আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা টলেমিয়, অর্থাৎ টলেমির বিশ্বজগতের ভুল ধারণার মতো করেই সাজানো হয়েছে আমাদের দেশের শিক্ষাজগৎ। টলেমির জগৎবিষয়ক ধারণাটি খুবই চমৎকার ছিল, প্রায় দুই হাজার বছর ধরে তা দিয়ে কাজ চলেছে বেশ।
টলেমিই পাঠ্য ছিল সবার কাছে। ওতে ছিল আত্মার শান্তি। কেননা, মানুষের পৃথিবীই সমস্ত মহাকাশের কেন্দ্রে অবস্থান করছিল।
এটা মানবমনে যে ভাব তৈরি করেছিল তা বেশ সুখের। এই ধারণাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন পণ্ডিতরা এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্রও। কোপার্নিকাস-গ্যালিলিওকে তাদের সৌরকেন্দ্রিক ধারণাটি প্রচার করতে অনেক বেকায়দায় পড়তে হয়েছে যদিও শেষ পর্যন্ত তাদেরটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাও বেশ সুখের সুবিধাভোগী, বৈষম্যমূলক ও মুনাফাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী, ব্যবসা ও রাষ্ট্রশক্তির কাছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি পরীক্ষাকেন্দ্রিক- বোঝার সুবিধার জন্য গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় টলেমিয়। যা হওয়া প্রয়োজন তা হলো শিক্ষার্থী-শিক্ষককেন্দ্রিক অর্থাৎ গ্যালিলিয়। এজন্য প্রয়োজন এক আমূল পরিবর্তন- বৈপ্লবিক শক্তি, যা বিউপনিবেশায়নের জন্য জরুরি। কেননা, এ টলেমিয় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সমগ্র ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো।
বাংলাদেশে টলেমিয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন একটা ঔপনিবেশিক ঘটনা। উপনিবেশ-পূর্বকালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সমাজবিকাশের একটি স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছিল। তখন এই শিক্ষাব্যবস্থাটি ছিল সমাজ-পরিচালিত ও সমাজকেন্দ্রিক। সেখানে শিক্ষক বা পণ্ডিত মশায়ই ছিলেন সেই পাঠশালা ও টোল নামের প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্রে। তার কথা ও সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। তিনি শিক্ষার্থীর স্বার্থই বিবেচনা করতেন এবং তার সাধ্যমতো শক্তি দিয়ে তাকে মানুষ করে তোলার ব্রত গ্রহণ করতেন। শিক্ষাদান ছিল তার কাছে ধর্মের মতো পবিত্র। শিক্ষার্থী বাছাইয়ে সমাজ ও সেইসঙ্গে শিক্ষক ছিলেন প্রায় সম্পূর্ণ ধর্ম ও জাতপাত নিরপেক্ষ। সেখানে শিক্ষককে কেন্দ্র করেই সমাজ তার শিক্ষাব্যবস্থা সাজিয়েছিল, যা গঠনকাঠামোর দিক থেকে ছিল সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক, যদিও তার পাঠক্রমের একাংশ ছিল অনুন্নত-পশ্চাৎপদ চিন্তাপ্রসূত।
এ ছবিটি পাওয়া যায়, ইংরেজ পাদ্রী উইলিয়াম এডামের ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ সালের তিন খণ্ডের সরেজমিন প্রতিবেদনে।
এডামের হিসাবে বাংলা বিহারে সেসময় দেড় লাখ গ্রামে এক লাখ পাঠশালা ছিল, অর্থাৎ প্রতি দুটি গ্রামে একটি করে, যেখানে অংক, ভাষা ও নীতিশিক্ষা দেওয়া হতো।
নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক রাহমান চৌধুরী তার ‘বাংলার ৪০০ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা’ বইতে (শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০১৪) তখনকার শিক্ষাপরিবেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার পারদর্শিতা অনুসারে শিক্ষকের কাছ থেকে সহযোগিতা লাভ করত এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে ব্যক্তিগত বন্ধন গড়ে উঠত। পাঠশালার উপর গুরুর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ থাকত এবং গুরু নিজের ইচ্ছামত পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এই বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষক পাঠশালাগুলিতে যথেষ্ট স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেতেন। অন্যদিকে অভিভাবকদের কাছে শিক্ষকের দায়বদ্ধতা শিক্ষার মানকে ধরে রাখতে সাহায্য করতো।’
এরপর তিনি লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ আমলের সৃষ্টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় আর মহাবিদ্যালয় ক্রমসম্পর্কিত গোটাব্যবস্থা পাঠশালা শিক্ষার গোড়া ধরে টান মারলো। বাংলা ভাষার প্রতি বা বাংলা পাঠশালা শিক্ষার প্রতি শাসকদের কোনো শ্রদ্ধা বা আকর্ষণ ছিল না। ফলে ইংরেজ শাসকদের হাতে পড়ে পাঠশালা শিক্ষা তার জীবনীশক্তি হারাতে থাকে। বাংলার শিক্ষিত সুবিধাভোগীরা এ ব্যাপারে শাসকদের বাধা দানের পরিবর্তে তারা শাসকদের সমর্থন জানান।’
এই হলো বাংলার সমাজ-পরিচালিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে সাম্রাজ্যশক্তি দিয়ে কক্ষচ্যুত করে টলেমিয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ইতিহাস যা এদেশের জ্ঞানচর্চার জগতে এক বিপর্যয় ডেকে আনে। সেই থেকেই চলছে এই ঔপনিবেশিক টলেমিয় শিক্ষাব্যবস্থার গুণকীর্তন ও তা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সেই একই শিক্ষিত সমাজের বাধা। এই টলেমিয় শিক্ষাব্যবস্থা যা শিক্ষককে কেন্দ্র থেকে ছুঁড়ে পরিধিতে এনে ফেলল তার কেন্দ্রের কোলজুড়ে বসল পরীক্ষা, মূল্যায়ন, নিয়মণ্ডকানুনের নিগড়, মাতব্বরির বহুস্তর ইত্যাদি।
এ ব্যাপারে রাহমান চৌধুরী লিখেছেন, ‘পাঠশালার লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট ‘ছাত্রদের শিক্ষা বা সাক্ষরতা দান’ কিন্তু সেখানে উপলক্ষের বাড়বাড়ি বা আধিক্য ছিল না, সত্যিকার অর্থে তার প্রয়োজনও ছিল না। কতোগুলো অপ্রয়োজনীয় বিধিবিধান, অকারণ পারিষদবর্গ ছাড়াই তো বেশ চলছিল কাজ চলার মতো করে। কিন্তু রাজদরবারে যেমন রাজার জয়ধ্বনি দেয়ার জন্য বিরাট পারিষদবর্গ দরকার হয়, পাঠশালার বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। পারিষদের ভারে ভারাক্রান্ত হলো প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা; কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা হারিয়ে গেল। যাদের জন্য শিক্ষা তাদের জায়গা হলো না, যাদের খবরদারি করার জন্য রাখা হয়েছিল তাদের সংখ্যা বাড়তেই থাকল।
শিক্ষাদানের নামে তৈরি হলো এক আমলাতান্ত্রিক বিরাট চক্র।’
এই যে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা, যার ফলে শিক্ষক আর শিক্ষার্থী দুইই কেন্দ্র থেকে ছিটকে দূরে হারিয়ে গেল এবং সেই থেকে বিদ্যালয় আর মানুষ তৈরির কারখানা থাকল না, হয়ে গেল ইংরেজ শাসক-আমলাদের ভৃত্য তৈরির ফ্যাক্টরি। স্কুল-কলেজ আর মানবিকতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখার জায়গা থাকল না, হয়ে গেল কেরানি তৈরির ও সনদপত্র বিলি করার সংস্থা। যেমন, অংকে ও বিজ্ঞানে ইউক্লিডের ও আইনস্টাইনের সূত্র মুখস্তের প্রতিযোগিতা চলল, তবে তাদের মূল্যবোধ শেখার প্রয়োজনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। স্কুল-কলেজ পরিণত হলো মুখস্তবিদ্যার বমনাগারে। সাম্রাজ্যশক্তির দরকার ছিল মানুষ তৈরি নয়, জৈব বা মানব-কম্পিউটার তৈরি। আর তাই সেই শিক্ষাব্যবস্থা যখন এখনও বহাল, সংকটটা স্পষ্ট হচ্ছে কারণ পশ্চিম এখন কম্পিউটার মেশিন তৈরি করে ফেলেছে। ফলে দেশের জৈব বা মানব-কম্পিউটারগুলোকে হয় সিলিকন ভ্যালির প্রোডাক্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকতে হচ্ছে, না হয় অচল মাল বা বেকারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে। টলেমিয় শিক্ষাব্যবস্থার ফল ঠিক এমন হওয়াই স্বাভাবিক।
সেসময়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমস্যাটার কথা তুলেছিলেন তার ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে। লিখেছেন, ‘স্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে ১০টার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়। কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে ঠিক ফরমাশ-দেয়া জিনিসটা পাওয়া যায়, এক কলের সঙ্গে আর-এক কলের উৎপন্ন সামগ্রীর বড়ো-একটা তফাৎ থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়।’
এই ব্যবস্থাটা স্বাভাবিক নয় বলেই টিকে থাকে প্রবল বাহ্যিক শক্তির জোরে, শিক্ষকের চাকরি হারানোর ও শিক্ষার্থীর ফেল করার ভয় এবং শিক্ষাঙ্গনে শারীরিক-মানসিক শাস্তি ও সুসম্পর্কের অভাব। এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই ক্লাসে ঝিমাতে কিংবা পারলে ক্লাস ফাঁকি দিতে উদগ্রীব। এ ব্যবস্থায় ‘১২ বছর পড়ালে শিক্ষক গাধা হয়’ বলে প্রবাদ গড়ে ওঠে আর অনেক কিশোর বড় হয়ে মনীষী হয়ে থাকেন কেবল স্কুল পালানোর বদৌলতে। ‘পড়ালেখা করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে’ এমন মানবিকতাবিমুখ কুদর্শন শুধু এই ব্যবস্থায়ই জন্মাতে পারে।
মার্কা দিবার সুবিধা হয় বলেই মার্কাদাতারা এই ব্যবস্থাটি আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার বদলে মার্ক দেওয়াটাই বিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হয়ে তা এখন এক বিরাট পরীক্ষা-ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত যার সার্বিক বাজেট শুনলে আমাদের মাথা ঘুরে যাবে। পরিবর্তনটা তাই এখন আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। সৌরজগতের টলেমিয় ধারণা থেকে গ্যালিলিয় ধারণায় পৌঁছাতে যেমন অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম ও বীরত্বের প্রয়োজন হয়েছিলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও পরীক্ষা- ও নাম্বারকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক কাঠামো থেকে শিক্ষার্থী-শিক্ষককেন্দ্রিক মানবিক কাঠামোয় ফিরিয়ে আনতে অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম ও বীরত্বের প্রয়োজন হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই আমূল পরিবর্তন ও রূপান্তরের কোনো বিকল্প নেই।
সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোট কাগজ)।