ঢাকা ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রেসিডেন্ট আসাদের বিদায় ও সিরিয়ার ভবিষ্যৎ

রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রেসিডেন্ট আসাদের বিদায় ও সিরিয়ার ভবিষ্যৎ

সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসন শুরু হয়েছিলো সত্তরের দশকের শুরু থেকে। প্রেসিডেন্ট আসাদ দামেস্ক ছেড়ে গেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এটাকে সত্যিকার অর্থেই মনে হচ্ছে যে সিরিয়ায় ৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত মুহূর্ত। মূলত আসাদের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাশিয়া ও ইরান অন্য ঘটনায় দুর্বল ও মনোযোগ হারানোর কারণেই তার এ পরিণতি হলো। প্রসঙ্গত, রাশিয়া কয়েক বছর ধরে ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আর ইরান সমর্থিত দুই গোষ্ঠী হামাস ও হেজবুল্লাহ ইসরায়েলের হামলায় বিপর্যস্ত। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া সিরিয়ান নব্বই ভাগ মানুষ এখন দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে এবং অনেকেই বাস্তুচ্যুতদের জন্য নির্মিত ক্যাম্পে বাস করে। সত্যি বলতে কী মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সাল থেকে দেশটি কার্যত তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে, যেখানে বাশার আল-আসাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন, কুর্দি বাহিনী এবং ইসলামি বিদ্রোহীরা বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। একটা সময় পর্যন্ত সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ করা কঠিন বলে বিশ্বাস করেছেন বিশ্লেষকরা। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একইসাথে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু, অবকাঠামোকে ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে চরম দুর্দশায় ফেলেছে। এটি এমন একটি মানবিক সংকট তৈরি করেছে যেখান থেকে পুনরুদ্ধারের কোনো সুস্পষ্ট পথ নেই। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়ায় যুদ্ধের আগের দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া ৬৮ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখেরও বেশি লোক সীমিত সুবিধা নিয়ে ভিড়ে উপচে পড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। এর বাইরে আরও প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দেশটি ছেড়ে পালিয়েছে, যার বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে। কিন্ত চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর, ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে এক যুদ্ধবিরতির চুক্তি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর জোট হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) তাদের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান শুরু করে।

গত কয়েক দিনের মধ্যে, তারা সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো ও পুরো ইদলিব প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং হামা শহরের কাছাকাছি পৌঁছায়। বিরোধীদের অপ্রত্যাশিত এই অভিযান একটি দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিরতি অবস্থায় থাকা সংঘর্ষকে পুনরায় তীব্র করে তুলেছে। এটি এই ধারণা ভেঙে দিয়েছে যে, সিরিয়ার শাসক বাশার আল-আসাদ চিরবিজয়ী। তারা প্রায় ২৫০টি গ্রাম ও শহরকে দখল করে নিয়ে বৃহত্তম শহর হোমস মাত্র ২৪ ঘণ্টায় দখল করে এবং গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে স্থির থাকা নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে দামেস্কে ঢুকে পড়ে। বাবা-ছেলে মিলিয়ে ৫৪ বছরের সাম্রাজ্য ফেলে প্রেসিডেন্ট আসাদ নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। এর আগে ইরান ও রাশিয়া একযোগে কাতারের দোহায় উভয় পক্ষকে শান্তি আলোচনায় আহ্বান জানায়। কিন্তু বিদ্রোহী পক্ষ কোনো আহ্বানেরই তোয়াক্কা না করে বলতে গেলে প্রতিরোধ বিহীন রাজধানী দখল করে নেয়। এসব ঘটনা মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। আসাদ কখনো প্রকৃত অর্থে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জয়ী হননি। তার শাসন দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল হয়ে আসছিল। নিকট অতীতে তার অবস্থান আগের চেয়ে আরও বেশি অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। বছরের পর বছর ধরে সিরিয়া নিয়ে সাধারণ ধারণা ছিল যে সংকটটি স্থিতিশীল, যুদ্ধের উত্তেজনা এখন অতীত এবং আসাদ অবধারিত বিজয়ী। তাই আন্তর্জাতিক মনোযোগ কমে গিয়েছিল, সিরিয়া নিয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং বিভিন্ন সরকার ধীরে ধীরে সিরিয়া সম্পর্কিত তাদের নীতির পরিবর্তে অন্য গ্লোবাল চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে সম্পদ সরিয়ে নিতে থাকে। সিরিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকলে আরব দেশগুলো ২০২৩ সালে আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে এগিয়ে আসে, যা কার্যত তার অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে স্বাভাবিক করে দেয়। আঞ্চলিক দেশগুলোর সিরিয়ার পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসাটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য ছিল একটি আশাব্যঞ্জক চিহ্ন।

উপরন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসাদবিরোধী নীতির বিরোধিতায় ইতালির নেতৃত্বে ১০টি ইউরোপীয় দেশ একটি জোট গঠন করে, যা আসাদের শাসন পুনরায় স্বীকৃতি দিতে এবং সিরিয়ায় কূটনৈতিক পুনঃপ্রবেশ ও শরণার্থী প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। এসব অগ্রগতি ছিল একধরনের ধারণা প্রসূত যে, যদিও সিরিয়ার পরিস্থিতি খারাপ, তবে সংকটটি স্থির, নিয়ন্ত্রিত এবং আসাদ তার শাসন আরও শক্তিশালী করছেন। কিন্তু আসলে ধারণাটি ছিল ভুল। সিরিয়ার অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত। ২০২০ সালের শুরুর দিকে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর ১ ডলার ছিল প্রায় ১,১৫০ সিরিয়ান পাউন্ড। চলতি মাসেই বিরোধী আক্রমণ শুরু হলে ১ ডলারের বিপরীতে ১৪,৭৫০ সিরিয়ান পাউন্ডে এসে ঠেকে বিনিময় হার। ৪ ডিসেম্বর এক সপ্তাহের লড়াইয়ের পর তা ১৭, ৫০০ সিরিয়ান পাউন্ডে পৌঁছে। যুদ্ধবিরতি হয়েছিল সিরিয়ার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রেখে নাগরিকদের দীর্ঘকালীন যুদ্ধের পর কিছুটা প্রশান্তি দেওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু এই চুক্তির পর সিরিয়ার মানবিক সংকট আরও বাড়ে। জাতিসংঘ জানায় যে, এখন সিরিয়ার অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সরকারের প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার লাভ হলেও এর কোনোই সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। আসলে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের ওপর সরকারের ভর্তুকি ক্রমেই কমে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সরকার নিয়মিত বিভিন্ন বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনকে বেতন দিতেও হিমশিম খায়। এমনকি আসাদের সামনে আর কেউ ছিল না, যে তাকে রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্ব থেকে উদ্ধার করবে। রাশিয়া ও ইরান দীর্ঘদিন ধরে আসাদ যাদের সমর্থন পাচ্ছিলেন, তাদের নিজেদের অর্থনীতিও এখন দুর্বল। রাশিয়ার অর্থনীতি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতবিক্ষত, ইরানও আর্থিক সংকটে। যদি আসাদ আরও আগেই আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের পুনঃস্থাপনে এগিয়ে আসতো, কিংবা যদি তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতো, তাহলে আজ সিরিয়ার অবস্থান ভিন্ন হতে পারত।

যেহেতু সিরিয়ার মানবিক সংকট চরমে এবং বিশ্বের আগ্রহ ও সাহায্য করার সক্ষমতাও কমে গেছে তাই, সিরিয়ার জনসাধারণ উপলব্ধি করে যে, এই সংকটের কোনো শেষ নেই, নিজেরাই উদ্যোগী হতে হবে। সম্প্রতি তারা আবারও সড়কে নামে এবং আসাদের পতনের দাবি তুলতে থাকে। সিরিয়ার অর্থনৈতিক পতনের অন্যতম কারণ ছিল সংঘটিত অপরাধ। শিল্প স্তরে মাদক উৎপাদন ও পাচার সিরিয়ার সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল অংশ জুড়ে ছিল বিস্তৃত। এমনকি আসাদের সিরিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নার্কো স্টেট হয়ে উঠছিল। বিরোধী সংগঠন এইচটিএস যে আক্রমণ করতে পারে, তা অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই তাদের জানানো হয়েছিল, তুরস্ক তাদের থামানোর চেষ্টাও করেছিল এবং রাশিয়াও পাল্টা বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু আসাদের বাহিনী ক্রমশ ইরাকের দিকে সরতে থাকে, এমনকি কয়েক হাজার যোদ্ধা সীমান্ত পেরিয়ে ইরাকে আশ্রয়ের আবেদন জানায়। রাশিয়ার আট বছরের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আসাদের সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে লড়াই করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। রাশিয়ার গঠিত বিশেষ বাহিনী, যেমন ২৫তম স্পেশাল টাস্ক ডিভিশন, সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে স্থবিরতা কাটাতে পারেনি। ব্যাপকভাবে বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ সংগঠিত হতেই থাকে। বরং একটি অগোছালো মিলিশিয়া নেটওয়ার্ক সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি সামরিক ক্ষমতা দেখাতে সক্ষম হয়। বিশেষত, এইচটিএস নতুন ধরনের ইউনিট তৈরি করে, যারা সাম্প্রতিক যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। ২০১৫ সালেও আরেকবার আসাদকে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল এবং তার শাসন ভেঙে পড়ার শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিল। তখন রাশিয়া এসে সামরিক হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ২০২৩ সালে, রাশান মার্সেনারি নেতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের বিদ্রোহ এবং তার পরবর্তী মৃত্যুতে রাশিয়া ওয়াগনার গ্রুপের বাহিনীকে সিরিয়া থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

একই বছর, মস্কো সিরিয়ায় তাদের বিমানবাহিনীর কিছু ইউনিটও প্রত্যাহার করে নেয়। লাতাকিয়া ভিত্তিক হামেইমিম ঘাঁটিতে অবস্থান করা রুশ বিমানগুলোর সংখ্যা ইউক্রেন যুদ্ধের আগে যে পরিমাণ ছিল, তার তুলনায় অনেক কমে যায়। হিজবুল্লাহ বাহিনীও সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি কমায়। কেননা, ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধের কারণে এই গোষ্ঠীটি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিহত হয়েছেন। সিরিয়ার আলেপ্পো ও ইদলিব অঞ্চলে তাদের বাহিনীর বড় অংশই লেবাননে ফিরিয়ে নিতে হয়েছে। ইরানও সিরিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি কমিয়েছে, কারণ ইসরায়েল প্রায়ই তাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ফলে এবার এমন কোনো বাহিনী আর ছিল না, যারা আসাদকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে। সবচেয়ে বড় চিন্তার যে বিষয় ছিল, সেটি হলো, বিদ্রোহীরা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ব্যাপকভাবে প্রতিশোধ নেবে কি না এবং সেখানে আরেকটি গণহত্যা হবে কি না। ইচটিএস ঘোষণা করেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ মোহাম্মদ গাজি আল-জালালির তত্ত্বাবধানে থাকবে, যতক্ষণ না সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। আপাতত স্বস্তির বিষয়, বিদ্রোহীরা এ ক্ষেত্রে খুবই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। বিরোধী গোষ্ঠী বলছে, তারা প্রতিশোধ নেবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিয়ার নেতৃত্ব কে নেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে জোলানির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা অন্ধকার অতীতের পৃষ্ঠা উল্টে নতুন ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছি। মুক্ত সিরিয়া সব ভ্রাতৃপ্রতিম ও মিত্রদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক গভীর করতে চায়। আমরা অঞ্চল এবং বিশ্বে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য একটি গঠনমূলক ভূমিকা পালনের লক্ষ্য রাখব। তবে সিরিয়ার এ পরিবর্তন হয়তো শুধু সিরিয়া নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও কৌশলগত মানচিত্রকেই নতুনভাবে চিত্রিত করতে পারে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে এখনো অনেক দেশেই নানা আদলে স্বৈরশাসন জারি আছে। সেখানেও এ বিদ্রোহের বাতাস সত্যিকারের আরব বসন্ত ডেকে আনতে পারে।

গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত