জন্মেছি গ্রামীণ পরিবেশে; বর্ধিষ্ণু একটি অঞ্চলে। একান্নবর্তী পরিবারে বুঝতে শিখেই দেখেছি শস্যের ভাণ্ডার। আত্মীয়দের বাড়িতেও দেখেছি নানা শস্য। তার মাঝে অবশ্যই প্রধান ধান। সবে বালক আমি। বাড়ির পাশে ধানের জমি উপযোগী করতে মই দেয়া হতো। মইয়ে উঠেছি। পরে ধান গাছ বড় হওয়া থেকে শুরু করে ধানকে চালে রূপান্তর করা পর্যন্ত নানা কাজে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যুক্ত থেকেছি। ধান খেতের শ্রমিকদের খাবার নিয়ে যেতাম। খাবার ছাড়াও তাদের জন্য হুক্কা জ্বালিয়ে নিয়ে যেতাম। এই করে করে এক সময় হুক্বা জ্বালিয়ে যাওয়ার সময় টেনেও যেতাম। কিছুটা সময়ের জন্য অভ্যাসও হয়ে যায়। শখের বশে ধান কেটেছি। এসব ধান নানা নামের। ধান কাটতে গিয়ে হাতও কেটেছি। বিলের জমি থেকে বোরো ধান কাটার মৌসুমে বিস্তর ব্যস্ত থাকত গ্রামীণ পরিবেশ। দূরে ও নিচু হওয়ায় সহজাত জলমগ্ন ছিল। জলমগ্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে একটি ফসলও পাওয়া যেত। তা তাড়াতাড়ি তুলতে হবে। শুরু হয়ে যেত ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। নৌকা নিয়ে সদলবলে ধান কাটা হতো। বিলে নৌকাতেই যেতাম। জলের সর্পিল ও বর্ণিল পথ পেরিয়ে ধান নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি ভিড়ত নৌকা। পাহারায় থাকতাম যেন ধান চুরি না হয় কিংবা পশু-পাখি খেয়ে না ফেলে। এমন ক্ষণে ধানকেন্দ্রীক ফেরিওয়ালা থাকতেন। তারা ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকান যেন। ধানের ‘মুরি’ দিলে আন্দাজমতো খাবার দিতেন। মুরি মানে একগুচ্ছ কাটা ধানের আঁটি। একটা সময় বাড়িতে আসত ধান। মাড়াই থেকে সিদ্ধ করা এবং চালে রূপান্তর করা পর্যন্ত কত কাজ! বাড়ি বাড়ি থেকে গরু নিয়ে আসতাম। উঠানে ‘মলন’ হতো। তখনো যান্ত্রিকতার ব্যবহার আসেনি। মা লোক নিয়ে ধান সিদ্ধ করতেন। অনেক কষ্টের কাজ। ধান উঠানে রোদে শুকাতে দিতাম। পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সারাক্ষণ বসে থাকতাম। এমনো হয়েছে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এসেছে। তার আগেই ধান ঘরে নেয়া হতো। খুব দুর্যোগে পড়শিরা এগিয়ে আসতেন। এক সময় ধান ভাঙানো হতো। রিকশা করে দূরে ‘মেশিন ঘরে’ নিয়ে যেতাম। ভাঙানোর কাজে সাহায্যকারী নারীরা চাল চুরি করার চেষ্টা করতেন। কড়া পাহাড়া দিতে হতো। অল্প-স্বল্প ধান মাথায় করে কিলোমিটার দূরত্বে ভাঙাতে নিয়ে গেছি। এ কাজে সহায়ক ছিলেন বর্তমানে চিকিৎসক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ বড় ভাই। বড় ভাই কবি মোহন্ত কাবেরীকে কখনো ধান ভাঙানোর সুযোগ দিলে চাল ঠিকমতো আসত না। এক সময় নতুন চালের ভাত রান্না হতো। গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। ধান চাষের পুরো প্রক্রিয়ার শুরুতে ধানকে বীজ করা হতো। মাটির পাত্রে জাগ দিয়ে রাখা হতো। চারার জন্য আলাদা জমি বরাদ্ধ ছিল। কখনো যদি চারা করার প্রস্তুতি না থাকত সেই মৌসুমে চারা কিনতে হতো। সেই চারা বাবা-ভাইসহ তুলতে যেতাম। অদ্ভুত দৃশ্য ছিল বালকবেলার জন্য। সবুজ কচি ধানগাছ আঁটি বাঁধা হতো। তোলার আগে পুরো খেতটিতে সবুজ কার্পেটে ছাওয়া মনে হতো। ধান ও ধানখেত নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। ধানখেতে গিয়ে নানা রঙের ফড়িং ধরেছি। বালকবেলায় বোধোদয় হতো না এ বিস্তর অন্যায়। ধানের প্রকার চিনতাম না। বাড়ির পাশে নানা রঙের ধান হতো। কানের কাছে নামগুলো বাজত। পাইজম, বুড়ো, জলি, হাসা, বাইগন বিচি, জিরা, ফসুয়াল, কাইট্টল, নাজিরশাইল, বশাল- এসব নামগুলো মনে আছে। জলি ধানের ভাত হতো নীল রঙের। এখন বুঝি এ ধরনের চালের ভাত পুষ্টিকর।
একটি বিষয় খুবই মজার। পোলাও চাল পাওয়ার জন্য খেতের একটি অংশ ভিন্ন ধান চাষ করা হতো। ধান পাকলে মনে হতো খেত যেন পতাকার আদল নিয়েছে। কিংবা সবুজ-নীল রঙের একটি জীবন্ত চিত্র বিশাল প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে।
ছেলেবেলায় ধান কাটার মৌসুমে অঞ্চলে ঘুরতেন নানা ফেরিওয়ালা। ধানের বিনিময়ে তাদের কাছে মজাদার খাবার পাওয়া যেত। ধান দিয়ে আইসক্রিম খেতাম আমরা। যতটুকু ধান ততটুকু মুড়ি কিনেছি; মজাদার হাতে ভাজা মুড়ি।
এমনো দেখেছি পুরো অঞ্চলে উৎসব। কারণ ধান কাটা হয়েছে। সবাই স্বয়ংসম্পূর্ণ তখন। এর বিপরীত চিত্রটি মর্মান্তিক। অনেক ধার-দেনা করেও অনেকে জমি চাষ করেছেন। ফসল যখন ঘরে তুলবেন তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। হয়তো পানিতে ডুবে গেছে পুরো ধানের খেত। না হয় শিলাবৃষ্টি মাড়িয়ে গেছে। তখন অভাবে মোড়ানো অঞ্চল যেন অদৃশ্য ব্যথায় কাতর। বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় ততটা আঁচ লাগত না এসব দুর্যোগে।
আরেকটি বিষয় ছিল অ্যাডভেঞ্চারময়। বিলের ধানের জমিতে পানি দেওয়া হতো। ডিপ ওয়েলের পানি তোলা হতো নদী থেকে। অস্থির-চলমান-শীতল জলধারায় মনের খুশিতে মেতে উঠতাম। এক সময় ইরি চলে এল। কাছের যাকে আমাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘টানের জমি’; তাতেও পানি দিতে দেখতাম। কলের জলে গোছলও করেছি। ধান আমাদের কৃষ্টি-সৃষ্টিতে মিশে আছে। ধান কাটার মৌসুম শেষে ধানের পুরো প্রক্রিয়া শেষে ঘরে ‘টাইলে’ তুলে রাখা হতো। মাঝে মাঝে সেইসব ধান রোদে দেওয়া হতো। গরমে ‘টাইলে’র ভেতর ঘাম ছুটে ভিজে যেতাম; যেন গোছল করেছি।
একান্নবর্তী পরিবারে চাচা বরকত উল্লাহ মাঝে মাঝে ফসল বিক্রি করে দিতেন অগোচরে। ছোট ও বালক হওয়ায় ঘরেই থাকতাম আমি। খুবই চঞ্চল প্রকৃতির হওয়ায় আমি চারপাশ অবলোকন করতাম। চাচা বিষয়টি বুঝতে পেরে ‘তার প্রয়োজনীয় কাজে’ আমাকে সহায়ক বানিয়ে ছিলেন। তার কথা আমি ‘টাইল’ থেকে বস্তা ভরে নিয়ে যাব, তুই পাহারা দিবি। দিতাম পাহারা। কারণ ধান বিক্রি শেষে তিনি ২০-৩০ টাকা ধরিয়ে দিতেন। বলছি আশির দশকের কথা। ওই সময় আট-দশ বছরের একজন বালকের কাছে ওই অর্থ অনেক।
একটি সময় মনে হলো কাজটি অন্যায় করছি। স্বভাবমতো কাকা পাহারাদার আমাকে বলে টাইলে ওঠে গেলেন। আমি কাকাকে শুনিয়েই বললাম- প্র¯্রাব করে আসি। এ সুযোগে আরেক কাকার বাড়িতে গল্প করতে যাওয়া মাকে বলে এসেছি- কাকা যে টাইলে ওঠে ধান চুরি করছে। মা দৌড়ে চলে এলেন। কাকা ধরা পড়ে গেলেন।
অসংখ্য স্মৃতি মনের কোণে। আহা সেই বালক ও গ্রামীণ বেলা। যদি ফিরে পেতাম?
