সেবাকর্মীর সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন
হাসান আলী, লেখক : কলামিস্ট
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হাসান আলী
মানুষের জীবনে সেবাকর্মীর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনে শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সময় যখন কারো সেবা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তখন তাকে সেবাকর্মী হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সেবাকর্মী দুই ধরনের যথা পয়সা দিয়ে কিংবা পয়সা দিয়ে। পয়সা ছাড়া সেবা বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং নিকটতম আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া যায়। পয়সা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সেবা কিনতে পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক সেবা হলো- নিয়মশৃঙ্খলা, শর্তসাপেক্ষে, টাকার বিনিময়ে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিনতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক সেবা হলো ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সহয়তায় সেবাকর্মী টাকার বিনিময়ে শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করা। সেবা কিনতে হবে এই ধারণা আমাদের সমাজে অতি সাম্প্রতিককালের। শিশুর সেবা যত্ন বাবা মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, মামা খালা, চাচা ফুফুরাই সাধারণত করে থাকত। যৌথ পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুর সেবা যত্নে খুবই আন্তরিক ছিল।
অনেক সময় বোঝা যেত না শিশুটির প্রকৃত বাবা-মা কোনোজন। কালের বিবর্তনে সময়ের প্রয়োজনে যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে। গড়ে উঠেছে একক পরিবার। সেই একক পরিবার ও নানান রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অনু পরিবারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে দৈনন্দিন কাজকর্মে পেশাদার সেবাকর্মীর সেবাগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।ভবিষ্যতে সেবার এই খাতটি বড় পরিসরে চলে যাবে। সেবাকর্মীকে আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখন পর্যন্ত সম্মান-মর্যাদার আসনে বসানো যায়নি। একসময় নার্সিং পেশায় সমাজের পিছিয়ে পড়া, অসহায় দুর্বল অভাব অনটন থাকা নারীর অংশগ্রহণ ছিল অধিক হারে। সময় পাল্টে গেছে নার্সিং পেশা এখন সম্মানজনক পেশার দিকে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে প্রচুর পরিমাণ ছেলে-মেয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে নার্সিং ট্রেনিং নিতে আসে। এ পেশায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে। সামাজিক নানা কারণে সেবাকর্মীর প্রতি উদাসীনতা, অবহেলা, অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি চালু রয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সবলের প্রতি নমনীয় আর দুর্বলের প্রতি অনমনীয়।
বেশিরভাগ মানুষ ধরে নিয়েছে সবল তাকে সহযোগিতা করবে, রক্ষা করবে, সমর্থন দিবে। বাস্তবে ঠিক উল্টোটাই দেখা যায়। দুঃসময়ে দুর্দিনে কষ্টের সময় অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। সাধারণ মানুষের মতো দুর্বল মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ দ্বারা পরিচালিত হলেও মানবিক আচরণে সবচেয়ে অগ্রসরমান। সামাজিক জীবনে দুর্যোগ, দুর্বিপাকে, দুর্ঘটনায়, দুর্ভাবনায় সবার আগে ছুটে আসে। সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষ সবার আগে ছুটে আসে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করতে। সড়কে দুর্ঘটনা হলে সামর্থ্যবান গাড়ির মালিকরা দ্রুত পাশ কাটিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। বড়জোর এক আধটু আহ্-উহ্ করে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। ধনী মানুষকে কখনো উদ্ধার কাজে অংশ নিতে দেখা যায় না, এমনকি তাদের গাড়ি করে নিকটতম হাসপাতালে নিয়ে যায় না।
