ঢাকা ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আইসিটি খাতের গালগল্প ও বাস্তবতা

ফজলে রাব্বী খান
আইসিটি খাতের গালগল্প ও বাস্তবতা

বাংলা ভাষায় একটি জনপ্রিয় বাগধারা রয়েছে, ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’, যার আক্ষরিক অর্থ সুবিশাল পাহাড় একটি নগণ্য ইঁদুর জন্ম দিয়েছে! বিগত প্রায় ১৬ বছরে বাংলাদেশের আইসিটি সেক্টরের অবস্থা অনেকটা সেরকমই। বিগত সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রায় ৫৩টি প্রকল্প ও ৩৪টি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যার মোট ব্যয় প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের বিনিয়োগ আইসিটি খাতে সত্যিকারে কতটুকু সুফল দিয়েছে সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন। আইসিটিবিষয়ক বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (ইজিডিআই) ২০২৪-এ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের নেটওয়ার্ক রেডিনেস ইনডেক্সে অবস্থান ১৩৩ দেশের ১১২তম। ডাব্লিউআইপিওয়ের গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে অবস্থান ১৩৩ দেশের মধ্যে ১০৬তম। বিশ্বব্যাংকের ‘ডিজিটাল অগ্রগতি ও প্রবণতা প্রতিবেদন ২০২৩’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর হার প্রায় ৫২ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। এর বাইরে আইটিইউ’র আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (আইডিআই) ২০২৪-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হার ৩৯%, যা মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম ও ভুটানের চেয়েও কম! এছাড়াও ইন্টারনেটের স্পিড, ডিজিটাল জীবনমান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, ফ্রিল্যান্সিংসহ অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান তলানির দিকে, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোও আমাদের চেয়ে ঢের এগিয়ে। আইসিটি খাতে উন্নয়নের গালগল্প শোনানো হলেও এ খাতে আমাদের মেরুদণ্ড শক্ত হয়নি। কখনো ডিজিটাল বাংলাদেশ, আবার কখনোবা স্মার্ট বাংলাদেশের বুলি আওড়ানো হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ছিল কথার ফুলঝুরি। আইসিটি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বেশিরভাগই ছিল সরকারি অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির রাস্তা তৈরি করে দেয়ার হাতিয়ার। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া এ সকল প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের কয়েকটি উদাহরণ সামনে আনলেই বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এরকম একটি প্রকল্প হচ্ছে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, যেখানে ৬০০ কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছে অডিট অধিদপ্তর। মোবাইল অ্যাপ নির্মাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকারও বেশি, যার আওতায় ৬০০ অ্যাপের কোনোটিই কাজে আসেনি। ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে হার পাওয়ার প্রকল্পের নারী ফ্রিল্যান্সাররা এর বিপরীতে আয় করেছে মাত্র ২.৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ ছিল প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এটুআই থেকে ৫০% কাজ দেয়া হয়েছে সিন্ডিকেটের ৪টি কোম্পানিকে।

১১ কোটি নাগরিকের এনআইডি’র তথ্য ২০ হাজার কোটি টাকায় বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে গ্রহণ করা হয়েছে ১১টি প্রকল্প। ৩২০ কোটি টাকার লার্নিং অ্যান্ড আরনিং প্রকল্পে অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মেয়াদ, অদক্ষ প্রশিক্ষকসহ নানা অভিযোগ পেয়েছে আইএমইডি।

এরকম ডজন-ডজন উদাহরণ রয়েছে। আইসিটি খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম আর সরকারি অর্থের অপচয়ের কথা বলতে গেলে এই সংক্ষিপ্ত লেখায় তা সম্ভবপর হবে না।

তবে এই উদাহরণগুলো বলে দেয়, এই সেক্টরের উন্নয়নের গালগল্প ও প্রকৃত বাস্তবতার তফাৎ কতখানি! প্রশ্ন হচ্ছে, তলানিতে থাকা আইসিটি খাতকে কীভাবে টেনে তোলা যাবে? এর উত্তর অত্যন্ত সহজ। বিগত সময়ে আইসিটি নিয়ে যে ধরনের পরিকল্পনা বা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে বিভিন্ন গ্লোবাল ইনডেক্সের ইন্ডিকেটরগুলোর সাথে সমন্বয় রাখা হয়নি।