ধান কাটা কিংবা ধানের পুরো সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেক মানুষ বেঁচে থাকেন। যেমন ধানগাছ বুনতে হবে; ক্ষেত হালচাষ করে উপযোগী করতে হবে। এর জন্য গৃহস্থের বলশালী গরু থাকা চাই- যাকে বলে হালের গরু। ধান রোপনের সময় কাজের মানুষ লাগে। খেত নিড়ানি দিতেও লাগে। একটি সময় খেতের ধান পেকে গেলে খুব দ্রুত সময়ে ঘরে তুলতে হতো। শ্রমিক নেওয়া হতো টাকার বিনিময়ে। কিছু মানুষ এ সময় কাজ করতেন যারা সচরাচর অন্যের বাড়িতে কাজ করেন না। তাদের কাজ করে খাওয়াও লাগে না। কিন্তু সামাজিক প্রয়োজনে অন্যের জমির ধান কেটে দেন। নিজের জমির ধান কাটার সময় তাদের নিয়ে নেন। হয়ে গেল শোধবোধ। ধান কাটার সময় আমাদের অঞ্চলের মানুষদের ভালো করে খাওয়ানো হতো। যেন একটি উৎসব-পিকনিক ভাব। কষ্টসহিষ্ণু মানুষ দশ-বিশজন একসঙ্গে খেয়ে যাচ্ছে। তারা খেতেও পারত প্রচুর।
গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় এক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা অপরাধপ্রবণ ছিলেন। এখন সামাজিকভাবে বসে তাকে কাজ দেওয়া হয়েছে- ধানখেত পাহারা দেওয়ার। ধানকাটার সময় তিনি প্রত্যেকের কাছ থেকে মুড়ি বুঝে নিতেন। অরেক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা গ্রামে গ্রামে খতনা করে বেড়ান। তাদের বলা হয় খলিফা; গ্রামীণ ভাষায় হাজাম। তারাও ধান কাটার সময় খেতে হাজির হতেন। মুড়ি নিয়ে দিব্যি খুশি তারা। এটিই তাদের সারা বছরের প্রতি পরিবারে খৎনা করার পারিশ্রমিক। আরেক শ্রেণির মানুষ আছেন যাদের জীবন মানবেতর। তারা সারা বছর জীবীকার প্রয়োজনে নানা কাজ করে বেড়ান। তাতেও তাদের জীবনে সচ্ছলতা আসে না। তারা অভাবী শ্রেণির। ধান কাটা থেকে শুরু করে প্রত্যেকের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়াটিতে অনেক শস্যের অপচয় হয়। তারা বিশেষ পারদর্শিতায় সেই ধানগুলো ঝাড়ুর সাহায্যে সংগ্রহ করেন। ধান কাটার পর তাদের মতোই আরেক শ্রেণির দেখা মেলে। তারাও অভাবী মানুষ। ধান কেটে নেয়ার পরও গাছের যে অংশ মাটিতে থেকে যায় তা কেটে নেয়া তাদের কাজ। এটি তাদের পরিবারের রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়।
মোট কথা গ্রামীণ পরিবেশে ধান রোপন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত সময়টি একটি দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী কর্মযজ্ঞ। এ কর্মযজ্ঞ চলে বছরব্যাপী। এভাবেই গ্রামের মানুষ বেঁচে থাকেন।
ধান তাদের অন্নের সংস্থান করে। ধানই তাদের জীবন। ধান তোলা হয়ে গেলে উৎসবের জীবন কাটে তাদের। ধানের চালে পিঠাণ্ডপুলি হয়। নবান্নের উৎসব চলে। গ্রামের বধূটি হাট থেকে কেনা নতুর কাপড় পান। ধান তুলে গড়ে ওঠে মসজিদণ্ডমাদ্রাসা-মক্তব-এতিমখানা। ধান তোলা হয়ে যাওয়ার পর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন চলে। মোট কথা ধান আমাদের বাঙালির প্রাণে শিহরণ তোলে। উদরের পুর্তি করে। এভাবে সময় পরম্পরায় ধান আমাদের কৃষ্টি-সৃষ্টির অংশ।