বেগম রোকেয়া। আর দশটি সাধারণ নারীর মতোই জন্ম নিয়েছিল; কিন্তু আর দশটি সাধারণ নারীর মতো বৃত্তেবন্দি থাকেনি তার কর্মকাণ্ড। তিনি পথিকৃৎ। তিনিই আজকের নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। নারীকে সম্মানের আসন দিয়েছেন। এই যে নারীরা আজ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে, সেটাও অনেকাংশে তার অবদান। হয়তো এটা একসময় হতো, কেউ না কেউ আসতো, তবে সে ভবিষ্যৎ। বেগম রোকেয়ার মতো আর কয়েকজন ছিলেন এই মতের ধারক।
রোকেয়া দিবসের মাত্র কয়েকদিন আগেই সেই রোকেয়ার গ্রাফিতিতে কালি ছিটানোর ঘটনা ঘটেছে। যে করেছে সে নিজেও একজন মেয়ে! আশ্চর্য না বিষয়টা? একজন নারী তার অগ্রদূতের গ্রাফিতিতে কালি ছিটিয়ে অপমান করেছে! যদিও পরবর্তীতে সে ক্ষমা চেয়েছে। যদিও এখানেই শেষ না। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও পরিবর্তন চাওয়া হয়েছে। একজন মহিয়সী নারীর অবদান স্মরণে রাখতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, সে আমি বুঝতে পারি না! শুধু এটুকু বুঝি এই নারীর আরো সম্মানপ্রাপ্য রয়েছে। যদিও এ পোড়ার দেশে কে কাকে সম্মান দেয়। কে কার দিকে তাকায়?
১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তা ছিল নারীদের কাছে নিষ্ঠুর ও সর্বোচ্চ নির্মম কাজ। তবুও সেটা চলে আসছিল, যদি না রাজা রামমোহন রায়ের মতো কিছু মানুষ এর প্রতিবাদে রুখে না দাঁড়াত। তাছাড়া বিধাব বিবাহ প্রচলনও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এখানে লক্ষ্যণীয় যে যুগে যুগে যত নিষ্ঠুর প্রথার আবির্ভাব ঘটেছে, যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিহ্ন বলে পরিচিত তা সবই নারীদের শোষণের কাজে তৈরি করা হয়েছে।
তাদের মঙ্গলের জন্য ছিল কেবলি অন্দরমহল। অথচ বিদ্রোহী কবি বলে গেছেন, পৃথিবীর মহান সৃষ্টি কর্মের অর্ধেক নারীর অবদান। বেগম রোকেয়ার হাত ধরেই নারীরা ভাঙার সাহস পেয়েছিল বন্দি দেয়াল। নিজের অধিকার আদায়ের কথা বলার শক্তি যুগিয়েছিল বেগম রোকেয়ার রচনা। নারীরা যে পুরুষের দাসীমাত্র নয় অধাঙ্গিনী সে কথা বুঝতে শিখেছিল তার হাত ধরেই। শত বছর আগে নারীদের ক্ষমতায়নের ও অধিকার প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন বীজ তিনি বুনেছিলেন, আজ আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই।
বিশ্ব নেতৃত্বে ক্ষমতায়নে আজ নারীর জয়জয়কার। এটাই হয়। স্বপ্ন দেখান একজন। সেই স্বপ্ন হাজার চোখে স্বপ্ন হয়ে ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক সময় তা বাস্তবে রূপ নেয়। বেগম রোকেয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। সুলতানার স্বপ্ন বেগম রোকেয়ার এক অনন্য সৃষ্টি। নারীবাদী সাহিত্যে, নারী চেতনার জাগরণে এটি অন্যতম রচনা। এছাড়াও অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ, মতিচূর ইত্যাদি গ্রন্থেও তিনি তার চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিপুণভাবে।
রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রাম। ১৮৮০ সাল। নারীরা আজও জন্ম নেয় আবার তখনও জন্ম গ্রহণ করেছে। পার্থক্যটা বিশাল।
আজ নারীরা ঘরের কাজ আর বাইরের কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারছে। মাতৃ দায়িত্ব থেকে শুরু করে মহাকাশে কাজ করে চলেছে। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যখন অপসংস্কৃতির আর নারীবিদ্বেষী নিয়মের বেড়াজালে নারীরা বন্দি ছিল, তখন বেগম রোকেয়া জন্ম গ্রহণ করেন। সমাজের কাঠামো এমন স্্েরাতে প্রবাহিত হচ্ছিল, যেখানে নারীদের কঠোর নিয়মের মধ্যে জীবনযাপন করতে হতো।
জ্ঞান তৃষ্ণা পূরণ করাও তখন বেশ দূরহ ছিল। বেগম রোকেয়াকে নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়। কেন তাকে অগ্রদূত বলা হয় তা তার জীবন আলোচনা থেকেই বোঝা যায়। তিনি যে সময় জন্ম গ্রহণ করেন, সে সময় ইংরেজী শিক্ষা তো বহু দূরের কথা, মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণই ছিল নিষেধ। মেয়েদের কাজ ছিল সন্তান জন্মদান, লালনপালন ও গৃহ কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি নিজ পরিবারেও মতামত প্রকাশ করা ছিল কঠিন কাজ। বাইরের জগতে বের হওয়ার সুযোগও ছিল খুব কম। বড় হওয়ার সাথে সাথে তিনি আবিষ্কার করলেন বাইরের পৃথিবীটা তার জন্য নয়। সেটা শুধুই পুরুষদের দখলে। তাকে ঘরেই আরবী ও উর্দু শিক্ষা দেয়া হলো। তবে জ্ঞানের নেশা যাকে পেয়ে বসে তাকে থামানো যায় না। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম ছিলেন আধুনিক মনস্ক। তিনিই বেগম রোকেয়াকে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। তবে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের অন্তরালে।
নিজ পরিবারেই একাধারে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী থাকলেও বড় ভাইয়ের মতো আধুনিকমনস্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। যা পরবর্তীকালে তার জ্ঞান তৃষ্ণাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
শিক্ষার জন্য এমন ধ্যান ছিল বলেই তিনি নিজে জাগতে পেরেছেন হতে পেরেছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত। নিজেকে জাগানোই যেখানে বেশ কঠিন কাজ, সেখানে অন্যকে জাগিয়ে তোলার কাজটিও তিনি দক্ষ হাতেই করেছেন। তার হাত ধরেই নারী অধিকার আদায়ে পরবর্তীতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তবে শুধু নারী জাগরণের অগ্রদূত বললে বেগম রোকেয়ার ভূমিকাকে সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না বলেই আমার মনে হয়। কারণ যে পরিবেশের মধ্যে থেকে তিনি ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে সাহিত্য রচনা করেছেন তাও বিবেচনায় আনতে হবে। যদিও তার অধিকাংশই নারী অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে কিন্তু পড়ার প্রতি যে তীব্র ঝোঁক তাও শেখায়। আবার পুরুষ জাতিকে চোখে আঙুল দিয়ে নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার কাজটিও ভালোভাবেই করেছিলেন তিনি। বেগম রোকেয়ার সাহিত্য সাধনা প্রসারিত হয় বা সামনে আসার সুযোগ করার পেছনে যে ব্যক্তির ভূমিকা রয়েছে তিনি বেগম রোকেয়ার স্বামী।
১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। বেগম রোকেয়ার সাথে স্বামীর সাখাওয়াত হোসেন যুক্ত হয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামেই পরবর্তীতে পরিচিত হন। নিজের বাড়িতে বেগম রোকেয়ার বড় ভাইয়ের সাহচর্যে জ্ঞানশিক্ষা লাভ করার পর স্বামীর সাহচর্যে তিনি সাহিত্য চর্চার পূর্ণ সুযোগ পান। কারণ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। তিনি শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে সাহিত্য চর্চার উদার পরিবেশ সৃষ্টি করেই বসে ছিলেন না, একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদাও করে রাখেন। এতে তার বিদ্যামনস্ক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। যে পরিবেশ বেগম রোকয়ার পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেও ভূমিকা রেখেছিল। আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া যে সাহসিকতা, উদার মনোভাব দেখিয়েছেন তা আজও নারীদের অগ্রযাত্রায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়।
নারীরা যে শুধু ভোগের সামগ্রী নয়, সে কথা তার রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে গেছেন। বেগম রোকেয়া তার চিন্তা-চেতনা, তার ধ্যান-ধারণায় তখনকার নারীদের চেয়ে ছিলেন অনেক অনেক এগিয়ে।
এমনকি এই আজ আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও অনেক নারী যখন তার অধিকারের কথা বলতে দ্বিধা করে, তখন তিনি তার কর্ম দিয়ে দৃঢ় চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যুগ কোন বাধা নয়, বাধা হলো* ইচ্ছা শক্তি, প্রকাশ করার মানসিকতা। আর তাই নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে যুগে যুগে নারীদের কাছে তো বটেই পুরুষদের কাছে উৎসাহ অনুপ্রেরণার নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তার কারণ লেখনীর মধ্যেই তার কার্যক্রম সিমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সামাজিক ও সাংগঠনিক কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তাছাড়া সেই সময় একটা স্কুল মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু করাটাও চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। তার পরিশ্রম ক্ষমতা, চিন্তাশক্তি, ধৈর্য যেকোনো মানুষকে উৎসাহিত করে।
বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন থেকে প্রসারিত হওয়া নারী অধিকার বাস্তবায়নের আজ অনেকটা পথ এগিয়ে চলেছে। যদিও সেই ভোগবাদী মানসিকতা আজও অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান তবুও নারী অধিকার আদায়ে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সেকথা বলাই যায়। নারীদের মুক্ত চিন্তার যে বীজ বেগম রোকেয়া তার কর্মে, তার সাধনায় বপন করে গেছেন আজ এবং আরো শত বছর পরেও যে নারী সমাজ তা বহন করবে তা নিশ্চিত বলা যায়।
কারণ অধিকার আদায়ে অগ্রগতি হলেও আজও নারীদের উপর নৃশংসতার ঘটনা ঘটছে। আজও ধর্ষণ নামক ব্যাধি ঘৃণিত পুরুষদের তাড়িত করে। আজও বস্ত্র হরণ করে নারকীয় উল্লাস করার মতো মানুষ বাস করে। প্রকাশ্য রাস্তায় নোংরা প্রস্তাবে সম্মতি না দেয়ায় কুপিয়ে জখম করা হয় বা মেরে ফেলা হয়। আজও নারীদের ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখার মানসিকতা রয়ে গেছে। তবে বেগম রোকেয়ার হাত ধরে যে পথে নারীরা এগিয়ে চলেছে, সে পথে একদিন পুরোপুরি সাফল্য আসবেই।
প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট