বাংলাদেশে তথাকথিত সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে ভারতের বিজেপি সরকার ও বিরোধীদলগুলোর একের পর এক বিবৃতি, উদ্বেগ প্রকাশ এবং মিডিয়ার মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন ও গুজব ছড়ানো নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েন চলছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ভারত সমর্থিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দেশটি অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে আসছে। ভারত যেন কিছুতেই শেখ হাসিনার পতন মানতে পারছে না। ফলে শেখ হাসিনা ও মোদি যৌথভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলা ও ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেছে এবং করছে। তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কার্ড খেলে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ইসকনের সাবেক হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার নিয়ে ভারত যেন তেলে-বেগুণে জ্বলে উঠে। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জানিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনবরত বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপড়েন তীব্র আকার ধারণ করে। অন্তর্বর্তী সরকারও বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের বক্তব্য-বিবৃতিকে হস্তক্ষেপ গণ্য করে এবং মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। এমন এক পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গত সোমবার একদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তিনি পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সাথে এবং সবশেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে দুই সচিব আলাদাভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের মন্তব্য করা ঠিক হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশও অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে এবং আমাদের প্রতি অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ দেখানো উচিৎ। তিনি বলেছেন, বৈঠকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে ভারতের দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এবং আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে নজিরবিহীন হামলা ও কলকাতা মিশনের সামনে বিক্ষোভ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মিশনের নিরাপত্তা জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। ভারতে বসে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কথা বলাও বাংলাদেশ পছন্দ করছে না বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া পর্যটন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভারতের ভিসা সহজীকরণ এবং তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের সামনে লিখিত বক্তব্য বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলক, ইতিবাচক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। আমরা এ সম্পর্ককে একটি জনকেন্দ্রিক ও জনমুখী সম্পর্ক হিসেবে ভবিষ্যতে দেখব। যে সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকবে সব মানুষের কল্যাণ। দুই দেশের জনগণের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কাজ করতে আগ্রহী দিল্লি।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একে ভারতের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বিজয় বলা যেতে পারে। কারণ, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সময় আমাদের পররাষ্ট্র নীতি বলতে গেলে একদেশদর্শী বা ভারত নির্ভর হয়ে গিয়েছিল। কোনো দেশের সাথে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকার ভারতের মুখের দিকে চেয়ে থাকত। ভারতের খুশি-অখুশির উপর নির্ভর করে পররাষ্ট্রনীতি চালিয়েছে। সব দেশের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়, এ পররাষ্ট্রনীতিকে শেখ হাসিনা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। ভারত ছাড়া কিছুই বুঝত না। সে যেভাবে পরামর্শ দিয়েছে, সেভাবে চলেছে। দেশের স্বার্থ দেখেনি। তার শাসনামলে এমন কথাও বলা হয়েছে, ভারত হলেই আমাদের চলবে, আর কারো প্রয়োজন নেই। এ নীতি অবলম্বন করে সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ভারতের সাথে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে হিন্দুদের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ভারতকে বলে এসেছি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে। এছাড়া, হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা ভারতের সাথে রক্তের বন্ধন, সোনালী সম্পর্ক ইত্যাদি কথা বলে ভারতকে তোষণ করতে দেখা গেছে। এমনকি, গত ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো প্রার্থী নিজেকে ভারতের মনোনীত হিসেবে বলেছেন। হাসিনা সরকারের আমলে ভারত ইচ্ছামতো বাংলাদেশের কাছ থেকে তার সবস্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। বিনিময়ে কিছুই দেয়নি। পারস্পরিক স্বার্থ বলে কিছু ছিল না। শেখ হাসিনাও বলেছেন, ভারতকে যা দিয়েছি, সে তা সারাজীবন মনে রাখবে। অন্যদিকে, ভারত সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যা করলেও হাসিনা সরকার টুঁ-শব্দ করত না। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার চুক্তি করলেও ভারত তার তোয়াক্কা করত না। এমনকি, সে সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হিন্দুদের জায়গাজমি, ব্যবসাপাতি দখল ও মন্দিরে হামলা করলেও ভারত চুপ করে থাকত। ভারতে মুসলমান নির্যাতন ও হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানরা প্রতিবাদ মিছিল করতে গেলে হাসিনা সরকার তাদের উপর গুলি ও নির্যাতন করে তা বন্ধ করে দিত। ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তার দাসে পরিণত হয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের উপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছিল। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার শোচনীয় পতন ও পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর ভারত বেজায় নাখোশ হয়েছে। হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে সে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করেছে এবং করছে। এ সরকার সেসব ষড়যন্ত্র যেমন সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করেছে, তেমনি ভারতের অন্যায্য আচরণের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করেছে এবং করছে। শেখ হাসিনার নতজানু পররাষ্ট্রনীতিকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড় করিয়েছে। ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে। ভারত বুঝতে পেরেছে, ছাত্র-জনতার সমর্থনে গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে চোখ রাঙিয়ে লাভ হবে না। ফলে তাকে নমনীয় হয়েই সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পররাষ্ট্র সচিবকে পাঠাতে হয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবেই ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিজয়। আমরা দেখেছি, হাসিনা সরকারের আমলে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কেউ বাংলাদেশ সফরে এলে মন্ত্রী-এমপিরা কে কার আগে দেখা করবে, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত। এ দৃশ্য ছিল, অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও অসম্মানের। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো ভারতের কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (পররাষ্ট্র সচিব) সফরে এলে রাষ্ট্রের প্রোটোকল অনুযায়ী, যা করা দরকার, তাই করা হয়েছে। মূল কথা হয়েছে সচিব পর্যায়ে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার সাথে হয়েছে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ। এটাই আত্মমর্যাদাশীল দেশের বৈশিষ্ট্য।
প্রতিবেশীসহ বিশ্বের সকল দেশের সাথেই বাংলাদেশ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট, সমতাভিত্তিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাসী। দুঃখের বিষয়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা শুধু ক্ষমতায় থাকতে দেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ককে ভারতমুখী করে ফেলেছিল। দেশকে ভারতের আধিপত্যবাদের নিগড়ে বন্দি করে রেখেছিল। এটা দেশের মানুষ কখনোই মেনে নিতে পারেনি। ফলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তারা জীবন দিয়ে হাসিনাকে উচ্ছেদ করে দেশকে আত্মমর্যাদার ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। আমরা দেখেছি, হাসিনার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় তাকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্বসহ প্রভাবশালী দেশগুলো কীভাবে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে এবং বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশ যেন বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে বহু দিগন্তে পৌঁছে গেছে। এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিভাত হয়েছে, বাংলাদেশ নতুন করে আত্মমর্যাদা ফিরে পেয়েছে এবং বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির পরাজয় ঘটেছে। আমরা অবশ্যই ভারতের সাথে কোনো বৈরী কিংবা একতরফা সম্পর্ক চাই না। আমরা চাই, পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা, সমতাভিত্তিক, বন্ধুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার সম্পর্ক। ভারতকে এটা উপলব্ধি করতে হবে, বাংলাদেশে তার আধিপত্যবাদের দিন শেষ। বাংলাদেশের জনগণ তার খবরদরি আর বরদাশত করবে না।
সম্পর্ক হতে হবে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের, জনগণের সাথে জনগণের, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মতো কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। আমরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই, ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দেশের ভাবমর্যাদা ও পররাষ্ট্রনীতিকে সুসংহত করার জন্য।