স্ত্রীর জীবনে স্বামী আলোকবর্তিকা হিসেবে এখনো বিরাজমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ সংসার, সন্তান, পরিবার, সহায় সম্পদের অভিভাবক হিসেবে কাজ করছে। অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যর্থতা কিংবা বাড়াবাড়ি থাকে ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রাগ ক্ষোভের জন্ম হয়। রাগ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সাধারণত স্ত্রীর মাধ্যমে হয়ে থাকে। পরিবারের ভালো-মন্দ নিয়ে স্বামীর সাথে দরকষাকষি স্ত্রীকেই করতে দেখা যায়। স্বামী বার্ধক্যে পৌঁছে গেলে সংসার পরিবারের কর্তৃত্ব, খবরদারি দুর্বল হতে থাকে। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে যায়। তারাই বেশিরভাগ সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্বামীর ব্যর্থতা, অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা, সিদ্ধান্ত হীনতা স্ত্রীকে বিচলিত করে তোলে। স্বামীর সফলতা, সহায় সম্পদ স্ত্রীকে নিরাপদ ভবিষ্যতের প্রতি আস্থাশীল হতে সাহায্য করে। আবার স্বামীর ব্যর্থতা এবং সহায় সম্পদের অভাব স্ত্রীকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশাহারা হয়ে ওঠে। প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে স্বামী দিন দিন স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল হতে থাকে। চিকিৎসা, সেবা যত্ন, ওষুধ পত্র, খাবার দাবারসহ যাবতীয় কাজে স্ত্রীর মতামতকে প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। অনেক ‘বাঘ’ স্বামী বিড়ালে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। শারীরিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল হতে থাকলে স্বামী বেচারা নানা রকমের অবহেলার শিকার হন। যেসব স্বামী যৌবনে ঘুষ দুর্নীতি, অনাচার, পরকীয়া, স্বজনপ্রীতি, মাদক সেবনে লিপ্ত ছিলেন তারা সকল সময়ই সমাজে নানাভাবে সমালোচিত হন। তাদের অর্জিত সহায় সম্পদকে সাধারণ মানুষ ভয় এবং ঘৃণার চোখে দেখে। সমাজে এদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে থাকায় স্ত্রীর কাছে আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। স্ত্রীর নামে বাড়ি ঘর, জমি জমা, সঞ্চয়পত্র, স্থায়ী আমানত, ব্যবসা বাণিজ্যর কিছু অংশ দিতে দেখা যায়। স্ত্রীর অসুস্থতায় স্বামী বেশি উদগ্রীব হয়ে পড়েন। স্ত্রীর চিকিৎসা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে দেখা যায়। ছেলে-মেয়ে আত্মীয়-স্বজনকে স্ত্রীর অসুস্থতার সংবাদ জানিয়ে সহযোগিতা ও দোয়া কামনা করেন। যারা সারা জীবন স্ত্রীর প্রতি সঠিক ভূমিকা পালন করেননি কিংবা সুযোগ পাননি তাদের মধ্যে একধরনের অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায়। সেই অনুশোচনা থেকে কেউ কেউ স্ত্রীর প্রতি দরদী হয়ে ওঠেন। মনে মনে স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেন কি না এমন স্বামী সম্পর্কে অবহিত নই। সামর্থ্যবান স্বামীরা জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী জাঁকজমকভাবে পালনে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। মুখ খুলে না বললেও সন্তান সন্ততিদের এমন আয়োজন দারুণভাবে উপভোগ করেন। স্ত্রীকে উপহার দিয়ে এবং নিজে উপহার পেয়ে খুশী হন। যৌবনে নষ্ট হওয়া মানুষ এসে কামেল কিংবা মহাপুরুষ হয়ে যায় না। অপরাধ করা মন সহজে বশ মানে না সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই নষ্ট হওয়া মুখোশধারী স্বামী তার স্ত্রীকে নানা রকমের যন্ত্রণায় ফেলে জীবন অতিষ্ঠ করে দেয়। এসব কারণে অনেক সময় স্ত্রীরা স্বামীকে কঠিন নজরদারিতে রাখেন। যে কোনো ধরনের নজরদারি স্বামীদের দারুণ অপছন্দের একটি কাজ। নজরদারি, জবাবদিহিতা, মরাল পুলিশিং স্বামীকে আগ্রাসী ভূমিকায় নিয়ে যায়। কোনো কোনো স্বামী নিজেকে সকল সামাজিক কাজ থেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। অনেকে ধর্ম কর্ম নিয়ে মনোযোগী হয়ে ওঠে। পৃথিবীর প্রতি তেমন একটা আকর্ষণ বোধ করে না। কেউ কেউ চিকিৎসা নিতে এবং ওষুধপত্র সেবনে আগ্রহী হন না বরং মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে। কিছু কিছু স্বামী নিজের সকল অক্ষমতার দায়ভার স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দেয়। স্ত্রীর প্রতি অশোভন আচরণ, অবহেলা করে প্রতিশোধ নিতে চায়। তারা মনে করেন সংসারে যে সহায়-সম্পদ অর্জন করেছেন সেই সম্পদ দিয়ে সবার জীবনযাপন সহজ হয়েছে অথচ তার নিজের জীবনই বেশি কষ্টের মধ্যে পড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েরা মায়ের পক্ষ নেয় কিংবা সমর্থন করে ফলে স্বামীর রাগ ক্ষোভ স্ত্রীকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। কখনো কখনো অসহায় স্বামীকে স্ত্রীর আয় রোজগারের উপর জীবন নির্বাহ করতে দেখা যায়। প্রবীণ স্বামীকে স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে ভিক্ষা করার এমন দৃশ্যও মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
লেখক : কলামিস্ট