ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি হয়ে উঠবে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব

মো. তাহমিদ রহমান
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি হয়ে উঠবে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব

মস্তিষ্ক ভাবনার এক অনাবিল জগৎ। সেই মস্তিষ্ক করছে নতুন মস্তিষ্কের ভাবনা। কী আছে নতুন মস্তিষ্কে তাই নিয়ে আজকের আলোচনা। প্রযুক্তি দুনিয়ার বর্তমান সময়ে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম উপায়ে যন্ত্রকে বুদ্ধিমান বানানোর প্রযুক্তিই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (এআই)। ইয়ান লেকুন, জেফ্রি হিন্টন ও ইউসুয়া বেনজিও- এই তিনজনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই জগতের দিকপাল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আজকের জায়গায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। তিনজনই ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে কম্পিউটার বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য টুরিং পুরস্কার পেয়েছেন। পদার্থবিদ্যায় এবারের নোবেল পুরস্কারও গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করা দুই শীর্ষ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জন হপফিল্ড ও জেফরি হিন্টনের হাতে।

ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমটি হলো এএনআই বা কৃত্রিম সংকীর্ণ বুদ্ধিমত্তা। বুদ্ধিমত্তার জগতে সবচেয়ে সাধারণ হলো এই ন্যারো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (এআই)। এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্যই ব্যবহার হয়। অনলাইনে খেলা, ই-কমার্স সাইট থেকে কেনাকাটা, সেলফ-ড্রাইভিং, স্পিচ রিকগনিশন এবং ইমেজ রিকগনিশন ইত্যাদি এই প্রযুক্তির অন্তর্গত। দ্বিতীয়টি হলো এজিআই বা কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা। মানুষের মতো দক্ষতার সঙ্গে যে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ সম্পাদন করতে পারে এই কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা। বিশ্বব্যাপী গবেষকরা এখন কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মেশিন তৈরির দিকে বেশি মনোনিবেশ করছেন। তৃতীয়টি এবং সর্বশেষ হলো এএসআই বা কৃত্রিম সুপার ইন্টেলিজেন্ট। এই সুপার ইন্টেলিজেন্ট মেশিনগুলো মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে জ্ঞানীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে মানুষের চেয়েও যে কোনো কাজ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করতে পারে।

এ সিস্টেমগুলো অধিক জটিল সিস্টেম। সিস্টেমগুলো এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়, যাতে কোনো ব্যক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে। বিশ্বের যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে মানুষকে আলাদা করা যায় যে বৈশিষ্ট্যটির মাধ্যমে তা হলো তার বুদ্ধিমত্তা। দীর্ঘদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জেফ্রি হিন্টন সব সময় বিশ্বাস করে এসেছেন যে মানুষের মগজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্রের চেয়ে অনেক উন্নত এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যত বেশি মানুষের মগজের মতো করার চেষ্টা করা হবে, ততোই তার উন্নতি হবে। কিন্তু ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা উপলব্ধি হলো।

আত্মোপলব্ধিও বলা যায়।

সেটি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির যে জায়গায় আমরা আজ এসে দাঁড়িয়েছি, খুব সম্ভবত তা এখনই মানুষের মগজের চেয়ে ভালো, শুধু এটাকে আরেকটু বেশি মাত্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া বাকি। একজন মানুষের মগজের প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরনের মধ্যে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন আন্তসংযোগ আছে। পৃথিবীজুড়ে নির্মাতারা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন, যত বড় করে সম্ভব, একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম তৈরি করতে। কাজটা যে হারে এগোচ্ছে, তাতে মনে হয়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম ১০০ ট্রিলিয়ন কানেকশন বা আন্তসংযোগ তৈরি করে ফেলতে পারবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতেছে তাতে করে ভবিষ্যতে ঘটে যেতে পারে নানা অঘটন। এখন থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে কাচের দোকানে ষাঁড় ঢুকে পড়ার মতো ধ্বংসাত্মক, বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন। দীর্ঘদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অধ্যাপক জেফ্রি হিন্টন আতঙ্কিত হয়ে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে গুগলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। প্রায় সারাটা জীবন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে তিনি ব্যয় করেছেন, তা নিয়ে তার তীব্র অনুশোচনা জন্ম নিয়েছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আসন্ন বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে খোলামেলা আলোচনার জন্য চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তিনি মনে করছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তাতে করে তা অচিরেই মানুষের চেয়ে বেশি স্মার্ট হয়ে যাবে এবং নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অকল্পনীয় মাত্রায় তথ্য আত্মস্থ ও বিশ্লেষণ করতে হিন্টনের গবেষণাকর্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সাহায্য করেছে।

এ কারণেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন ছবি চিনতে পারে, ভাষা বুঝতে পারে এবং নিজে গাড়ি চালাতে পারে। তাঁর অবস্থাটা এখন দাঁড়িয়েছে অনেকটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের ঘটনার মতো, যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে তিনি কাজ করেছেন, এখন তারই অতিমানবীয় ক্ষমতায় তিনি ভীত। এটা অদ্ভুত এক মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন। অধ্যাপক জেফ্রি হিন্টন মানবসভ্যতা, সমাজ, বিজ্ঞানের ভালোর জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে সারা জীবন কাজ করলেন, তারপর শেষে দেখতেছেন যে তার কাজের ফলাফল মানবসভ্যতার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। আমরা যে পদ্ধতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করেছি, সেটি অনেকটা চেরাগের ভেতরে থাকা আলাদীনের দৈত্যের মতো।

আপনি যখনি চেরাগ ঘষবেন, তখন দৈত্য বেরিয়ে আসবে আর আপনি বলবেন যে, আমি চাই এটা কর। তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার ক্ষমতা দ্বারা সেটা করে দিচ্ছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ইচ্ছে দৈত্য যতই শক্তিশালী হয়ে উঠবে, ততোই এটি অতি বুদ্ধির অধিকারী হয়ে উঠবে। হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যাবে। তখন সেটি মানব সভ্যতার জন্য শত্রু হয়ে উঠতে পারে। যে শত্রু আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা মানব সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ধরে নিলাম যে আমাদের একটি শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা আছে, যেটি রাজধানী ঢাকা শহরের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং সেটি ব্যবহার করে আমরা কালো ধোঁয়া তথা কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে, নির্মুল আবহাওয়ায় ফিরে যেতে চাই।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার বিশ্লেষণী ক্ষমতার দ্বারা ঠিক করল যে, এটা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ঢাকা শহর থেকে সব মানুষকে সরিয়ে ফেলা, কারণ ঢাকা শহরে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের দিক থেকে মানুষই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। যা ঢাকাবাসীর জন্য মোটেও সুখকর নয়। আশু বিপদের আরো একটা দিক হচ্ছে, বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যার উদাহরণ আমরা গেল মার্কিন নির্বাচনে লক্ষ করেছি। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন সিনেটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে অনেক আলোচনার জন্ম হয়েছিল। আর এ কারণেই মানুষের উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা রোবট বা যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ভয়ংকর নেতিবাচক দিক হল ডিপ ফেক। কোনো একজন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার চেহারা ও কণ্ঠস্বর ব্যবহার করার প্রযুক্তি হলো ডিপফেক। নেতিবাচক ব্যবহারের কারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে এটি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে দেশে ডিজিটাল লেনদেন জ্যামিতিক হারে বেড়েছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে জালিয়াতিও যার ভিত্তি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় দেশকে যখন ডিজিটাল লেনদেনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে, তখন গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্বটি সরকার যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।

ডিপফেক-এর উপদ্রব তো শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। সাধারণ মানুষ থেকে রুপালি পর্দার নায়ক-নায়িকা দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ অনেকেই শিকার হয়েছেন সেই মিথ্যার। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দানব যেকোনো বিরোধী পক্ষের হাতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এই প্রযুক্তি ক্রমেই সহজলভ্য হয়ে উঠছে ফলে ফেক ভিডিও তৈরি করতে এখন কার্যত কোনো প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন পড়ে না। কীভাবে প্রযুক্তির এই অপ-প্রয়োগের লাগামটানা যায় তা নিয়ে আমাদের এখন থেকেই ভাবতে হবে। প্রযুক্তি যে বিপদ তৈরি করেছে প্রযুক্তির মাধ্যমেই তার সমাধানের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এর পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে আসা কোনো ভিডিও বা ছবি দেখে সাথে সাথে বিশ্বাস না করে যাচাই করতে হবে। সর্বোপরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই শক্তিকে ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করতে জনগণকে সচেতন করে তুলতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত