নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনকে একজন সমাজ সংস্কারকও বলা হয়। মূলত তিনি একজন খ্যাতিমান লেখক, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের নির্মম, নিষ্ঠুরতা, অধর্ম, অবিচার ও কুসংস্কারে জর্জরিত ও অশিক্ষিত নারী সমাজকে তিনি আলোর পথ দেখিয়েছেন। বিপরীতে পুরুষশাসিত সমাজে ধর্মীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকে অনেকভাবে রোকেয়াকে উপস্থাপন করেছেন; এখনো করছেন। আজও রোকেয়ার দর্শনকে ঘিরে পক্ষ-বিপক্ষ আলোচনা-সমালোচনা বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে তার দর্শন পুরোপুরি না বুঝে এক পক্ষ তার ঘোরতর সমালোচনা করেন। আরেক পক্ষ তার সামগ্রিক দর্শনকে বিশ্লেষণ না করেই আংশিকভাবে তাকে উপস্থাপন করেন। উভয়পক্ষই বেগম রোকেয়ার জীবন দর্শন ও সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে এককেন্দ্রিক পর্যালোচনা করে আসছেন। তার লেখায় নারী শিক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ, তিনি নিজের ভাই-বোনকে দিয়েই এটি প্রথমে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
রোকেয়ার বাবা একজন শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। তার বড় দুই ভাই কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু তার তিন বোনই শিক্ষালাভে বঞ্চিত ছিলেন। বাড়িতে প্রাথমিক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করলেও ভাইদের মতোকরে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তারা পাননি। কারণ তৎকালীন বাস্তবতায় প্রায় সকল সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর মেয়েরা ঘরের বাইরে কম বের হতো। বাড়ির ভেতরেই তারা বেশি থাকত। ফলে আধুনিক কিংবা উচ্চ শিক্ষালাভে বঞ্চিত হতো। এটা যে শুধু মুসলিম পরিবারে তাও কিন্তু নয়; হিন্দু পরিবারেও একই অবস্থা ছিল। হিন্দু বা মুসলমানকে উদ্দেশ্য না করে অভিজাত বংশের মহিলা সম্পর্কে রোকেয়া নিজেই বলেছেন, ‘যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেচকের মতো লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশি শরীফ’। বেগম রোকেয়ার এই কথায় ‘পর্দা’ শব্দটি উল্লেখ থাকার কারণেই হয়তো রোকেয়াকে ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে বলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কিন্তু তৎকালীন সমাজব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র ছিল যে, অভিজাত পরিবারগুলোর মহিলারা ঘরের ভেতরে থাকবে। পুরুষরা ঘরের বাইরে কাজকর্ম করবে। সকল ধর্মের লোকজনের দৃষ্টিভঙ্গিতেই কম-বেশি এমনটি ছিল। এটা হতে পারে তৎকালীন ধর্মীয় কুসংস্কার কিংবা পুরুষশাসিত শাসকগোষ্ঠীর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
পর্দার নামে অবরোধ প্রথা নিয়ে যেসব কুসংস্কার বা অপসংস্কৃতি তৎকালে প্রচলিত ছিল, তা বেগম রোকেয়া চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন তার ‘অবরোধ-বাসিনী’ গ্রন্থে। তিনি নারীদের বুঝাতে চেয়েছেন যে, পর্দা সম্বন্ধে তাদের প্রচলিত রীতিগুলো এক ধরনের অশিক্ষা বা ধমীয় কুসংস্কার। গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘এক বাড়িতে আগুন লাগল, গ্রামের মানুষ আগুন নিভাতে এসেছেদ কিন্তু গৃহিণী ঘর থেকে বের হলেন না, কারণ এতে তার পর্দা ছুটে যাবে। ফলে তিনি পুড়েই মারা গেলেন’।
বেগম রোকেয়া শুধু নারীদের পর্দা নিয়ে নয়, তিনি সমাজের নানা অধর্ম ও কুসংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, ধর্মেও অধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ‘বিধবা হবে’ এমন ভয় (কুসংস্কার) দেখিয়ে হিন্দু অভিজাত পরিবারেও নারীশিক্ষা প্রায় বন্ধ ছিল।
ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়ে বেগম রোকেয়া গুরুত্বারোপ করে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ম শিক্ষায় উৎসাহ যুগিয়েছেন। পবিত্র কোরান শুধু তোতা পাখীর মতো করে নয় বরং কোরআনের অর্থ বুঝে পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন তিনি। ইসলাম ধর্মেও পবিত্র কোরআন পাঠের ফজিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোরআন শরীফ শুধু তেলাওয়াত করার চেয়ে অর্থসহ পাঠ করলে বেশি সওয়াব হাসিল হবে। তিনি ইসলাম ধর্মের ইতিবাঁচক একটি দিক নিয়ে সংবাদণ্ডসাময়িকীতে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, এই বিশাল জগতে কোনো দেশ, কোনো জাতি, কোনো ধর্ম নারীকে কিছুমাত্র অধিকার দান দূরে থাকুক, নারীর আত্মাকেও স্বীকার করেননি। একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে তাহার প্রাপ্য অধিকার দান করিয়াছে। রোকেয়া অন্য একটি লেখায় বলেছেন, ‘কোনো জাতি কন্যাকেও সম্পত্তির ভাগ দেননি, ইসলাম কন্যাকে পৈত্রিক সম্পত্তিতে ভ্রাতার অর্ধেক অংশ ভাগিনী করিয়াছে। মুসলিম স্ত্রী নিজের সম্পত্তি স্বাচ্ছ্যন্দে ভোগ করিবার অধিকারিণী’।
পৈত্রিক নিবাসে পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় বেগম রোকেয়া ইসলাম সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বলেই ‘ইসলাম’ নামে লেখা তার একটি প্রবন্ধও আছে। সেই প্রবন্ধে তিনি ইসলামের ইতিহাস, আরবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সংগ্রামী জীবনে পাশে দাঁড়ানো তার স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর ভূমিকা কী ছিল? তা তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। প্রবন্ধে ইসলাম সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট কিছু ধারণা পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কেহ কখনও শুনে নাই, তিনি প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করিয়াছেন। তিনি সর্বদা বিপদগ্রস্থের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকিতেন, বিধবা ও পিতৃহীন শিশুদের সান্ত¡না ও প্রবোধ দান তাহার নিত্যকর্ম ছিল। প্রতিবেশীবর্গ তাহাকে ‘আল আমীন’ বিশ্বস্ত বলিয়া ডাকিত। তিনি যেভাবে আত্মণ্ডবিস্মৃত হইয়া ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ঈশ্বর-অনুসন্ধান করিতেন, তাহা বর্ণনা করিবার উপযুক্ত ভাষা দুর্লভ; অথবা ইহার মর্ম শুধু তাহারাই বুঝিতে পারেন, যাহারা একাগ্রচিত্তে খোদার পথে আত্মসর্মপণ করিয়াছেন’।
ইসলামের বিধান হলো সকল নারী ও পুরুষের ওপর বিদ্যা অর্জন করা ফরজ। এখানে নারীকে কম বিদ্যা বা পুরুষকে বেশি বিদ্যা অর্জনের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়নি। অথচ, তৎকালীন সমাজে নারীরা পর্দার নামে এক ধরণের ঘরবন্দি থাকার কারণে প্রকৃত বিদ্যার্জন থেকে বঞ্চিত থাকতেন। রোকেয়ার জন্মের পূর্বে নারী শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ফ্রান্সের রাজা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেবো।’
রোকেয়ার সারা জীবনের আন্দোলন-সংগ্রামের বেশিরভাগই নারীদের লেখা-পড়া নিয়ে। তিনি নারী শিক্ষার জন্য নিজেই একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়ত্রীর দায়িত্বও তিনি পালন করেন। মজার বিষয় হলো, তিনি শুধু মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজে এক ধরনের ধারণা ছিল* নারীদের জন্ম হয় গৃহকোণে কাজ করার জন্য। নারীরা লেখাপড়া করে কী করবে? প্রচলিত এই ধ্যান-ধারণার বিপরীতে রোকেয়া নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলে পুরুষদের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন যে, পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও সমান অধিকার আছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরুপে? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে খোড়াইয়া খোড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্যে বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।’ নারী সমাজের জাগরণে উৎসাহ দিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ভাগিনীরা! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বলো ভাগিনী! আমরা আসবাব নই; বলো কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ!’
নারী সমাজকে সুসংগঠিত করতে আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতীনে ইসলাম নামে ১৯১৬ সালে তিনি একটি নারী সমিতি গঠন করেছিলেন। এই সমিতিকে নিখিল বঙ্গ মুসলিম সমিতি নামেও অভিহিত করা হতো। সেই সমিতির মাধ্যমে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থনীতি, সমাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্যে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে নারী সমাজকে সুসংগঠিত করেন।
বেগম রোকেয়া বিজ্ঞানেও ভালো জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, তার স্বামীর সাহচর্যেই তিনি বিজ্ঞানবিষয়ে ভালো জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ ‘সুলতানার স্বপ্নে’ বিজ্ঞানবিষয়ে ভালো ধারণা পাওয়া যায়। রোকেয়া জানতেন, বিজ্ঞানের চর্চা উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি।
সমাজ সংস্কার সংগ্রামে তিনি সারা জীবন সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তিনি বাল্য বিয়ে, অবসর জীবনে করনীয়, শরীর চর্চা, বিজ্ঞান, ধর্ম, সমাজনীতি ও অর্থনীতিসহ সমাজের প্রত্যেক বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। বলতে গেলে তার জীবন কেটেছে সমাজ সংস্কারের বিপ্লবে। কারণ, তার সময়ে বাল্যবিয়ে, বহু বিয়ে ও যৌতুকপ্রথা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজে বেশ প্রচলন ছিল। তবে বাল্যবিয়ে, অসমবয়সী বিয়ে ও বহুবিবাহ প্রবনতা হিন্দু সমাজ অপেক্ষা মুসলিম সমাজে বেশি ছিলো। যা তার লেখায় স্পষ্ট হয়েছে। রোকেয়া নিজেই লিখেছেন, ‘হিন্দুরা বাল্যবিবাহ রহিত করিবার জন্য আইন প্রণয়ন করিতেছেন। কন্যার বিবাহের বয়স ১৬ বছর বলিয়া ধার্য করিবার চেষ্টা করিতেছেন (যদিও সে জন্য পণ্ডিতরা উচ্চস্বরে তাহাদিগকে ‘অ-হিন্দু’ বলিতেছেন)। আর আমাদের সমাজে দেখিতে পাই, টেলিগ্রাফযোগে কোনো দূর দেশে অবস্থিত বরের সহিত অপ্রাপ্তবয়স্ক, ৯ বছরের বালিকার বিবাহ হইতেছে। অনেক সময় প্রাপ্ত বয়স্কা কন্যা, ৬০ বছর বৃদ্ধের সহিত অথবা দুশ্চরিত্র পানাসক্ত পাত্রের সহিত বিবাহের সম্বন্ধ হইয়াছে বলিয়া, বুক-ভাঙা রোদনে বক্ষ ভিজাইতে থাকে, সেই হৃদয়বিদারী অশ্রুবাহের মধ্যেই বিবাহ-ক্রিয়া সমাপ্ত হয়। পাত্রী কিছুতেই ‘হু’ বলিবে না, কিন্তু অভিভাবকও নাছোড়বান্দা, তাহারা বলপূর্ব্বক ‘হু’ ‘হ’ বলাইয়া বিবাহের শ্রাদ্ধ করেন।’
বেগম রোকেয়া তার জীবদ্দশায় সৃজনশীল ও বৈপ্লবিক লেখনীর মাধ্যমে নারীর সামাজিক ও আইনগত মর্যাদা রক্ষা ও উন্নয়নে আজীবন লড়াই করে গেছেন। তিনি মানুষের মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। তিনি ভালোভাবেই বুঝতেন যে, নারীর অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির ও তা বৃদ্ধির পূর্বশর্তই হচ্ছে নারীকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আর শিক্ষা বলতে তিনি পুঁথিগত বিদ্যার পাশপাশি প্রায়োগিক ও মানসিক শিক্ষা বুঝিয়েছেন। তাই তিনি নারী শিক্ষায় বিশেষ করে মুসলিম নারী শিক্ষায় সুযোগ করে দেওয়ার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই ব্রত নিষ্ঠার সাথে আজীবনই পালন করে গেছেন। আমরা বলতেই পারি, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক ও সমাজসেবীর পাশপাশি রোকেয়া ছিলেন একজন বাস্তববাদী, সত্যদ্রষ্টা, মননশীল ও প্রগতিশীল মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তার বিপ্লবী দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক।
লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (জনসংযোগ) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।