কারণে আমরা বলতে পারছি না অথবা বুঝতেও পারছি না। অথচ জরিপ বলছে ভিন্ন কথা। এসব জরিপও খুব একটা হয় না। যত জরিপ বা হিসাব হয় নারীর ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ম্যান’স রাইটস ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন।
সংগঠনটির দাবি, শারীরিক নির্যাতনের তুলনায় মানসিক নির্যাতনের বেশি শিকার হচ্ছেন পুরুষরা। লোকলজ্জাসহ নানা কারণে এসব ঘটনা অধিকাংশই চাপা পড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভুক্তভোগী পুরুষ বাধ্য হয়ে নির্যাতনের কথা শিকার করেছেন। সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে জরিপ চালিয়েছে বাংলাদেশ ম্যান’স রাইটস ফাউন্ডেশন। তাদের দাবি, সারা দেশে ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া সারা দেশে গত এক বছরে ৭৯২ জন পুরুষ শারীরিক ও মানসিক উভয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর নারায়ণগঞ্জ জেলায় এই নির্যাতনের শিকারের সংখ্যা ৩৯৭ জন। পুরুষদের নির্যাতন দমনে দেশে কোনো আইন নেই বলে এই নির্যাতন বেড়ে চলেছে দাবি করে বাংলাদেশ ম্যান’স রাইটস ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনটি বলছে, ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৩৯৭টি ও সারা দেশে ৭৯২টি, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জে ২১২টি ও সারা দেশে ৪৫০টি, ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জে ১৫৩টি ও সারা দেশে ৩৩০টি, ২০১৯ সালে নারায়ণগঞ্জে ১১৭টি ও সারা দেশে ২৪০টি, ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জে ৮২টি ও সারা দেশে ১৭০টি, ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জে ৬৫টি ও সারা দেশে ১২০টি, ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে ২৩টি ও সারা দেশে ৫০টি পুরুষ নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে তাদের কাছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক গুণ বেশি বলে দাবি করছে সংস্থাটি।
নারী দিবস এলে নানাভাবে দিবসটি পালিত হয়। সেটার দরকার আছে। কিন্তু পুরুষ দিবসটা তো নীরবে নিভৃতে চলে গেল। পুরুষদের বেশিরভাগই জানে না যে, তাদের নিয়ে একটি দিবস আছে। সেই দিবসের গুরুত্ব কি সেটাও জানে না। অথচ সমাজে নারী-পুরুষ দুজনের সমান অধিকার আছে, বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। প্রকাশ্যে নির্যাতনের বিষয়টি এলে হয়তোবা বিচারের প্রশ্নটি আসতো। তবে বেশিরভাগ তো মুখই খোলে না নির্যাতনের বিষয়ে। পাছে লোকজন এই নিয়ে হাসি তামাশা করে। তখন তো সে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে না। এই হলো পুরুষ সমাজের মানসিকতা। দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়েও মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে পারে। তারা সংসার করে। এখানে আইনে নারী নির্যাতনের সুযোগ নিয়ে অনেক প্রতারক নারীই আজ রীতিমতো ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। এ নিয়ে দেশে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয় না। কারণ খোদ পুরুষদের কাছেই বিষয়টি হাস্যকর।
আমাদের চারপাশে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যেখানে দোষ পুরুষের না হলেও একটি বড় অংশ নারীর পক্ষে চলে যায়। এর বিপরীত অবস্থাও হচ্ছে। কিন্তু ব্ল্যাকমেইলিং করে পুরুষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের ঘটনা, মিথ্যা মামলা দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না পুরুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষুলজ্জা, জেল-পুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। আবার মামলার ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন মানসিকভাবে যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে অনেক পরুষকে। সব জেনে বুঝেও কেবলমাত্র সামাজিক লোকলজ্জার ভয়েই সিটিয়ে থাকছেন ঘরের বৃত্তে। কারণ সমাজ এখনও পুুরুষ নির্যাতন শব্দটি শুনতে চায় না। পুরুষ চাইলেও নির্যাতনের কথা বলতে পারছে না।
অন্যদিকে একজন নারী আইনের অপব্যবহার করে ইচ্ছে করলেই ঘটনা সাজিয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে থানা বা আদালতে সহজেই নারী নির্যাতনের মামলা বা যৌতুক মামলা দিতে পারছেন। আমাদের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে নারীর সুরক্ষার জন্য দেশে একাধিক আইন রয়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০, এসিড নিরোধ আইন-২০০২, পারিবারিক সহিংসতা ও দমন আইন-২০১০, যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য নারীর সুরক্ষার জন্য আইনগুলো তৈরি হলেও বর্তমানে এ আইনগুলোকে কিছু নারী-পুরুষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সামান্য কিছুতেই স্বার্থান্বেষী নারী স্বামীদের নাজেহাল করতে এসব আইনের অপপ্রয়োগ করছেন। অন্যদিকে দেশে ‘পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ’ আইন এখনও সৃষ্টি হয়নি। নেই পুরুষ নির্যাতনবিরোধী ট্রাইব্যুনালও। যুগের সাথে সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। তবে পুরুষ নির্যাতন নিয়ে এখনও আমরা সেকেলে মনোভাবেই পরে আছি।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পুরুষ আজ কোনো না কোনো মহিলার দ্বারা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। মানুষের জীবনে বিভিন্ন রকম নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে পারে। কেউ শারীরিক, কেউ মানসিক, কেউ দৈহিক-আর্থিক, কেউ সামাজিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। পাশাপাশি হচ্ছেন শাসন-শোষণের শিকার।
ঘরে-বাইরেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না স্বামী। মোট কথা এটা প্রকাশ্যেই আনছেন না পুরুষরা। দিনের পর দিন ঘরে মুখ বন্ধ করে তারা সহ্য করছেন। পৃথিবীর অর্ধেক গড়েছে নারী আর অর্ধেক নর। নির্যাতিত নারীও হয়েছে এবং হচ্ছে এবং আধুনিক পৃথিবীতে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে সমভাবে- যার আপাত কোনো প্রতিরোধ দেখতে পাচ্ছি না।
বরং এই প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই রয়েছে। দিন বদলেছে, আমরা নারী-পুরুষ ভেদাভেদমুক্ত দেশ চাই। পুরুষ নির্যাতন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা চাই। নারী নির্যাতন আইনের পাশাপাশি পুরুষ নির্যাতন বন্ধে কার্যকর আইন চাই।