‘১ ডিসেম্বর’ বিশ্ব এইডস দিবস। এই দিনে সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগ এবং দেশে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কর্মসূচি হাতে নিয়ে থাকে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। কারণ এইচআইভি-এইডস এমন একটি রোগ যার থেকে মুক্তির কোনো ওষুধ নেই, তবে সজাগতা এই মহামারি থেকে বাঁচার অন্যতম এবং সবচেয়ে সহজ হাতিয়ার। এইডস এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে গিয়ে এক সময়ে শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। এইচআইভি হচ্ছে ভাইরাসটির নাম এবং এইডস হচ্ছে এই ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টিকারী একটি অবস্থা। এইচআইভি এবং এর লক্ষণগুলো সাধারণত আমরা অনেকেই অবজ্ঞা করি, কারণ এই লক্ষণগুলো অন্যান্য কিছু রোগের কারণেও হতে পারে। তবে এগুলোকে অবজ্ঞা না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটাই শ্রেয়।
জ্বর, অবসাদ, ডায়ারিয়া, ওজন কমে যাওয়া, মুখের ভেতরে ইনফেকশন, যৌনরোগ। এইসব অবস্থায় চিকিৎসা না করাটাই হচ্ছে অসাবধানতা। এই অসাবধানতাই এসব রোগের মাধ্যমে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে নষ্ট করতে সাহায্য করে এবং ধীরে ধীরে তা এইডস-এর দিকে অগ্রসর হয়। রাতে ঘেমে ভিজে যাওয়া, জ্বরের আবৃত্ত, অত্যধিক ডায়রিয়া, জিব্বা ও মুখে সাদা সাদা ফ্যাকাশে ছোপ, অত্যধিক অবসাদ, অত্যধিক ওজন কমা এবং অস্বাভাবিক চর্মরোগের বৃদ্ধি। নিম্নলিখিত কারণে এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে। যেমন- অসুরক্ষিত যৌনসম্পর্ক করলে। এইচআইভি সংক্রমিত রক্ত নিলে। এইচআইভি জীবাণুরহিত সুঁচণ্ডসিরিঞ্জ-ব্লেড ব্যবহারে।
কীভাবে ছড়ায় না? এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে করমর্দন বা আলিঙ্গন করলে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া বা একই টয়লেট ব্যবহার করলে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে একই পুকুর বা জলাশয়ে গোসল করলে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে একই ঘরে থাকলে। মশার কামড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, মহিলাদের শরীরে এই রোগের আক্রমণ পুরুষদের থেকেই হয়। যেমন- একজন পুরুষ যার এক বা ততোধিক সঙ্গীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে তিনি জেনেশুনে বা অজান্তে একজন মহিলাকে বিয়ে করলেন। পরবর্তীতে কয়েক বছর দেখা গেল, গর্ভকালীন সময়ে রক্ত পরীক্ষাকালে ওই মহিলার শরীরে এইচআইভি’র জীবাণু রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর রক্তপরীক্ষা করলে দেখা যায় স্বামীও পজিটিভ রয়েছেন। অর্থাৎ অত্যধিক যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে কখন তার শরীরে এইচআইভি-ও জীবাণু প্রবেশ করেছে তিনি হয়তো জানেনই না। অথবা, জানা সত্ত্বেও তিনি তার রোগ গোপন করে বিয়ে করেছেন। তাই, বিয়ের আগে যতই ধর্মীয় আচার-পদ্ধতি, জ্যোতিষশান্ত্রের সাহায্য নিন কোনো আপত্তি নেই তবে তার সঙ্গে অন্তত পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই রক্তের এইচআইভি পরীক্ষা করানো অবশ্যই উচিত। এমন ঘটনা শুধু মহিলাদের ক্ষেত্রে নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তাই সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে বিনামূল্যে এই রক্তের পরীক্ষা করাতে পারেন।
একথা আমরা সকলেই জানি রক্তদান জীবনদান। তবে সরকারি বিধিমতো রক্ত গ্রহণ না করলে তা থেকেও ছড়াতে পারে এইচআইভি-ও জীবাণু। এখানে বলতে চাই যে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে যখন আমরা রক্ত নিতে যাই, তখন তার বদলে এক বোতল রক্ত জমা রাখা বাধ্যতামূলক।
এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক, এইচআইভি ভাইরাস ৬ মাস থেকে বছর কয়েক সময়ে এই রোগ শরীরে থাকলেও সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় তা ধরা পড়ে না এবং এই রক্ত যারই শরীরে যাবে তিনি অদূর ভবিষ্যতে এইচআইভি আক্রান্ত হবেনই। এসব অজানা তথ্যের অভাবে আমরা প্রায়ই দেখি মানুষ অপরিচিত লোকের থেকে রক্ত নিয়ে থাকেন যার পরবর্তী পরিণাম, দাঁড়ায় ভয়াবহ। তাই সবাইকে অনুরোধ, একমাত্র সুপরিচিত ব্যক্তির থেকেই রক্ত নিন অথবা ব্লাড ব্যাঙ্ক-এ রক্ত জমা দিন। নইলে এ রক্ত জীবনদানের পরিবর্তে মরণ ডেকে আনবে।
এইচআইভি থেকে বাঁচার উপায়- এই বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যৌন-সম্বন্ধীয় আলোচনা আমাদের সমাজে এক অবাস্তব কল্পনা বললেই চলে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সরকারি তথ্য মতে, আমাদের দেশে এইচআইভি ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায়। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে যৌনরোগ। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই এর চিকিৎসা করাতে লজ্জা অনুভব করেন অথবা সামাজিক অসম্মানের ভয়ে বলা এবং চিকিৎসা উভয় থেকেই দূরে থাকেন। এ লজ্জাই পরবর্তীতে ডেকে আনে নানা সমস্যা। যার অন্যতম হচ্ছে এইচআইভি-এইডস। ৮৭ শতাংশ রোগ যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায় তার ৪০ শতাংশ সংক্রমণই কমে যাবে যদি সকলে সঠিক সময়ে যৌনরোগের চিকিৎসা করান। কারণ, একজন সুস্থ মানুষের শরীরে এইচআইভি জীবাণু যত তাড়াতাড়ি ছড়ায় তার প্রায় ১০ গুণ তাড়াতাড়ি একজন যৌন রোগীর শরীরে ছড়ায়। যৌনরোগ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগেই নষ্ট করে ফেলে তাই এইচআইভি সহজে বিনা বাধায় প্রবেশ করে মানুষের শরীরে।
যৌনাঙ্গে ঘা, জ্বলন, চুলকানি ইত্যাদি হচ্ছে পুরুষের ক্ষেত্রে যৌনরোগের লক্ষণ। যৌনাঙ্গে ঘায়ের মধ্যে ধাতুর সমস্যা। ধাতু নিঃসরণ বা ধাতুর সমস্যা। পায়ুদ্বার থেকে নিঃসরণ। সিফিলিস। হেপাটাইটিস বি,সি,ই। যৌনাঙ্গে সংক্রমণ। কুঁচকিতে প্রবাহ। যৌনাঙ্গে উকুন ইত্যাদি।
সদাস্রাব এর সমস্যা। যৌনাঙ্গে ঘা জ্বলন। অনাবশ্যক রক্তপাত হওয়া। তলপেটের অস্বাভাবিক ব্যথা। হারপিসজনিত রোগ। গর্ভপাত বারংবার হলেও যৌনরোগের সমস্যা থাকতে পারে। সিফিলিস। যৌনাঙ্গে স্ক্যাবিস পোকার আক্রমণ। যৌনাঙ্গে উকুন ইত্যাদি।
উপরোক্ত সমস্যাগুলো অত্যন্ত মারাত্মক রোগ ধারণ করতে পারে মানবশরীরে। এসব রোগের চিকিৎসা মূল সমস্যাই হচ্ছে সামাজিক ভয় এবং লজ্জা; কিন্তু এই রোগের চিকিৎসা যদি আমাদের দেশ থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ এইচআইভি আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে তবে সে চিকিৎসায় লজ্জা কেন? এখানে আরো বলে রাখা উচিত যে, মহিলাদের সাদাস্রাব এর সমস্যায় চিকিৎসা শুধু এইচআইভির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কিন্তু নয়। বরং আমাদের জানা উচিত, সমস্ত বিশ্বে যখন স্তন ক্যান্সারজনিত রোগের প্রভাব বেশি তখন এ অঞ্চলে জরায়ু ক্যান্সার রোগজনিত প্রভাব অনেক বেশি। তাই সাদাস্রাব এর চিকিৎসা মহিলাদের যেভাবে এইচআইভি থেকে সুরক্ষা দেয়, তেমনি ক্যান্সারের মতো জটিল সমস্যার কবল থেকেও বাঁচিয়ে রাখে। তাছাড়া, সিফিলিস নামক রোগ শরীরে থাকলে মহিলাদের বারবার গর্ভপাতও হতে পারে। কাজেই এই রোগের চিকিৎসা যেমন এইচআইভি থেকে বাঁচাবে তেমনি গর্ভাশয়ে শিশুমৃত্যুর হারও কমাতে পারে। তাই লজ্জা নয়, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাই হচ্ছে বাঁচার একমাত্র উপায়।
এছাড়াও আমাদের শরীরে এইচআইভি ছড়ায় যেসব কারণে তা হচ্ছে- সেলুনে একই ব্লেড বারবার ব্যবহার। ট্যাঁটু বানানো। একই সিরিঞ্জ বা সুঁচ দিয়ে একাধিক ব্যক্তির ইঞ্জেকশন নেয়া। অন্যান্য অজানা কিছু কারণ।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা যখনই সেলুনে দাড়ি কাটাতে যাই না- কেন, সবসময়ই যাতে নতুন ব্লেড ব্যবহার করা হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কারণ এভাবেও আমাদের শরীরে ০.০৩ শতাংশ এইচআইভি ছড়াতে পারে। তাছাড়াও ট্যাঁটু বা শরীরে ছাপ বসানো যুব প্রজন্মের কাছে এক ফ্যাশন। তবে মনে রাখবেন, এসব করার সময়ে এক সুঁচের বারবার ব্যবহার আপনার শরীরে ছড়াতে পারে অথবা হেপাটাইটিস বি,সি’র মতো রোগও ছড়াতে পারে।
সবশেষে সকলের কাছে অনুরোধ যে, এইচআইভি-এইডস-এর নাম শুনে আতঙ্কিত না হয়ে বরং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করান, তবেই আমাদের সমাজ ও দেশ এইচআইভি মুক্ত হবে। রোগ হওয়ার পর কাঁদার চেয়ে লজ্জা ছেড়ে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরমার্শ গ্রহণ করুন এবং সুস্থ থাকুন।