প্রতিবেশী আধিপত্য রুখে আত্মসম্মানের প্রতিজ্ঞা!
রাজু আহমেদ
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন চিকিৎসা পর্যটক ভারতে গিয়েছেন। সময়ের এই ব্যাপ্তিতে শ্রীলঙ্কা থেকে ১ হাজার ৪৩২ জন, মিয়ানমার থেকে ৩ হাজার ১৯ জন এবং পাকিস্তান থেকে মাত্র ৭৬ জন মেডিকেল ভিসায় ভারতে এসেছে। (টিবিএস রিপোর্ট ৩ জুলাই, ২০২৪)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিণতিতে ৫ আগস্টের পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের পারদ নিম্নমুখী। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় ৪৯টি মিডিয়ার লাগাতার প্রোপাগাণ্ডা, বিজেপির ভোট হাসিলের রাজনীতিতে গুজব ও মিথ্যার বেসাতি, বিজেপিনির্ভর ভারত সরকারের বাংলাদেশ ইস্যুতে একচোখা নীতি এবং ভারতীয় আধিপত্যকামীতা ও আগ্রাসন রুখে দিতে ভারত বয়কট নীতিতে চলা বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। আগরতলাস্থ বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে হামলা, কলকতায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা কিংবা শুভেন্দু অধিকারীর আগ্রাসী প্রচারের প্রতিবাদে বাংলাদেশেও বিচ্ছিন্নভাবে ভারতের পতাকার অবমাননা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে গুজব ছড়িয়ে ভারত নিজেকে নিজেই উত্তপ্ত করছে সেই সংখ্যালঘুরা নিরাপদে আছে। ষড়যন্ত্র এখন এতোই নগ্ন যে ভারতের উগ্রপন্থি হিন্দুরা এদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে চাচ্ছে! মধ্যখানে চিন্ময় দাস প্রভুকে গ্রেফতারের পরে ইসকন সমর্থিত সন্ত্রাসীদের দ্বারা আইনজীবী আলিফ হত্যার মতো নারকীয়তার স্বাক্ষী হলো দেশ। ভারতীয় উগ্রতাবাদীদের মতো বাংলাদেশিরাও যে পথহারা না হয়ে প্রশংসনীয় ধৈর্য দেখিয়েছি তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশের জনগণ তাদের ফাঁদে পা দিক কিন্তু এদেশের আলেমণ্ডওলামা, প্রজ্ঞাবান দেশপ্রেমিকদের আন্তরিকতা, মিডিয়ার প্রচারণা এবং সরকারের আহ্বান জনগণ অসীম সবরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। হাজার বছরের যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তা ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয়নি।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের অধোগতিশীল সম্পর্কের কারণে আমদানিনির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যসামগ্রীর বাজার কিছুটা অস্থিতিশীল হতে পারে। তবে সেটা সাময়িক। কেননা সরকার ও ব্যবসায়ীরা এরইমধ্যে বিকল্প উৎসের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। ভারতের প্রকাশ্য শত্রুতায় দেশের স্বার্থের প্রশ্নে, সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য ঐক্য হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি যাতে স্থিতিশীল থাকে সে লক্ষ্যে বিভিন্ন ধর্মের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে। এছাড়াও ভারতের স্বার্থপরতার নীতির কারণে অতীতের বাংলাদেশ তৎকালীন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কয়েকবার ভারতীয় পণ্য বয়কটের ঘোষণায় বাংলাদেশের জনগণ ভারতনির্ভরতাও কমিয়েছে।
এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন যে, ভারতের সাধারণ মানুষের সাথে সাধারণ বাংলাদেশিদের কোনো মতদ্বৈততা নেই। যত বিরোধিতা তা ভারত সরকারের আধিপত্যকামী মনোভাব এবং তাদের স্বার্থবাদী বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা ইসলামেরও শিক্ষা। বাংলাদেশ যেমন ভারতের লাভজনক বাজার তেমনি দূরত্বের নৈকট্যের কারণে অনেকটা আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের জন্য ভারতের সাথে সম্পর্কে সময় বাঁচায় এবং পণ্যের পরিবহন খরচ কমায়। ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকের চেয়ে আরো বেশি আত্মিক রাখার সবচেয়ে বড় কারণ তাদের অনেকে বাংলা ভাষায় কথা বলে। সংস্কৃতিতেও তারা বাংলাদেশি হালচালের কাছাকাছি। ভৌগোলিকভাবেও নিকটতম বৈশিষ্ট্যের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জন্মবৃত্তান্তে যে দেশটির ভূমিকা অপরিসীম সে দেশটির সাথে বাংলাদেশ ও দেশের জনগণের সুসম্পর্ক থাকা কাঙ্ক্ষিত ছিল অথচ ভারতে নির্দিষ্ট একটি দলের সাথে একদর্শী নীতির কারণে সম্পর্ক নাজুক হতে হতে এখন নাজুকতর। ভারত সরকার সভ্য বিদেশনীতি অবজ্ঞা করে, বাংলাদেশের বৃহদাংশের জনগণের অভিমতকে উপেক্ষা করে একটি দলের সাথে খাস করে বললে একজন ব্যক্তির সাথেই কেবল সম্পর্ক রাখতে চেয়েছে! বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে যেটা ভারত সরকারের প্রজ্ঞা প্রসূত কাজ হয়নি। বাংলাদেশের যে সকল রোগীরা ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতেন তাদের কিছুটা বিড়ম্বনা হয়েছে বটে। চিকিৎসা ভিসায় যতজন বাংলাদেশি ভারতে পাড়ি জমাতো তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ভারত ঘুরে দেখার সুপ্ত বাসনা রেখে ঘুরতে যেতো এবং ফেরার পথে ডাক্তার চেম্বার হয়ে আসতো! যাইহোক সেটা ভিন্ন বিতর্ক। তবে যারা প্রকৃতার্থেই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারত ভ্রমণ করতো তাদের একাংশ এরইমধ্যে ভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে। কোনো কিছু কখনোই শূন্য থাকে না। কেউ কারো জন্য চিরকাল অপেক্ষাতেও থাকে না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চিকিৎসায় যে আহামরি পার্থক্য আছে সেটা বলা যায় না। তবে ভারতের চিকিৎসা পদ্ধতি গোছালো এবং নানাবিধ ক্ষেত্রে হয়রানি কম। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা চরমভাবে আছে এটা স্বীকার্য। হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো অবকাঠামো ও পরিবেশগতভাবেই অসুস্থ, নার্স-ডাক্তারের দুর্ব্যবহার এবং রোগীকে চিকিৎসার নামে গলাকাটা- গণমাধ্যমে এসব খবর অনেক সময় মুখরোচক করেই আসে। রোগীকে অহেতুক টেস্ট দেয়া, নিম্নমানের ওষুধ প্রেসক্রাইব করা এবং ওষুধ কোম্পানির সাথে আঁতাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ লেখা- এসব চিরাচরিত চরিত্র। ভারতের দাদাগিরি রুখে দেয়ার মোক্ষম সময় এটাই। ডাক্তার এবং হাসপাতাল-ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাগতে হবে। স্পষ্ট ঘোষণা দিত হবে, ভারতের সমমানের চিকিৎসা বাংলাদেশেও নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানের। কাজেই বিশ্বের সেরা চিকিৎসা বাংলাদেশে দেয়া সম্ভব। সেবা প্রদানের যে মূলমন্ত্রে চিকিৎসার ভিত্তিমূল রচিত হয়েছে সেটা ফলো করে রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করলে এটা অসম্ভব নয়। স্মরণ আছে বোধহয়, একবার কোরবানিরর কয়েকদিন আগে ভারত গরু রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সেবার কোরবানির পশু সংগ্রহে কিছুটা ভোগান্তি বেড়েছিল বটে। এরপর বাংলাদেশের ছোট-বড়, প্রান্তিক খামারিরা এতো অধিক সংখ্যক গরু লালন-পালন করেছে যা এখন আমাদের জন্য উদ্বৃত্ত।
অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত খামারিরা বাংলাদেশের পশুপালনের চেহারার চিত্র বদলে দিতে পারলে আমাদের দেশের সবচেয়ে বেশি মেধাবী, সর্বোচ্চ শিক্ষিত ডাক্তারগণ দেশের চিকিৎসাসেবার হালহকিকত আমূলভাবে বদলে দিতে পারবেন না? আশা নয় বিশ্বাস, দেশপ্রেমের মানসিকতায় এটা সম্ভব। অচিরেই সম্ভব এবং এটার বাস্তবায়ন হবে বলেই বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের রোগীদেরও কিছু বাতিক আছে। বাতিক মূলত পকেটের অতিরিক্ত পয়সা থেকে জন্মে! সর্দি-জ্বরের জন্যও কারো কারো ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা নিতে যেতে হয়! এতো এতো নামি-দামি ব্র্যান্ড বাংলাদেশে থাকতেও কেনাকাটার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিতে হয়। ওপারে সর্ব সুখ যাদের বিশ্বাস তাদের আসলে মানসিক অসুখে ধরেছে। দেশের এতো সুন্দর সুন্দর পর্যটন স্পট থাকার পরেও বিদেশ না দেখলে কারো কারো পেটের ভাত হজম হয় না। অথচ এদেশের কিছুই এখনো দেখা হয়নি। অভিযোগ আছে, দেশের সর্বক্ষেত্রে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা। এটা যেমন সত্য, সেটাও তো সত্য যে বিদেশে গিয়ে ভোগান্তি সহ্য করে সেটাও চুপচাপ মেনে নিই! কারণ সেটা বিদেশ! অথচ একই ভোগান্তি দেশে বসে সহ্য করার সময় দেশটাকে বারবার দায়ী করি, সিস্টেমকে গালি দেই। আমাদের দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। বাংলাদেশের চিকিৎসা এবং পর্যটন খাতকে পিছিয়ে রাখতে দেশি-বিদেশি নানামুখী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রও আছে। পৃথিবীর সবচেয় দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার কিংবা সাগরকন্যা কুয়াকাটাতে যারা ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত তাদের অনেকেই আবার বিদেশ যাত্রার ট্যুর ট্রাভেলস এজেন্সির ব্যবসায় যুক্ত। আর্থিকভাবে ব্যবসা বিবেচনা করলে কোনটিতে লাভ বেশি? তাছাড়াও শাসকমহলের অনেকের বিদেশপ্রীতি বিশেষত ভারতপ্রীতি এদেশের সামগ্রিক উন্নতিকে পিছনে টেনে রেখেছে। বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষের অর্থপাচারের গন্তব্য ভারত। সবকিছু মিলিয়ে দেশটা যাতে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর না হতে পারে তাতে নানামুখী চক্রান্ত ছিল। বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা পিছিয়ে থাকা, বাংলাদেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থা না থাকা কিংবা দেশি পর্যটনের প্রতি উদাসীনতা দেখানো- এর পেছনে অন্য কোনো কারণের ধারণা অমূলক নয়। জাতিকে সাবধান থাকতে হবে।