গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে দেশটির মিডিয়ার যে ভূমিকা তা কোনোভাবেই সৎ প্রতিবেশীসুলভ বলা যায় না। ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো ঘিরে দেশটির হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর আক্রমণাত্মক বিক্ষোভ, বাংলাদেশ অভিমুখে লংমার্চ ও সবশেষ ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ন্যক্কারজনক হামলা, ভাঙচুর ও জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ বাংলাদেশের প্রতি দেশটির চরম আগ্রাসী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আমরা খুব করে লক্ষ করছি, বাংলাদেশের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তন ভারত সরকার মেনে নিতে পারেনি; বরং ভারতের নানা মহল থেকে এই গণঅভ্যুত্থানকে ভুলভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘ভারতের উচিত দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থান এবং ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেয়া। এটি দিয়েই শুরু করতে হবে। ভারতীয় সংস্থা জুলাই বিপ্লবকে কিছু জঙ্গি, হিন্দুবিরোধী এবং ইসলামপন্থিদের ক্ষমতা দখল হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে।’
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। প্রফেসর ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে টেলিফোনে কথা বলার সময়ও বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টি তুলে তাদের সুরক্ষার আহ্বান জানান মোদি। একই সাথে ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতন নিয়ে উদ্ভট ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে এমনই অপপ্রচার চালিয়েছে যা অতীতে খুব কমই দেখা গেছে। আলজাজিরার মতো সংবাদমাধ্যমও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া গুজব ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিস একটি জরিপ করেছে। জরিপে বলা হয়- বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। মাত্র ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য আগের চেয়ে খারাপ নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন, পরিস্থিতি আগের মতোই আছে।
বস্তুত, বিগত প্রায় ১৬ বছরে আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ভারত বাংলাদেশের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনোজগতে যে বাধাহীন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল, শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে তারও পতনের শুভসূচনা হয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এক ধরনের বৈরী, বিদ্বেষপূর্ণ ও আগ্রাসী মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের এমন আচরণের বিপরীতে বাংলাদেশ বরাবরই শান্ত থেকেছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করেছেন। এটি খুবই জরুরি একটি উদ্যোগ। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থে জাতীয় ঐক্য সুসংহত করার বিকল্প নেই।