দেশের দুজন খ্যাতিমান অর্থ মন্ত্রী বোমাহামলার শিকার এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে সাধারণ মানুষ ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। উদ্ধার কাজে দ্রুত ছুটে আসে আশপাশের সাধারণ মানুষ। রাস্তা ঘাটে দুর্ঘটনায়, ঝড় তুফান, বন্যা জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকাণ্ডে সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসে। সেবার কাজে সাধারণ মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানবিক মূল্যবোধ, সততা, নিষ্ঠা, ন্যায়বোধ যতটুকু টিকে আছে তা এদের মধ্যেই। ভবিষ্যতে সেবাকর্মীদের বিশাল অংশ আসবে সাধারণ পরিবার থেকে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারবে; কিন্তু সেটা কখনো সেবাকর্মীর বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, রক্তের সম্পর্কিত মানুষজন নানা কারণে প্রত্যক্ষভাবে প্রবীণদের সেবা দিতে অনেকেই পারবেন বলে মনে হয় না। নির্ভর করতে হবে পেশাদার সেবাকর্মীর সেবার উপর।
মানুষ সবসময়ই আপনজনের সান্নিধ্য পেতে আকুল হয়ে উঠে। বাস্তবতা হলো আপনজন একটা সময়ে পাশে থাকার সুযোগ পায় না। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সামাজিক জীবন গড়ে তুলতে পারলে আপনজনের অভাব কিছুটা হলেও মিটবে। সেবাকর্মীর প্রতি আমাদের প্রভু সুলভ মনোভাব বাদ দিতে হবে। প্রভু সলভ মনোভাব, খবরদারি, অশোভন আচরণ, অবজ্ঞা, অবহেলা মানসম্পন্ন সেবা পাবার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। সেবাকর্মীকে সহকর্মী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আবার পরিবারের একজন সদস্য বানিয়ে ফেললে আবেগিক সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। গড়ে উঠা আবেগিক সম্পর্ক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সংকট তৈরি হতে পারে। সেবাকর্মীকে দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, রান্নাবান্নার কাজে লাগানোর মনোভাব পরিহার করতে হবে। এসব করতে গেলে সেবার মান বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা থাকে।
সেবাকর্মীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা কিংবা স্থাপন করা গর্হিত কাজ। কারণে অকারণে উপহার দেয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, পারিবারিক ঝগড়াঝাটিতে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা, মূল্যবান জিনিসপত্রের তত্ত্বাবধানে রাখা, টাকা-পয়সা জমা রাখা, পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করতে দেয়া, অনেক বেশি নির্ভরশীল হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সেবাকর্মীকে যেসব শর্তে কর্মে নিয়োগ করা হয়েছে, তার বাইরে তাকে অন্য কাজ করতে না দেয়া বিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত। সেবাকর্মীর সাথে পরিবারের সকল সদস্যের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা ভালো; কিন্তু সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ না হলেও কোনো সমস্যা নেই। তবে সম্পর্ক বিরক্তিকর অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই সেবাকর্মী পরিবর্তন করতে হবে। সেবাকর্মী পরিবর্তন যদি নিজেদের পারিবারিক কারণে অনিবার্য হয়ে উঠে, তবে পরবর্তী সেবাকর্মী নিয়োগের পূর্বে পারিবারিক ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা জরুরি। টাকা বাঁচানোর জন্য অপরিচিত প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিয়ে ঝামেলা তৈরি না করাই ভালো। মনে রাখতে হবে প্রবীণদের সেবা দেয়া কঠিন, ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে। সেবা কর্মীর সেবা মূল্য নির্ধারিত তারিখের মধ্যে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। সেবামূল্য পরিশোধে গড়িমসি করলে ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পাওয়া দুষ্কর হতে পারে। সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয়ে আন্দাজে সেবাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। পরবর্তীতে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনেও সমস্যা হতে পারে। সেবাকর্মীর সেবা মূল্য পরিশোধ করার অর্থ এই না যে, সেবাকর্মী শতভাগ আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। মানুষকে সন্তুষ্ট করার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে আরেকটি নেই। সেবাকর্মীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা পেতে হলে সর্বোচ্চ সম্মান, মর্যাদা, সমমর্মিতা দেখাতে হবে। চিৎকার, চেঁচামেচি, গালিগালাজ, অশোভন আচরণ করলে সেবার মান খারাপের দিকে যেতে থাকবে। মাথা ঠান্ডা করে সেবাকর্মীর সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যা মিটাতে সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কোন সেবাকর্মীর মধ্যে আচরণগত ত্রুটি দেখা দিলে তা সংশোধনের জন্য হেদায়েতের লাইনে যাওয়া ঠিক হবে না।