ঢাকা ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভারত বলয় থেকে বের হতে কূটনীতিতে দরকার নতুন কৌশল

মাহমুদ সালেহীন খান
ভারত বলয় থেকে বের হতে কূটনীতিতে দরকার নতুন কৌশল

গত আগস্টে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে তার অব্যাহত উপস্থিতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও মোদি সরকারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনটি গত ২৮ নভেম্বর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, একসময়ের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কয়েক মাস ধরে ফুঁসতে থাকা উত্তেজনা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। বাংলাদেশে একজন হিন্দু পুরোহিতকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর দুই প্রতিবেশী পরস্পরের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ তুলেছে।

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, হাসিনা ভারতে বসে ক্ষমতায় ফিরে আসার ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও তুলেছেন, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে ভারত।

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনার সবশেষ স্ফুলিঙ্গ ছিল চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনা। তিনি বাংলাদেশের একজন হিন্দু পুরোহিত। ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ১০ শতাংশের কম। অতীতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস একটি প্রভাবশালী বৈশ্বিক হিন্দু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সংগঠনটির নাম ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব কৃষ্ণ কনসায়নেস, যা ইসকন বা হরে কৃষ্ণ সোসাইটি নামেও পরিচিত। (বতর্মানে চিন্ময় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পু-রীক ধামের অধ্যক্ষ)।

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের একটি আদালত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মামলায় বিচার-পূর্ব কারাগারে পাঠিয়েছেন। এর আগে স্থানীয় একজন রাজনীতিবিদ অভিযোগ (কোতোয়ালি থানায়) দায়ের করেছেন, হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করেছেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে নিচে রেখে উপরে রেখেছিলেন গেরুয়া রঙের পতাকা (হিন্দুধর্মের প্রতীক)।

এই ঘটনার পর ভারতে কলকাতায় এবং আগড়তলায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শাখায় হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পর দুবার বাংলাদেশের দূতাবাসে হামলার ঘটনায় ঢাকার পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হয়ছে। এবং ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে তলব করে নেয়া হয়েছে। প্রণয় ভার্মা বলেছেন একটি ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না।

বাংলাদেশ তিন দিকে ভারতবেষ্টিত এবং এক দিকে বার্মা। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। আমাদের দেশটি ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। ভারত মোটেও কোনো ভালো বন্ধু দেশ নয়; ভারতের সঙ্গে তার কোনো প্রতিবেশীরই সুসম্পর্ক নেই এবং তার একমাত্র কারণ ভারতের আগ্রাসী ও বড় ভাইসুলভ পররাষ্ট্রনীতি।

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’, এটা কোনো কৌশলী কথা হতে পারে না। কুটনীতি করতে হবে মেধা এবং কুটনৈতিক ভাষা দিয়ে। শত্রুর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কৌশলী কথা বলাটাই হচ্ছে কুটনীতি। আবার বন্ধু বা শত্রু স্থায়ী নয় কখনোই। আজ যে বন্ধু, কাল সে তার স্বার্থে আমার শত্রু হবে না, এটা শুধুমাত্র বোকারাই ভাবতে পারে। কুটনীতিতে বোকামির কোনো স্থান হবে না। আমাদের প্রতিবেশীদেশগুলো বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার এবং নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান এবং চায়নার সঙ্গে একটি কুটনীতিক রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। কার সঙ্গে আমরা কীভাবে স্বার্থ আদায় এবং রক্ষা করবো তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। সকলের সঙ্গে একভাষায় কথা বলা যাবে না। ভারত ও মিয়ানমার আমাদের সরাসরি ক্ষতি করতে পারবে কিন্তু অন্য দেশগুলোর সে সুযোগ অনেক কম। সুতরাং আমাদের চিন্তাও টেকসই হতে হবে। একদিকে আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে দেশদুটির সঙ্গে সর্বোচ্চ সুসম্পর্ক রাখা। কিন্তু ভারত বা মিয়ানমার যদি সুসম্পর্ক না চায়, তখন আমাদেরও বিকল্প ঠিক রাখতে হবে। সবসময় আমাদের একটিভ প্লান-বি এবং প্লান-সি নিয়ে তৈরি থাকতে হবে।

আমাদের অর্থনীতি, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, আমাদের প্রতিরক্ষানীতি শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। ভারত কোনোকালেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে নাই; তারা শুধুই একতরফাভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে নোংরা মানসিকতা দেখিয়ে গেছে। এটা প্রতিহত করতে হবে। আর তা প্রতিহত করার জন্য আমাদের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রয়োজন হবে, নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের আমেরিকার সঙ্গে কথা বলতে হবে; আমেরিকা যদিও ভারত বাংলাদেশে কোনোদিন আক্রমণ করবে না এবং আক্রমণ করলেও আমেরিকা তা প্রতিহত করবে এমন কোনো চুক্তিতে রাজি থাকে তাহলে আমরা আমেরিকাকে প্রাইওরিটি দিয়ে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করবো। আমেরিকা যদি আমাদের ভারতের চোখ দিয়ে দেখতে চায় বা আমাদের নিরাপত্তা গ্যারান্টি না দেয় বা ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্ব দেয়; তাহলে আমাদের সঙ্গে আমেরিকার কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রয়োজন নেই। সেক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তান এবং চায়নার সঙ্গে একটি সামরিক জোট তৈরির চিন্তা করবো।

যে ত্রিদেশীয় সামরিক জোটটি হবে অনেকটা নেটোর আদলে। অর্থাৎ আমাদের কোনো একটি দেশকে যদি ভারত আক্রমণ করে তাহলে আমরা সেটাকে তিন দেশের উপরই ভারতের আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করবো এবং তিন দেশ মিলে সম্মিলিতভাবে ভারতকে প্রতিহত করবো। ভারতকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এরপরই আমরা আমাদের অভিন্ন নদীগুলোর পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবো। ভারত যদি তারপরও আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে রাজি না হয় সেক্ষেত্রে আমরা তাদের অবৈধ ব্যারেজগুলো শক্তি প্রয়োগ করে উড়িয়ে দিবো। আমাদের ন্যায্য হিস্যা আমরা আদায় করে নিবো যে কোনো মূল্যে। প্রয়োজনে আমরা ত্রিদেশীয় সামরিক চুক্তির আওতায় ভারতের সঙ্গে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করবো। ভারতকে খবরদারি থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য করবো। আলোচ্য ‘ত্রিদেশীয় সামরিক চুক্তি’টি আমাদের একটি শক্তিশালী হাতিয়ারের কাজে দিবে। ভারতকে দেয়া বর্তমান ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের চুক্তিগুলো আমাদের বাতিল করতে হবে। ভারতকে আমরা ট্রানজিট দিতে রাজি হবো, তবে সেজন্য ভারতের থেকে কিছু জরুরি বিষয় আদায় করে তার বিনিময়ে ট্রানজিসহ অন্যান্য সুযোগগুলো দিবো।

যেমন: প্রথম কাজ হবে ভারতকে সবগুলো অভিন্ন নদীতে আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করতে হবে। এটি নিশ্চিত হলে তারপর আমরা ভারতের সঙ্গে অন্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় বসবো। সকল একতরফা বাঁধ বা ব্যারাজ অপসারণ করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করার আগে ভারতকে কোনো সুবিধা দেবার প্রশ্নই আসবে না। ভারতকে আমরা হিলি থেকে আগরতলা পর্যন্ত সড়ক ‘প্যাসেঞ্জার বাস ও কার ট্রানজিট’ দিবো, কিন্তু সেজন্য প্রথমত উপযুক্ত টোল আদায় করবো, তাদের গাড়িগুলো চেক করবো তাতে কী যাচ্ছে। এবং বিনিময়ে ভারতকে পঞ্চগড় থেকে চিকেন নেক-এর নিচ দিয়ে (সাবওয়ে) নেপালের কাঁকরভিটা পর্যন্ত ৪ লেনের সড়ক এবং ১ লেনের রেল রোড ব্যবহারের জন্য ‘সাবওয়ে করিডোর’ প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ ওই ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সাবওয়ে করিডোর দিলেই আমরা ভারতকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা দিবো। ওই সাবওয়ে করিডোর দিয়ে আমাদের দেশের গাড়ি, ট্রেন নেপালে যাতায়াত করবে। ভারত কোনো খবরদারি করতে পারবে না। ভারত আমাদের সাবওয়ে করিডোর না দিলে আমরা ভারতকে কোনো ট্রানজিট সুবিধা দিবো না। ভারতকে আমরা আমাদের উপর দিয়ে মালামাল পরিবহন করতে দিবো, সেই ট্রানজিট আমরা দিবো, কিন্তু সেজন্য ভারতকে তাদের আগরতলা এয়ারপোর্ট আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে।

অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব একটি ট্রার্মিনাল করে দিবে যা দিয়ে বাংলাদেশের যাত্রীরা আগরতলা এয়ারপোর্ট ব্যবহার করবে; আমাদের বিমানগুলো আগরতলা এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাই করতে পারবে। ভারতকে আমরা আমাদের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে দিবো; বিনিময়ে আমাদের ভুটানের সঙ্গে সড়কপথে শেয়ার করিডোর দিতে হবে যেন আমাদের গাড়িগুলো ভুটানে অবাধে যাতায়াত করতে পারে। কমনওয়েলথ থেকে বের হয়ে আসতে হবে আমাদের। কমনওয়েলথ বাস্তবে বাংলাদেশের একটি সরকারি পিকনিক পার্টির বাইরে কোনো কাজে আসে না। আমাদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে কমনওয়েলথ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ব্রিটেনের সঙ্গে আমার সুবন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ থাকবে। বিদেশে আমাদের হাই কমিশনগুলোকে ‘অ্যাম্বাসি’তে উন্নিত করতে হবে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে আমাদের বহুমুখী সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এমন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে যেন অত্যন্ত অল্প খরচে দেশদুটিতে ভ্রমণ করা যায়। থাইল্যান্ডে চিকিৎসাসেবা অত্যন্ত উন্নত এবং ব্যয়বহুল নয়। ভারতমুখী প্রবণতা থেকে বের হয়ে আমাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন পর্যন্ত থাইমুখী হতে হবে এবং দেশের চিকিৎসাসেবা উন্নতকরণের দিকে সুদৃষ্টি দিতে হবে।

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত