‘লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার/কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার।/ ভালা কইরা ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর/আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার’।/ এই ভাবিয়া হাসন রাজা, ঘর বাড়ি না বান্দে/কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়, তাই ভাবিয়া কান্দে।’
এই গান শুনলেই সবাই বুঝতে পারে এটা হাসন রাজার গান। এই গান শোনেনি, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। গানের রচয়িতা মরমী কবি, দার্শনিক ও বাউল হাসন রাজা। দেশ, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি ধর্ম রয়েছে, যাকে মানবতা বলে। এই মানবতা সাধনার একটি রুপ হলো মরমী সাধনা। যে সাধনা হাসন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। তার গান শুনলেই মনের মাঝে আধ্যাত্মবোধের জন্ম হয় অবলীলায়। এক সময়কার প্রতাপশালী জমিদার হাসন রাজা একদিন হয়ে গেলেন মরমী কবি ও বাউল সাধক। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে মরমী কবি হাসন রাজার জন্ম।
১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর জন্ম এবং মৃত্যু ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর। হাসনের পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। বংশ পরম্পরায় তারা হিন্দু ছিলেন। অতঃপর তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে সিলেটে এসে আবাস গাড়েন। তার দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে মাত্র অল্প বয়সে হাসন জমিদারীতে অভিষিক্ত হন। হাসন রাজা সুপুরুষ ছিলেন। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। এছাড়াও আরবী ও ফার্সি ভাষায় ছিল বিশেষ দক্ষতা। তিনি যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক নারীর সাথে মেলামেশা করেছেন। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌকাবিহারে চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাসন প্রচুর গান রচনা করেছেন। বাইজী দিয়ে নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। হাসন রাজার আধ্যাত্মিক জগতে আগমন অনেকটা আকস্মিকভাবে। লোক মুখে শোনা যায়- একদিন তিনি একটি স্বপ্ন দেখলেন এবং এরপরই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করলেন। বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করলেন।
জীবনযাত্রায় আনলেন বিপুল পরিবর্তন। নিয়মিত প্রজাদের খোঁজখবর রাখা থেকে শুরু করে এলাকায় বিদ্যালয়, মসজিদ এবং আখড়া স্থাপন করলেন। সেই সাথে চলতে লাগলো গান রচনা।১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত ২০৬টি নিয়ে গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্?’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার রচিত গ্রন্থ ‘সৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয ছিল- ‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশি।‘হাসন বাহার’ নামে তার আর একটা বই আছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দি গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়। হাসন রাজা তার গানের মধ্যে গভীর জীবন দর্শন ও আত্মোপলব্ধি প্রকাশ পায়। যখন তিনি তার ভোগ বিলাস ছেড়ে দিলেন, তখনকার রচিত একটি গানের অংশবিশেষ, ‘গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি। হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি।’ ‘হাসন রাজার উদাসী মনের ছিলেন বলৈ গান লিখেছেন’ একদিন তোর হইবরে মরনরে। জাগতিক দুই চোখ দিয়ে বাস্তব জগত দেখা যায়। তৃতীয় নয়ন বা মনের চোখ দিয়ে মানুষ জীবন জগত এবং স্রষ্টার মহিমা উপলব্ধি করতে পারে। যেমনটা দেখা যায় হাসনের আরেকটি কবিতায়- ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে। আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।‘
হাসন মুসলিম ছিলেন, তাইতো তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়- ‘আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে, হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে’ কিন্তু তার গানের পূর্বপুরুষের ধর্ম, হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রেমও লক্ষণীয়। যেমন ‘আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি, আমি কি তোর যমকে ভয় করি। শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।’ হাসন দর্শন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।’
এছাড়া ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দহিবার্ট লেকচারেদ রবীন্দ্রনাথ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সংগীতের উল্লেখ করেন। মৃত্যুর আগে হাসন রাজা নিজে নিজেই নিজের কবর বানিয়েছিলেন । জীবনের শেষ সময়ে তসবিহ নিয়ে কবরের পাশে বসে থাকতেন আর সবাইকে বলতেন এটাই তার বাড়ি। যৌবনের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে এক সময় হাসন রাজা আল্লাহর প্রেমে মশগুল হয়ে পড়েন। জাগতিক সমস্ত কিছু তার কাছে তখন অসার মনে হয়েছিল।
তার গান ও দর্শনে মিশে আছে বাংলার মাটি ও মানুষের নাড়ির টান। দর্শন চেতনার বিচারে লালনের পর যে উল্লেখযোগ্য নামটি আসে, তিনি হাসন রাজা। কারও মতে হাসন ছিলেন সুফি বাদী। আবার কারো মতে চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তিনি নিজেকে বাউলা বা বাউল বলে দাবি করতেন। তার গান বুঝতে গেলে আগে তার চলনটা বুঝতে হয়।’ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্ছিত একজন মরমী কবি তার সৃষ্টির মহিমায় দার্শনিক বনে গিয়েছেন। তাই হাসন রাজার নামের পূর্বে মরমী শব্দটির সাথে দার্শনিক শব্দটিও যুক্ত করতেও কোন বাধা নেই। হাসন রাজার দার্শনিকতার পরিচয় মেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। প্রভাত কুমার শর্মার হাত ঘুরে তিনি হাসন রাজার কিছু গানের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই গানগুলোর মাধ্যমেই কবিগুরু হাসন রাজাকে মূল্যয়ন করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘পুর্ব বঙ্গের একটি গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই। হাসন রাজা দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। চারি হাত লম্বা দেহ, উঁচু ধারালো নাসিকা, পিঙ্গল চোখ মাথায় বাবরি চুল- তাকে দেখে ইরানি সুফি কবিদের একখানা চেহারা চোখের সামনে ভাসত সূত্রে বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন হাসন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এক শৌখিন জমিদার, তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া’। ধীরে ধীরে এক আধ্যাত্মিক পরিবর্তন তার স্বপ্ন ও জীবন দর্শনে আমূল প্রভাব ফেলে দিল। তার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগল। তার চরিত্রে এল এক শান্ত ভাব। বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি সাদামাঠা জীবন বেছে নিলেন। জমকালো পোশাকের পরিবর্তে সাধারণ পোশাক পরতে এবং বিগত জীবনের ভুলভ্রান্তি তিনি শোধরাতে লাগলেন। একপর্যায়ে তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নামরে, না করলাম তার কাম।’ এভাবে তার বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতে এল বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তার এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের বৈরাগ্য তৈরি হল। হাসন রাজা আল্লাহর প্রেমে মশগুল হয়ে পড়েন। হাসন রাজা আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হলেন, আর রচনা করতে লাগলেন গান, সব গানেই যেন প্রকাশ পেতে লাগল সৃষ্টিকর্তার অপরূপ মহিমার বর্ণনা। তিনি সম্পূর্ণ বদলে গেলেন, মানুষ প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে পশু-পাখির প্রতিও তিনি সদয় হলেন। পশু-পাখি হত্যা বন্ধ করে দিলেন। কুড়া (পাখি) শিকার তিনি ছেড়ে দিলেন, এককালের ভোগবিলাসী হাসন এবার হয়ে উঠলেন নম্র হাসন। তার গানে আক্ষেপের সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল। কখনো গেয়ে উঠেছেন- ‘বাউলা কে বানাইলো রে/হাসন রাজারে/বাউলা কে বানাইলো রে’। আবার কখনো গেয়েছেন- ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে/কান্দে হাসন রাজার মন-ময়না রে’।