আইসিটি খাত সংস্কারের ক্ষেত্রে সংস্কার পরিকল্পনায় বৈশ্বিক ধারণাপত্রের সাথে সমন্বয় সাধন করাই হবে এই উদ্যোগের মূল দর্শন। সংস্কার ধারণায় প্রথমেই আসতে পারে আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট পেনিট্রেশন রেট ৬০-৭০% উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা যেতে পারে। দেশব্যাপী ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ, ইন্টারনেট স্পিড বৃদ্ধি, ফাইভণ্ডজি নেটওয়ার্ক কাভারেজ বৃদ্ধি ও ডেটা সেন্টারের সংখ্যা বৃদ্ধিকে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

এছাড়াও ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ৮০-৯০% শিক্ষার্থীর কাছে ডিজাটাল ডিভাইসকে সহজলভ্য করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনে প্রণোদনা প্রদান করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সংস্কার পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে আইসিটি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষায় রূপান্তরের কৌশলও। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

একই সাথে ৮০-৯০% শিক্ষার্থীর বেসিক আইসিটি লিটারেসি নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে আগামীতে আইসিটিতে দক্ষ প্রজন্ম পাওয়া সম্ভব হবে। শিক্ষায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় প্রয়োজন হবে। আইসিটি সংস্কার পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে বিশ্ববাজারের উপযোগী দক্ষ আইসিটি জনশক্তি তৈরির কলাকৌশল। এক্ষেত্রে প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্তত ৫ হাজার শিক্ষার্থী ও ইন্ডাস্ট্রির অন্তত ২-৩ হাজার প্রফেশনালদের জন্য বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের অংশগ্রহণ অন্তত ৩০% নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

ইনোভেশন ও মেধাসত্ত্ব সংক্রান্ত গ্লোবাল র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিতান্তই করুণ! তাই গবেষণা, উদ্ভাবন ও জ্ঞান সৃষ্টির বিষয়টিকে সংস্কার পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিবছর আইসিটি সংক্রান্ত অন্তত ৫ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে। ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া গবেষণা কলাবরেশনের জন্য একটি পৃথক কাউন্সিল গঠন করা প্রয়োজন হবে, যার মাধ্যমে বছরে অন্তত ৫০০টি আইসিটি সংক্রান্ত গবেষণায় তহবিল বরাদ্দ ও ৫০০টি উদ্ভাবনী পেটেন্ট ফাইলিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আইসিটি সংস্কার উদ্যোগের অর্থনৈতিক ফলাফল হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে একটি ‘হাইটেক ইকোনমি ইকোসিস্টেম’ তৈরি। এ ইকোসিস্টেম থেকে প্রতিবছর অন্তত ১০০০টি টেক স্টার্ট-আপ ও ৫০-১০০ টেক বেইজড মিডিয়াম ও লার্জ স্কেল কোম্পানি সৃষ্টি হবে।

এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্টার্ট-আপ ফান্ডিং ও সহজশর্তে ব্যাংক বিনিয়োগ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ সকল উদ্যোগের মাধ্যমে ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ ৫০ দেশের মধ্যে উঠে আসবে। আইসিটি ব্যবসার জন্য আইনগত বিষয়গুলোও সহজতর করতে হবে। এছাড়াও আইসিটি রপ্তানি আয় বার্ষিক ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণে প্রণোদনা প্রদান নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

আইসিটি খাতকে এগিয়ে নিতে হলে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রযুক্তি জনপ্রিয়করণের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে স্কুল পর্যায়ে ‘টেক ক্লাব’ গঠন, উপজেলা-জেলা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনী মেলার আয়োজন, বিভিন্ন অলিম্পিয়াড ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের ইভেন্ট আয়োজনে পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। একইসাথে এ খাতে অবদান রাখার জন্য উপযুক্ত উদ্ভাবক, গবেষক, উদ্যোক্তা ও সংগঠকদের সম্মাননা প্রদান করতে হবে। এ উদ্যোগ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণকে উৎসাহিত করবে।

আইসিটির সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে নাগরিক সেবার ডিজিটালাইজেশন ও ডেটা-ড্রিভেন সরকার ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে অন্তত ৮০% সরকারি নাগরিক সেবাকে অনলাইন ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে হবে। সরকারি সকল তথ্য-উপাত্তকে ডিজিটাল ডেটায় সংরক্ষণ ও রূপান্তর করতে হবে। ডেটা-ড্রিভেন পাবলিক পলিসির জন্য ডিজিটাল ডেটা অপরিহার্য।

ডেটা-ড্রিভেন সরকার ব্যবস্থাই আগামীতে জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদের মূল হাতিয়ার হবে।

সকল ক্ষেত্রে এ সকল ডেটা ও সিস্টেমকে সুরক্ষিত করতে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও যথাদ্রুত তা বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত