ঢাকা ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

একটি পতাকার জন্য

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
একটি পতাকার জন্য

‘স্বাধীনতা তুমি, রবি ঠাকুরের অঝোর কবিতা, অবিনাশী গান, স্বাধীনতা তুমি, কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো...।’ কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার বিভিন্ন স্বরূপের উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাধীনতা আসলে একটি স্বপ্ন। প্রতিটি পরাধীন মানুষের চোখে প্রথম স্বপ্ন থাকে একখণ্ড স্বাধীন ভূমির, একটি নিজস্ব পতাকার এবং নিজস্ব ভাষার অধিকার। পরাধীনতা একটি অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়। পৃথিবীতে বহু জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে যুদ্ধ করেছে এবং আজও করছে।

ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে বহু দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের যৌবন, কিশোরবেলা ছিল স্বাধীনতার জন্য। তারপর পশ্চিম পাকিস্তানের শ্যেন দৃষ্টি থেকে মুক্ত করে পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। পেয়েছি লাল-সবুজ পতাকা। একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল।

পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব করে। ভয়াবহতার হিসাব করে না। নৃশংস ও নির্মমতার দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়ংকর ছিল পাকিস্থানীদের গণহত্যা। নির্মম বা নৃশংস কোনো শব্দই এই নির্মমতা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে এক রাতেই রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছিল ঢাকা শহরে। একদিন পৃথিবীতে আমাদের সেই বীর মানুষ থাকবেন না। সময়ের সাথে সাথে আমরা তাদের হারিয়ে ফেলব। কিন্তু তাদের স্বপ্ন, তাদের দেখানো পথ আমাদের সামনে থাকবে। আমাদের মাঝেই তারা বেঁচে থাকবেন। স্বাধীনতা একটি স্পর্শমণি যা প্রত্যেকেই চায়। আমরাও চেয়েছিলাম। অনেক ত্যাগ, অনেক শ্রম আর বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলাদেশে গণহত্যা বইতে সিডনির শৈল চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস তার মতামতে বলেছেন, ধর্ষিতা মহিলাদের সংখ্যা সরকারি কর্মচারীদের হিসাবে আনুমানিক দুই লাখ হলেও তার মতে এ সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে।

তিনি মনে করেন এই সংখ্যা চার থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজারের মতো হতে পারে। তিনি আরো বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। এসব মহিলার অনেকেই যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন আবার অনেকেই বন্ধ্যাত্ব বরণ করেছেন। অনেক মহিলাকেই যুদ্ধের পর স্বামী ছেড়ে গেছে।

অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। সুতরাং পরিবার পরিজনহীন একাকী জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এসব বীরাঙ্গনাকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। তাদের প্রাপ্য নিশ্চিত করতে হবে। যেসব মানুষ আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিতে জীবন বাজী রেখেছেন তাদের কেউ কেউ আজও অবহেলিত।

দেশকে ভালোবেসে যাওয়াই তাদের একমাত্র সান্ত¦না। কিন্তু তাদের জন্য কিছু না করতে পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা চাই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যিনি এ দেশের জন্য রণাঙ্গনে জীবন বাজী রেখেছিলেন তিনি তার কর্মের স্বীকৃতি পাক। এসব মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তাকে তার সম্মান দেয়া হোক। তাদের ঋণের শোধ না হলেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা করাই যায়। ডিসেম্বর মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। আমাদের অস্তিত্তের স্বীকৃতির মাস। এ মাসেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নিয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণে দিশাহারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কবির ভাষায়- স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,/কে বাঁচিতে চায়?/দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,/ কে পরিবে পায়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী জন্ম থেকেই স্বাধীনতামুখী। প্রতিটি প্রাণী নিজ স্বাধীনতা অর্জনে বদ্ধপরিকর থাকে। আবার একশ্রেণির প্রাণী থাকে যারা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করেই শান্তি পায়। একশ্রেণি শোষণকারী অপরদিকে থাকে শোষিত শ্রেণি। যারা অধিকার আদায়ের লক্ষে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলে। যুগ যুগ ধরে এটি হয়ে আসছে। শোষিত শ্রেণি যখনই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে, সংগ্রাম করে তখনই তাদের উপর নেমে আসে জুলুমকারীদের খড়গ। কিন্তু একথা ঠিক যে স্বাধীনতা বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ হয় তীব্র এবং তা সব বাধা ভেঙে দেয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা।

বাঙালি জাতির মরণপন সংগ্রামের ফলেই এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এটা আমাদের চূড়ান্ত ত্যাগের প্রতীক। আমরা যারা এ প্রজন্মের তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু আমরা যতটুকু জেনেছি, তাতে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে আসে। সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নিতে আজকের প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জন্ম গ্রহণ করাটা যে কতটা সৌভাগ্যের তা শুধু স্বাধীন দেশে জন্ম নেয়া, বেড়ে ওঠা একটি শিশুই বলতে পারবে। যার একটি সুন্দর শৈশব থাকবে, যে নির্ভয়ে খেলা করবে, লেখাপড়া শিখবে। কারণ পৃথিবীতে আজ যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের নির্মম পরিণতি চোখের সামনে দেখছি। আমরা ফিলিস্থিনের সংগ্রাম দেখছি। এমনকি একটু বেঁচে থাকার স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগ্রামকে দেখছি। বহু জাতি বহু সংগ্রাম, যুদ্ধ, রক্ত, ইজ্জত, সম্পদ হারিয়েছে কেবল স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য। আমরাও করেছি। দীর্ঘ নয় মাস করেছি। রক্ত দিয়েছি, সম্পদ দিয়েছি, ইজ্জত দিয়েছি। সব দিয়েছি শুধুমাত্র দেশ স্বাধীন করার জন্য। দেশ স্বাধীন মানে আমাদের নিজস্বতা অর্জন করা। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে। ছোটবেলায় ব্যাকরণ বইয়ের ভাব সম্প্রসারণে পড়েছি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু তখন এর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। কথাটির গভীরতা এখন বুঝতে পারি। স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা ধরে রাখা এবং মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের দেশে পরিণত করাটাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। কতটা চ্যালেঞ্জের তা আমরা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বুঝতে পারি। কারণ প্রতি পদক্ষেপে বাধা আসবে।

একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য দরকার ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, জনগণ ও সরকার। কিন্তু সেই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত হওয়া। আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য আজ বাধাগ্রস্ত করছে অসৎ মানুষদের অসৎ মনোভাব। ধর্মীয় সম্প্রতির এক অনন্য উদাহরেণর নাম বাংলাদেশ। সেই আদিকাল থেকেই এদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান পাশাপাশি হাত ধরে বসবাস করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকেও একই পতাকার নিচে আমরা সবাই আজ বসবাস করছি। আমরা চাই না এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঘিরে ফেলুক। সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে। স্বাধীনতার এটিও উদ্দেশ্য। দেশ নিয়ে একটি কথা আমাকে খুব টানে। সেটি হলো দেশ তোমাকে কি দিয়েছে তা বড় কথা নয়, তুমি দেশকে কি দিতে পেরেছ সেটিই বড় কথা।

সত্যি তো, স্বাধীনতার তো বহু বছর পার হয়ে গেল। কি দিতে পেরেছি দেশটাকে? কতটুকুই বা দিতে পেরেছি। দেশের কাছে এটি চাই ওটি চাই; কিন্তু আমি কী দিচ্ছি। দেশটি তো আমাদের। আমরা ছাড়া কেউ বা দেশের জন্য ভাববে? আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের একটি লাল সবুজ পতাকা আছে। সেই পতাকা আমাদের অহংকার। আমরা চাই দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য যারা সর্বস্ব বাজী রেখেছিলেন তারা যেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পান। তারা বেঁচে থাক আমাদের মধ্যে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। কবির ভাষায়, তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি। এই লাল সবুজ পতাকা যেন আমরা মর্যাদার সাথে, গৌরবের সাথে চিরকাল, আত্মমর্যাদার সাথে ধরে রাখতে পারি সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আমাদের করতে হবে।

স্বাধীনতা শব্দটির ভেতর রয়েছে আমাদের বলার স্বাধীনতা, চলার স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ইত্যাদি। কিন্তু এই শব্দের ব্যবহার অর্থ এই নয় যে আপনি যাকে যা ইচ্ছা বলতে পারেন, আপনার কথার দ্বারা কাউকে ছোটো করতে পারেন। এটি স্বাধীনতা নয়। বরং স্বাধীনতা কাউকে সম্মান করার শিক্ষাই দেয়। যা ইচ্ছা তাই করা স্বাধীনতা নয়। আপনার কথা এবং কাজ যেন কাউকে কষ্ট না দেয়, অধিকারের নামে যেন অতিরঞ্জিত আচরণ না হয় ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের মেনে চলতে হবে। স্বাধীনতার অর্থ আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের ব্যবহার করতে হবে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আমাদের দেশের যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল আমরা সেখানে পৌঁছাতে সক্ষম হইনি। কারণ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া একটি দেশের মানুষ কেন দুর্নীতিপরায়ণ হবে সে কথা মাথায় আসে না। দেশপ্রেম না থাকলেই দেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজ করতে পারে। দেশপ্রেমটাই আসল। দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে, স্বাধীনতার অর্জন যেন ম্লান না হয়, সেজন্য সবাইকে একসাথে সঠিকপথে থেকে কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত