ঢাকা ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের বাড়াবাড়ি

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের বাড়াবাড়ি

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারত সরকারের বক্তব্য-বিবৃতি ও উদ্বেগ প্রকাশকে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তারা মনে করছেন, ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধোঁয়া তুলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙা লাগানোর অপচেষ্টা করছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করসহ দেশটির রাজনৈতিক নেতাদের একের পর এক বিবৃতি ও হুমকি দেয়া থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে বলে কূটনীতিবিদরা মন্তব্য করেছেন। কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারত কথা বলে বেশি বাড়াবাড়ি করছে এবং বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্টে উঠেপড়ে লেগেছে। দেশটি কেন বাংলাদেশের প্রতি এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে, তা পর্যবেক্ষকদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। মূলত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতের বশংবদ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকেই মোদি ও তার গোদি মিডিয়া নানা ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচার চালিয়ে আসছে।

একজন স্বৈরাচারের পতন নিয়ে কোনো দেশের এমন আহাজারি বিশ্বে বিরল। অথচ শেখ হাসিনার পতনের পর হিন্দুদের ওপর নির্যাতন, মন্দিরে হামলা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ইত্যাদি যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা ছিল না। যেসব হিন্দু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দলের নেতা ও দোসর ছিল, তারা রাজনৈতিক সংঘাতের স্বীকার হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সঙ্গে সঙ্গে সেসব ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। এমনকি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, মাদরাসা ছাত্র, মসজিদের ইমাম হিন্দুদের মন্দিরে কোনো ধরনের হামলা যাতে না হয়, সেজন্য দিনরাত পাহারা দেয়। এমন নজির বিশ্বের কোনো দেশে দেখা যায় না। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে হিন্দুদের নিরাপত্তার নিশ্চিত করে অভয় দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই। আমরা প্রত্যেকে বাংলাদেশের নাগরিক এবং প্রত্যেকে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। তারপরও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙা লাগানোর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পেছনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও মোদি যৌথ প্রয়াসে হচ্ছে বলে ইতোমধ্যে বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশে তাদের দোসরদের দিয়ে সংখ্যালঘু কার্ড খেলে সাম্প্রদায়িক দাঙা লাগানোর অপচেষ্টা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতের বক্তব্য-বিবৃতি এবং অভিযোগের যে কোনো ভিত্তি নেই, তার প্রমাণ মিলেছে গত অক্টোবরে ভয়েস অফ আমেরিকার (ভিওএ) করা একটি জরিপে। জরিপে অংশগ্রহণকারি ৬৪.১ শতাংশ মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই এই জরিপ সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে একটি চপেটাঘাত। এই জরিপ বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান করেনি। বিদেশি প্রতিষ্ঠান করেছে। ফলে এ নিয়ে প্রশ্ন থাকার কোনো অবকাশ নেই। বরং ভারতে কীভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, তা নিয়ে স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলা যায়। ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলমানরা নিপীড়ন-নির্যাতন, এমনকি খুনের শিকার হচ্ছে। শুধু মুসলমানই নয়, দেশটির খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আসামে খ্রিস্টিয়ান ফোরাম বলেছে, আসামে কয়েক বছর ধরে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। একেবারে খোলাখুলিভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ভিন্নমতকে জায়গা দেয়ার মতো বিষয়কে খারিজ করে দেয়া হচ্ছে।

বলাবাহুল্য, যার নিজের জামা ছেঁড়া, সে যদি অন্যের জামা ছেঁড়া নিয়ে কথা বলে, তখন একে দ্বিচারিতা বলা ছাড়া কি বলা যেতে পারে? আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘ভারতের নিজের মাটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ সেটা নিয়ে তাদের সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। ভারতের এই দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর। তিনি বলেছেন, আমরা নিজেরাও দেখেছি, ছাত্রসংগঠন, মাদরাসা, রাজনৈতিক দলসহ বাংলাদেশের মানুষ দুর্গাপূজার সময় কীভাবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় কাজ করেছে। সর্বশেষ চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যার পরও বাংলাদেশের মুসলমানরা অসীম সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন।’

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এটাই। এখানে হাজার বছর ধরে সব ধর্ম, বর্ণ ও ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী পারস্পরিক সহবস্থান ও সহমর্মী হয়েই বসবাস করছে। অথচ ভারত সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সে সংখ্যালঘুর মোড়কে শুধু হিন্দুদের নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে। অথচ হিন্দু ছাড়া এখানে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায় রয়েছে। বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের ওপর কোনো নির্যাতন হয়েছে, এমন একটি ঘটনা কি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে? বরং মোদির সেবাদাসী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে যে হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর, জমিজমা দখল হয়েছে, তা নিয়ে ভারতকে তো কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। এমনকি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিএনপির যে হাজার হাজার নেতাকর্মীর ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে, গুম, খুন, অপহরণ, জেলজুলুম করেছে, অরাজনৈতিক বিরোধীমতকে দমন করেছে, তা নিয়েও টুঁ শব্দ করেনি। কেন করেনি, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে তার পুতুল ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে অন্তর্জ্বালায় ভুগছে। এর প্রতিশোধ নিতেই হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে এবং তার সাথে মিলে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে যাচ্ছে। তার একটি সংখ্যালঘু হিন্দু কার্ড খেলা। সর্বশেষ ইসকনের চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মাচারীকে দিয়ে হিন্দু নির্যাতনের ধোঁয়া তুলে ষড়যন্ত্র করেছে। তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সরকার গ্রেফতার করলে ভারত যেন তেলেবেগুণে জ্বলে উঠেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন ভিত্তিহীন বক্তব্য-বিবৃতি ও অপপ্রচার চালাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে যে লাগাতার অপপ্রচার চালায় ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান ভুয়া প্রমাণ করে দিয়েছে। তারপরও ভারতের অপপ্রচার বন্ধ হয়নি। এখন ভারত সরকার স্বয়ং অপপ্রচারে নেমেছে। গত বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় দুই দিনব্যাপী জাতিসংঘের সংখ্যালঘুবিষয়ক ফোরামের ১৭তম অধিবেশনে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক মো. আরিফুল ইসলাম স্পষ্ট করে বলেছেন, গত ৫ আগস্টের পর দেশে সংঘটিত সহিংসতার পেছনে ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয় কাজ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের প্রায় সবাই মুসলিম। অল্প কিছু মানুষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছিলেন। তার এ বক্তব্য একদিকে যেমন ভারতের অপপ্রচারের জবাব, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলের জন্যও সুস্পষ্ট বার্তা। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, ভারত এক ব্যক্তির জন্য বাংলাদেশের সাথে বিরূপ আচরণ করছে। পর্যবেক্ষকরা ভারতের এ আচরণকে বাড়াবাড়ি বলছেন। তারা মনে করছেন, সে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের এবং জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কের চেয়ে ব্যক্তি সম্পর্ককে প্রাধান্য দিচ্ছে, যা অকূটনৈতিক সুলভ আচরণ ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। সে কি শুধু একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়, নাকি বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়, তা তাকেই বিবেচনা করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত