তরুণরা নতুন বাংলাদেশের যেখানেই দৃষ্টি দিচ্ছে সেখানেই বিশৃঙ্খলা। যুবকরা দেশের যে খাত নিয়ে ভাবছে সেখানেই হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে রাজনীতি- কোথাও সন্তোষজনক শৃঙ্খলা নেই। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে পরিবরারের কর্তাদের বাজারের ব্যাগ হাতে ঘর্মাক্ত হওয়ার ব্যাপারটি- মোটকথা তরুণ-যুবকরা সার্বিকভাবে দেশের একটি লটরপটর অবস্থা দেখছে। রাষ্ট্রের ভেতরের সিস্টেম, শৃঙ্খলার কাঠামো এমনভাবে বিধ্বস্ত যে কারণে তরুণরা ভাবছে এ দেশ ছাঁড়তে পারলে তারা বাঁচে! অভিভাবকদের ধারণা এদেশের কোন ভবিষ্যৎ নেই। নয়া সরকারের আমলে দেশের সার্বিক অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- উপর্যুক্ত আফসোসগুলো বিগত ১০০ দিনের সৃষ্টি? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে সাজানো ফুলের বাগান প্যাঁচাদের আক্রমণে খান খান হয়ে গেছে? এখানে এখনই মন্তব্য দিয়ে ফেলবেন না। তরুণ-যুবকরা বিগত কয়েক দশক দেশকে নিয়ে তেমনভাবে ভেবেছিল যেভাবে এখন ভাবছে? ‘৯০-এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পরে দেশ নিয়ে তরুণদের মধ্যে লক্ষণীয় উদাসীনতা ছিল। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছিল। গত দেড়দশকের ইতিহাস তো এই প্রজন্মের সামনে উন্মুক্ত। কোন রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ব্যাপারে, কোন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতখানি অবশিষ্ট ছিল? কথা যে বলা যায়নি তার প্রমাণ শহীদ আবরার ফাহাদ।
ইন্ডিয়ার সাথে দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তির বিষয়ে ফেসবুকে সামান্য একটি পোস্ট দিয়ে দানবদের হাতে জীবন হারাতে হয়েছিল। আলেমদের ওপর জেল-জুলুমের যে খড়গ তা দেশবাসী জানে। যাদের সামর্থ্য ছিল তারা উচ্চশিক্ষার জন্য হোক, শ্রম বিক্রির জন্য হোক কিংবা স্রেফ নিরাপত্তার নিমিত্তে হোক সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
করোনাকালে কয়েকজন প্রবাসী দেশে ফেরার পথে ঢাকা বিমানবন্দরে স্বদেশী সিস্টেমকে যে গালাগাল করেছিল সেটা বিস্মৃত হননি নিশ্চয়ই। এই দেশকে নিয়ে দীর্ঘ কয়েক দশক ভেবেছে কেবল রাজনীতিবিদরা। ফলাফল তাদের বিদেশে গাড়ি-বাড়ি হয়েছে, বড় কর্তাদের বেগম পাড়া হয়েছে এবং উচ্চবিত্তদের কারো সন্তান এদেশে লেখাপড়া করছে না- এই রীতি চালু হয়েছে। কেউ কেউ দাপট দেখাতে দেখাতে জীবন্ত দানবে পরিণত হয়েছিল। রক্তচোষার নেশায় তারা মানুষের জীন নিয়ে খেলতো। অনেকের মার্কেটিংয়ের শখ সীমান্তের ওপারে, কারো কারো সর্দির চিকিৎসা অন্য দেশে এবং কেউ কেউ পরিবারের সবাইকে আরেকটি দেশে রেখে এখানে শুধু চাকুরি, ব্যবসা কিংবা রাজনীতি করে- এমন মহান সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলেছিল দেশ। তারা দেশকে নিয়ে কতোখানি ভেবেছিল সেটা একটু ভাবেন! বিগত কয়েক দশক দেশ নিয়ে না ভেবে তরুণ যুবকরা করেছিল কি? তারা ব্যস্ত ছিল।
প্রথমবারের মত ভোট প্রদানের অধিকারী হয়েও তারা পছন্দের প্রার্থীকে স্বাধীনভাবে বাছাই করতে পারেনি- এরপরেও তরুণ-তরুণীরা এই সময় চুপ থাকার হেতু তো নিশ্চয়ই আছে? দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি হচ্ছে- এইসব সংবাদ আংশিকভাবে জানার পরেও তরুণদের রক্ত কেন গরম হয়নি? রাগ কেন দ্রোহে রূপান্তরিত হয়নি? আচ্ছা মনে করুন তো, বিগত কয়েক দশক কোন জাতীয় সংস্কৃতি লালন-পালন করে তরুণ-যুবকরা বেড়ে উঠেছে? কোন কোন মহৎ ও বড় লেখকের সাহিত্যকর্ম পড়ার সুযোগ হয়েছে? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলন, গৌরবময় সংগ্রামগুলো এবং মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ ইতিহাস জানতে পেরেছে কি না? তরুণ প্রজন্মকে স্যাডো চেতনা দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা ফলাফলে বৃহদাংশের তরুণ সমাজ এবং যুবকরা দেশ নিয়ে মোটেও ভাবেনি কিংবা স্বাধীনভাবে কথা বলতেও পারেনি।
কখনো কখনো কোন কথা বলার চেষ্টাও করেনি! তবে প্রশ্ন উঠছে, তরুণরা আসলে কি নিয়ে ব্যস্ত ছিল? তরুণদের ব্যস্ত রাখা হয়েছিল ইস্যুতে। হিরো আলমের সংগীত আর পরীমনির প্রেম-বিবাহ-বিচ্ছেদ ছিল থার্টথ্রুব নিউজ। পদ্মাসেতুর কত নম্বর পিলারে পাটাতন উঠছে, সেটার সংবাদ নিতে শত সাংবাদিকেরা লাইন ধরত। সংবাদমাধ্যমগুলোর একাংশে চলতো স্তুতির সার্কাস। সেখানে সার্কাসম্যানরা ইনিয়ে বিনিয়ে দর্শকদের বোকা বানাত। ফেসবুকে রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের ভিডিওতে আরেকজন সেলিব্রেটির স্ক্যান্ডাল দেখার জন্য যুবক-যুবতীরা বুঁদ হয়ে থাকত। ফারাজ করিমের মানবসেবার জন্য বিকাশ করার আবেদন, নফল রোজা রাখা বিষয়ক বয়ান শুনতে শুনতে একদল পড়তে বসার সময় পেতো না। বিদ্যানন্দ জায়েজ কিনা কিংবা আস্ সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে টাকা দেয়া যাবে কিনা- এমন বিতর্ক দখল করতো পড়ার টেবিল! জায়েদখানের দু’টো ডিগবাজির খবর পড়তে না পারলে জ্ঞান চর্চা পূর্ণতা পেতো না।
ব্যারিস্টার সুমনের শুরু করিতেছি মহান আল্লাহর নামে... না শুনলে, তৌহিদ আফ্রিদির লাফালাফি না দেখলে তরুণ-তরুণীদের ঘুম অপূর্ণ থাকত। রোজ রোজ কত ইস্যু টিস্যু হতো যে তা মনেও রাখতে পারিনি। রোজ নতুন নতুন ইস্যু লসে পুরোনোকে মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার খেলায় ব্যস্ত প্রজন্ম দেশ নিয়ে সেভাবে ভকবার ফুরসৎ পায়নি। আর এই গোটাব্যবস্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। তরুণ-যুবকদের ঘুমে রাখার একটা প্রয়াস সর্বদাই ছিল। কেননা, বৃদ্ধদের চেয়ে তরুণরা বেশি সত্য কথা বলে এবং বয়স্কদের থেকে যুবকরা বেশি প্রশ্ন করে- রাষ্ট্র ঝুঁকি নিতে চায়নি! ভোটাধিকার নাই, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উন্নয়নের নামে লুটপাটের মহোৎসব কিংবা রাজসভার জগণ্য মিথ্যাচার- এসব তরুণ প্রজন্মকে দীর্ঘদিন বিচলিত করতে পারেনি। কথা বলার স্বাধীনতা নাই- এসব নিয়ে যুবকরা মোটেও চিন্তিত হয়নি। নিজেদের জিম্মিদশার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক হর্তাকর্তারা টুঁ শব্দও করেনি।
মোটকথা ভালোই চলছিল। ভাগাভাগি জমছিল। কিন্তু যখন চাকরিতে দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে, কোটার যাঁতাকলে পিষ্ট করছিল বেকারত্বের দীর্ঘশ্বাস তখন ছাত্ররা জেগেছে। বলা চলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে সকল দল-মতের শিক্ষার্থীরা একাট্টা হয়েছে। ছাত্রদের সাথে এই লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে বঞ্চিত শিক্ষক, বিবেকবান সুশীল এবং নিপীড়িত জনতা। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে দীর্ঘদিনের জঞ্জাল হটিয়ে যে বাংলাদেশ উদ্ধার হয়ছে, সে বাংলাদেশের সর্বত্র ক্ষত। আমলা-পুলিশের একাংশ দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনভাবে দলকানা থেকেছে, শিক্ষকদের একটি অংশ হয়েছে রাজনৈতিক দলের দালাল। ব্যবসা দখলে রেখেছে সিন্ডিকেট। পরিবহন খাতের দুর্বৃত্তায়ন সীমাহীন।
মোটকথা সমগ্র বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপ। কোন সেক্টরই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় নয়। যখন কথা বলে দাবি আদায়ের কোন সুযোগ ছিল না সেই সময়ের সব পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা কথা বলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে উগড়ে পড়ছে। ফলাফলে বেড়েছে বিপত্তি। নাগরিক জীবন হয়েছে বিপর্যস্ত। আন্দোলনের কবলে পড়ে ঢাকা এখন যানজটের নগরী। আজ অবরোধ তো কাল ঘেরাও! সাথে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র তো আছেই।
তরুণ-যুবকরা দেশকে নিয়ে এখন যেভাবে ভাবছে, এটা যদি ধারাবাহিক হয় তবে এই দেশের চেহারা বদলাবেই। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে, ঘুষখোরদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হলে এই দেশটাকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করতে এক দশক সময়ও লাগবে না।
স্বাধীনতা পরবর্তী ৫৪ বছরের যে জঞ্জাল জমা হয়েছে তা ছ’মাস একবছরে দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য নাগরিকদের ধৈর্য দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর দর্শন পরিবর্তন করে, লোভ সংবরণ করে জনতার কাতারে দাঁড়ানো উচিত। দেশের তরুণ-যুবকদের মধ্যে যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছে তা অতিসহজে হারাবে না। সস্তা ইস্যুতে আটকে রাখার ফলে যে দ্রোহ ও দেশপ্রেম সৃষ্টি হয়েছে তা একেকজনকে বারুদে রুপান্তর ঘটিয়েছে। যে কারণে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছপা হয় না।
সহ-আন্দোলনকারী বুলেটের আঘাতে পাশে লুটিয়ে পরাতেও কেউ পিছপা না দৃষ্টান্ত ‘২৪-এই প্রথম। আগামীদিনের বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই তরুণ-যুবকদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো নিকট ভবিষ্যতে আর স্বেচ্ছাচারিতায় মাতোয়ারা হতে পারবে না বলেই বিশ্বাস। এলেমেলো বাংলাদেশকে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় গুছিয়ে নিতে হবে। এজন্য জাতীয় স্বার্থে ঐক্যের কোন বিকল্প নাই। সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিমিত্তে হোক ছাত্র-জনতার অঙ্গীকার। বাংলাদেশ আর যেন পথ না হারায়।