ঢাকা ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস

দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

আজ সোমবার আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলুপ্ত দিবস ২০২৪। ১৯৪৯ সালের ২ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ব্যক্তি কেনা-বেচা এবং শোষণ দমনের বিষয়ে কনভেনশন গৃহীত হয় (সিদ্ধান্ত ৩১৭/৪)। উক্ত কনভেনশন গৃহীত হওয়ার দিনটি স্মরণে প্রতি বছর ২ ডিসেম্বর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক দাস প্রথা বিলুপ্ত দিবস’। ১৯৪৯ সালের আজকের এই দিনে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ব্যক্তি বেচাকেনা এবং শোষণ দমনের বিষয়ে কনভেনশন গৃহীত হয়। এই দিনটি স্মরণে প্রতি বছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস। এই কনভেনশন গৃহীত হওয়ার প্রায় ৮০ বছর চলে গেলেও দাসপ্রথা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে সারা বিশ্বে এমনটি বলা যায় না। বরং নতুন রূপে নতুন আঙ্গিকে দাসত্ব বা ক্রীতদাস প্রথাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। উন্নত অনুন্নত সব দেশেই দৃষ্টির আড়ালে দেখা যায় আজও ক্রীতদাস; বিশেষ করে আমাদের এই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আরব ও আফ্রিকা অঞ্চলে। আর তাই আজকের এই দিনটি পালনের প্রাসঙ্গিকতা এখনও বিদ্যমান।

১৭৯১ সালের ২২ ও ২৩ আগস্ট বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীতে ব্রিটেন ১৮০৭ সালে ও যুক্তরাষ্ট্র ১৮০৮ সালে তাদের আফ্রিকান দাসদের মুক্তি দেয়। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে ১৮৩৩, ১৮৪৮ ও ১৮৬৫ সালে আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। এ্ছাড়া সুইডেন ১৮৪৬, আর্জেন্টিনা ১৮৫৩, মেক্সিকো ১৮২৯, ডেনমার্ক ১৮৪৮, কিউবা ১৮৮৬, ব্রাজিল ১৮৮৮, মাদাগাস্কার ১৮৯৬, চীন ১৯১০, আফগানিস্তান ১৯২৩, ইরাক ১৯২৪, ইরান ১৯২৮, মিয়ানমার ১৯২৯, সৌদি আরব ১৯৬২, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৯৬৩, নেপাল ১৯২৬ তাদের দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করে।

আদিম মানুষ নব্য প্রস্তরযুগে প্রবেশের সময় থেকেই অর্থাৎ কৃষিকাজ শুরুর সময় থেকেই দাসব্যবস্থার শুরু। ১৭৬০ সালে হাম্বুরাবি নামের ব্যাবিলনের এক শাসক আইন করে দাস প্রথা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই আইনে গৃহনির্মাণ, শস্য উৎপাদনসহ নানা কাজে জোর করে শ্রমিক নিয়োগের নিদর্শন পাওয়া যায়। এরপর বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সভ্যতাতেই দাসব্যবস্থার প্রচলন ছিল। বিশেষত গ্রিক সভ্যতায় এর ভয়াবহতা ছিল ব্যাপক। অ্যারিস্টটলসহ অনেক বোদ্ধাই তখন বলেছিলেন, দাসত্ব একটি প্রাকৃতিক বিষয়। প্রকৃতিগতভাবেই কেউ কেউ দাস হয়ে জন্মগ্রহণ করে। ১৪৭২ সালে পর্তুগিজ বণিকেরা প্রথম দাস চুক্তি করে। ১৬৬৩ সালে ভার্জিনিয়ার আদালত রায় ঘোষণা করেন, যে মা যদি দাস হয় তার সন্তানও দাস বলে বিবেচিত হবে। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য ও মুসলিম সভ্যতার সময়েও দাসব্যবসা ব্যাপকতা লাভ করেছিল। আফ্রিকায় দাস ব্যবসা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। ঘানা, মালিসহ এমন কিছু দেশের প্রায় ৩ শতাংশ জনগণই ছিল দাস। এশিয়াতেও দাসব্যবস্থার প্রচলন ছিল, তবে তা অনেক পরে এই মহাদেশে প্রবেশ করে। এক তথ্যে উল্লেখ আছে, ১৮৪১ সালে ভারত উপমহাদেশে প্রায় নয় মিলিয়ন মানুষ দাস হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সোনা, হীরা বা অন্য মূল্যবান বস্তু দাসদের মূল্য হিসেবে বিবেচিত হতো। শরীরে বেশি শক্তি রাখে এমন দাসদের বিক্রি করা হতো উচ্চ মূল্যে। বেশির ভাগ দাস বিক্রি হতো নিলামে। মূলত ইউরোপীয়রা ক্যারিবীয় অঞ্চলে কালোদের আখ চাষসহ নানা কাজে দাস হিসেবে ব্যবহার করত। কিছু সমাজে নিজের দাসকে হত্যা করা আইনসঙ্গত এবং অন্যান্য স্থানে এটি একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

