বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের মধ্যে দ্বিমত বা মতভিন্নতা থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য ছাড়া উত্তরণ সম্ভব নয়। পতিত স্বৈরাচার বিগত ১৬ বছর ধরে দেশে একটি রাজনৈতিক বিভাজন ও ভিন্নমতের রাজনৈতিক শক্তিকে দমন-নির্মূলের মধ্য দিয়ে একটি চরম মাফিয়াতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। আর এই ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ছিল ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শাসকরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের আগেই দেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল। তা নাহলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে সব বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিনত করে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার নির্দেশ দেয়ার পরও দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করতে মানুষ এভাবে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়তো না। তবে ভারতের আধিপত্যবাদী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক ও দোসররা বসে নেই।
৫ আগস্টের পর থেকেই তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য নানা ধরণের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক বিভিন্ন সংস্থা ও সেক্টরের মানুষকে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব, শাহবাগ, সচিবালয় দখলের ধারাবাহিক তৎপরতা সরকার এবং ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি একাধিক গেমপ্ল্যান নিয়ে কাজ করছে, একটি প্ল্যান ব্যর্থ হলে পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় রাষ্ট্রশক্তি এখন সরাসরি বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে। গত ১৬ বছর ধরে ভারত সরকার ও বাংলাদেশে তার তাঁবেদার সরকার দুই দেশের কথিত বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতার কথা বলেছে। তবে দুই দেশের বাণিজ্য, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারিত্বের সিদ্ধান্তগুলো মূলত ভারতীয় স্বার্থেই গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের চেয়ে শেখ হাসিনার পরিবার ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখতেই সবকিছু করেছে ভারত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের অভিপ্রায় ও স্বার্থই হয়ে উঠেছে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উপর ভারত তার আধিপত্যবাদী অবৈধ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। পতিত স্বৈরাচারকে ক্ষমতায় পুনর্বাসিত করা অসম্ভব হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সংষ্কার কার্যক্রম নস্যাৎ করে পুরোনো বন্দোবস্ত ও রাজনৈতিক বিভেদ টিকিয়ে রাখতেই এখন ভারত আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ইসকন, সনাতন জাগরণ মঞ্চ, হিন্দু মহাজোট, হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদকে দিয়ে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা বয়ান ছড়িয়ে বাজিমাৎ করতে চাচ্ছে। বিশ্বের কাছে ভুল তথ্য প্রচার করার সাথে সাথে ভারতের বিজেপি সরকারকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য সে দেশের বিরোধীদল জাতীয় কংগ্রেসসহ বিভিন্ন দল অভিন্ন সুরে উস্কানিমূলক প্রস্তাব হাজির করছে। তাদের উস্কানিতে এরই মধ্যে কলকাতা ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের অফিসগুলোতে হিন্দু জঙ্গিরা আক্রমণ চালিয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা ও পোড়ানো হয়েছে।
উগ্রবাদীরা বাংলাদেশের সিলেট, ফেনি ও পেট্রাপোল অভিমুখে লংমার্চ করেছে। ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে বল্গাহীন অপপ্রচারের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয়দের লাগামহীন হুমকি ও অপতথ্য প্রচার চলছে। তাঁবেদার স্বৈরাচার হাসিনার পতনের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে স্বাভাবিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও আচরণ বজায় রাখতে পারছে না তারা। বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভারতীয় রাজনৈতিক স্বার্থের বলি বানাতে চাচ্ছে তারা। বাংলাদেশের হিন্দুদের সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, যে কোনো বহিঃশক্তির হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যে তারাও অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতের কোনো নিরাপত্তা হুমকি না থাকলেও শুধুমাত্র অনৈতিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে ভারতের সব রাজনৈতিক পক্ষ এক সুরে কথা বলছে। এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশকে তার জাতীয় ঐক্য আরো সুদৃঢ় ও সুসংহত করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষত অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলতে যে ধরনের অপপ্রচার, চাপ ও হুমকি দেয়া হচ্ছে, তা মোকাবিলায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে ক্ষুদ্র স্বার্থ, রাজনৈতিক মতভিন্নতা ভুলে গিয়ে একটি ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের বিচার, নির্বাচন ও সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতভেদ সরকারের অবস্থানকে দুর্বল করে দিতে পারে। যে কোনো দেশের হাইকমিশন বা দূতাবাস সে দেশের সার্বভৌমত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন আক্রমণ এবং বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো ও অবমাননার ঘটনা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়া জঙ্গি হিন্দুদের এমন ঔদ্ধত্য প্রদর্শন সম্ভব নয়। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ভারত সরকারের অবস্থান ও প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রকাশ পেয়েছে। এহেন বাস্তবতায় যে কোনো ধরনের ভারতীয় হুমকি ও আগ্রাসন মোকাবিলায় দেশের সব রাজনৈতিক শক্তিকে একটি অভিন্ন অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। গত ৪ মাসে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে কিছু মতভেদ ঘটলেও দিল্লির হুমকি ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। দেশের সব জেলা ও বিভাগীয় শহরে হাজার হাজার মানুষ ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করছেন, তার এই উদ্যোগ সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয়। সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র নস্যাৎ এবং জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করাই এই সংলাপের মূল লক্ষ্য। ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে অনুধাবন ও সমর্থন করতে না পারলেও ভারতের উচিত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণবিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করা। সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবেলায় আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্যের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বোঝাপড়া ও সুসম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে। আন্তঃসীমান্ত বানিজ্য বন্ধের হুমকি মোকাবিলায় চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ আঞ্চলিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব বাড়ানোর ত্বরিৎ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।