দাসীদের সাধারণত রাখা হতে যৌন লোভ-লালসা পূরণ করার জন্য। তাদের উপপতিœ করে রাখা হত এবং তাদের সন্তানদেরও দাস রুপে রাখা হত বা বিক্রি করা হত। এসব অমানবিক দাসব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে বিক্ষোভণ্ডবিদ্রোহ দানা বাঁধতে থাকে পরবর্তীতে। অষ্টাদশ শতকেই সংগঠিতভাবে দাসেরা বিদ্রোহ শুরু করে আমেরিকা ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে। দাস কিংবদন্তি হিসেবে স্পার্টাকাস যেমন কিংবদন্তি হয়ে আছেন, তেমনি অনেক নাম না-জানা দাসও বিদ্রোহ করে প্রাণ দিয়েছে। আমেরিকান লেখিকা হ্যারিয়েট বিচার স্টো তার উপন্যাস ‘আংকল টম’স কেবিন’-এর কেন্দ্রীয় এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে দাস জীবনের করুণ কাহিনি তুলে ধরেছেন। কালো মানুষদের ওপরে সাদা মানুষদের নির্মম, অমানবিক অত্যাচারের কাহিনি এসব। আমরা জানতে পারি, কী অসহনীয় জীবন শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা পার করেছেন। এসব দাসের ছিল না কোনো স্বাধীনতা। প্রভুর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে বিয়েও করতে পারত না তারা। নিদারুণ পরাধীনতার মধ্যে থেকেও এ দাসরা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে অত্যন্ত উঁচুমানের তুলা উৎপাদন করত। দাস প্রভুরাও তুলা চাষের জন্য ফ্রি লেবারের পরিবর্তে ক্যাপটিভ লেবারই পছন্দ করত। দাস প্রথাকে তারা জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে। তাদের ধারণা ছিল, দাস শ্রমিকদের কাছ থেকে শ্রমশক্তির পুরোটাই নিংড়ে নেয়া সম্ভব। দাসত্ব বলতে বোঝায় কোন মানুষকে জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা এবং এক্ষেত্রে কোন মানুষকে অন্য মানুষের ‘অস্থাবর সম্পত্তি’ হিসেবে গণ্য করা।

এই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ব্যক্তিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই স্থান বা মালিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়। তাদের শ্রমের কোনো মজুরিও নেই। অতীতে কোন কোন সমাজে নিজের দাসকে হত্যা করাও আইনসঙ্গত ছিল। সেইসব বর্বরতা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি, এটা ঠিক। তবে ক্রীতদাস প্রথার যে আধুনিক রূপান্তর, তার থেকে মুক্তির উপায় বের করতে হবে। মানব ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় দাস প্রথার বিলোপ্তি হলেও, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখনো বিশ্বের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব, ও দাসত্ব সংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দি রয়েছে। সমাজবিদরা বলছেন, দাসপ্রথার ভয়াবহতা এখন না থাকলেও এর রূপান্তর ঘটেছে; কিন্তু তা সমাজে আজও বিদ্যমান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আধুনিক বিশ্বে আগের মতো সরাসরি দাস ব্যবসা না থাকলেও মানব পাচার অব্যাহত রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে- দাসপ্রথার ভয়াবহতা এখন না থাকলেও এর রূপান্তর ঘটেছে, কিন্তু সমাজে তা এখনও বিদ্যমান। তাদের মতে, প্রত্যেকের ঘরে ঘরে দাস রয়েছে। তারা হচ্ছে, আমরা যাদের কাজের লোক বলি। তারা আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগে বিছানা থেকে ওঠে, শুতে যায় আমরা শুতে যাওয়ার পরে। তাদেও কোন কর্ম ঘণ্টা নেই, নেই নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো, ছুটি নেই। অনেক বাড়িতে তাদের ভালোমত খাবার দেয়া হয় না। অনেকে নিজেদের জন্য ভালোটা আর কাজের মানুষদেও জন্য কমদামের চাল বরাদ্দ করেন। এসব কিছুই তো প্রকান্তরে দাসপ্রথার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমরা তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি এ নিয়ে কোন প্রতিবাদ করি না। কারণ তাহলে আমরা সুবিধাবঞ্চিত হবো। তাই এই প্রথা বজায় থাকছে।

তাছাড়া, সম্পদশালী ভূমি মালিকের জমি চাষে ‘কৃষক ক্রীতদাস’ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়। রয়েছে শিশুশ্রম বিশ্বের অনেক দেশেই। বাংলাদেশে ১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৬৩ লাখের ওপরে। ৮০ লাখ ১৭ বছরের নিচে শিশুশ্রমিক। আছে পতিতাবৃত্তি ও জোরপূর্বক বিয়ের প্রবণতা। এগুলো দাসত্ব প্রথার আওতায় পড়ে। তাই বলাই যায় দাস প্রথা সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়নি। আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- মানবপাচার, যৌনদাস, জবরদস্তিমূলক শিশুশ্রম, বলপ্রয়োগে বিয়ে ও যুদ্ধে শিশুদের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো। সবচেয়ে বড় কথা, মানবপাচার হয়ে গেছে এখন আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। একে ক্রীতদাস প্রথার নতুন রূপ বলেই অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞগণ। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৭৯১ সালে বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিকান অঞ্চলে প্রথমে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীতে ব্রিটেন ১৮০৭ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৮০৮ সালে তাদের আফ্রিকান দাসদের মুক্তি দেয়। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য ১৮৩৩ সালে, ফ্রান্স ১৮৪৮ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৫ সালে আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। তারপরেও এখনও বিশ্বের এক কোটি ২০ লাখ মানুষ জোর পূর্বক শ্রম, দাসত্ব ও দাসত্ব সংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দি রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে মুক্ত শ্রমের ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্পায়নে ক্রমিক অগ্রগতি এবং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ হতে মানবতাবাদী আন্দোলনসমূহ দাস প্রথাকে ধীরে ধীরে জনগণের নিকট অপ্রিয় ও সমাজে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা দাস প্রথা হতে মুক্ত হয়।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দাসদের মুক্ত করে দিলে যে সওয়াব পাওয়া যায়, সে কথা অনেকবারই বলেছেন। তার বিদায় হজের ভাষণেও দাসদের মুক্ত করে দেয়ার আহ্বান ছিল। তার অতি ঘনিষ্ঠ সাহাবা হজরত বেলাল (রা.) ছিলেন একজন হাবশি ক্রীতদাস। তিনি মধুর কণ্ঠে আজান দিতে পারতেন।

সুদূর আবিসিনিয়া থেকে ইসলামের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মক্কায় এসেছিলেন। মানব-সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের ‘তথাকথিত’ সুসভ্য জাতিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও সেই অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে নেই। এই প্রেক্ষাপটে যেকোন ধরনের দাসপ্রথাই যাতে আমাদের সেই অগ্রযাত্রার পথকে কলংকিত না করে সেটাই প্রত্যাশা।

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা আশা করি ১ মে তথা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মতো আমাদের দেশেও ২ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা মুক্ত দিবস’ যথাযথভাবে পালিত হোক (যদিও অনেক বড় বড় দেশীয় কোম্পানি ১ মে তে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্জক্রম বহাল তবিয়তে চলমান রাখে)। সচেতনতা বাড়ুক সব শ্রেণির পেশাদার বা চাকরিজীবীদের মধ্যে। তৈরি হোক কাজের সুষ্ঠু, বন্ধুসুলভ ও সামাজিক পরিবেশ। দূর হোক মানসিক দাসত্ব ও নির্যাতন। মানসিকতা হোক মানবিক। তাই এই দিনে, আসুন আমরা দাস-প্রথার শিকার মানুষদের সম্মান করতে ও তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে এবং পৃথিবী থেকে দাসপ্রথার জঞ্জাল দূরীকরণের প্রচেষ্টা জোরদার করতে শপথ গ্রহণ করি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত