‘ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা ঠেকাও’ নামক একটা প্রবাদ আছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে প্রবাদটি যথার্থ। এর ভাবার্থ করলে দাঁড়ায় দাম কমাতে অসামর্থ্য হলে বৃদ্ধিটা অন্তত ঠেকান! রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান সরকারের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। নাকি ধরে নেবো, সর্ষেতে পুরোনো ভূত আজও রয়েই গেছে? এই ভূত তাড়াতে কি আবার মহাযজ্ঞ করতে হবে? বেকায়দায় পড়লে নাকি যাত্রী চলন্ত রেলের শিকল টানে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানবে কে? কে বাঁধবে মূল্যবৃদ্ধির হুলোবেড়ালের গলায় ঘণ্টা? যা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই। তার সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে পাবলিক। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে, তবু পাতে যেন নুন পড়ছে না। দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পরে বাঁচারও উপায় ক্রমশই ক্ষয়ে আসছে। বিগত সরকারের আমল হতে দ্রব্য মূলের এই কল্পিত পাগলা ঘোড়ার বিরামহীনভাবে ছুটছে। এখনো থামবার নাম নেই। এদিকে মানুষের নাভিশ্বাস দশা।
এভাবে আর কিছুকাল চলতে থাকলে দেশে দুর্ভিক্ষ হবার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। অথচ নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘যে দেশের গণমাধ্যম স্বাধীন সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না’। মিঃ সেনের কথানুযায়ী আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য গণমাধ্যমের কোনো দায় আছে কি না তা ভেবে দেখা উচিত। গণমাধ্যম সঠিক চিত্র তুলে ধরছে কি না তাও আলোচনা সাপেক্ষ। দুর্ভিক্ষ খাদ্যাভাবে হয় না। দুর্ভিক্ষ হয় খাদ্যের সঠিক বণ্টনের অভাবে।
মানুষের আয় স্থির হয়ে আছে। কিন্তু ব্যয় অস্থির। যেন অনন্ত বহতা নদী। শিশু শিক্ষায় খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পে পড়েছি। গল্পে খরগোশ দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে লক্ষ্যদণ্ড ছোঁয়ার আগেই জিরিয়ে নেয়ার অযুহাতে ঘুমিয়ে পড়লো। আর কচ্ছপ ধীরে ধীরে গিয়ে লক্ষ্যদণ্ড স্পর্শ করে বিজয়ী হলো। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নামক খরগোশের যেন দম নেয়ার ফুরসত নেই। আর আয় নামক কচ্ছপটি ধীরেপায়ে এসে গল্পের সেই খরগোশের গতির সামনে কুলাতেও পারছে না। খাদ্য তালিকা থেকে পুষ্টি বিদেয় নিয়েছে অনেক আগেই। যে দেশে মৌসুমকালে আলু ও মুলা আকাশচুম্বী দাম। সে দেশের গরিবের পাতে পুষ্টি থাকে কি করে! ব্রয়লার মুরগি ও পাঙ্গাশ মাছ দুইশ’ টাকা কেজি।
তাহলে গরিব মানুষ খাবে কি? গরু, খাসি, দেশি মুরগি, রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল মাছ এগুলোয় তো গরিবের চোখ দেয়াই পাপ। কিনে খাওয়া তো দূরের কথা। অবস্থা এমন হয়েছে যে কখন জানি গরিবের পাত থেকে ভাতও বিদেয় নেয়। বিগত চার মাসে মোটা সরু সব ধরনের চাউলের যে হারে মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে তাতে এই শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্তর্বর্তী সরকার এরইমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৬টি কমিশন গঠন করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষ্য অনুযায়ী আগামী জানুয়ারি নাগাদ কমিশন রিপোর্ট পেশ করবে।
তারপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। আরো ভালো হতো যদি উপদেষ্টা মহোদয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হ্রাস বিষয়ক একটা কমিশন গঠন করে দিতেন। তাহলে জানা যেতো কীভাবে মূল্যবৃদ্ধি পায়? এর পিছে কারা কলকাঠি নাড়ায়? কারা সিন্ডিকেট নামক সর্বগ্রাসী দানব তৈরি করে মানুষের পকেট কাটে? এই তারা কি রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী? তাদের কি রুখে দেওয়া সম্ভব নয়? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকানোর কলাকৌশল কি? দেশে বর্তমানে শতকরা ২৯ শতাংশ মানুষের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে ৬.৫ শতাংশ।
উপদেষ্টাগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাসকারী কিছু মানুষের বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। দেখে আসুন তারা কি খাচ্ছে? আব্বাসীয় খলিফা হারুনর রশীদ রাতে ছদ্মবেশে প্রজাদের সুখ-দুঃখ স্বচক্ষে দেখতে বের হতেন। রাত্রিতে নয় আপনারা দিনের আলোতে প্রজা নামক পাবলিকের হাঁড়ির খবর জেনে আসেন। বুঝতে পারতেন মানুষ কত কষ্টে আছে। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথম উপাদানটি হচ্ছে অন্ন। আর এই অন্ন সংস্থান ব্যতিরেকে অন্য যতোই সংস্কার করেন না কেন, তা খুব বেশি কাজে আসবে বলে মনে হয় না। পাতে ভাত না থাকলে জনগণ সংস্কার ও উন্নয়ন ধুয়ে পানি খাবে না।
ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে চরম দরিদ্র্যসীমার নিচে ৪ কোটি ১৭ কাখ মানুষ বসবাস করে। এরমধ্যে শতকরা ৮৭ ভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে। তারমানে এর অর্থ দাড়াচ্ছে গ্রামে বসবাসকারী মাত্র ১৩ ভাগ মানুষের পেট পুরে খেতে পাচ্ছে। বাকি ৮৭ ভাগ মানুষের অবস্থা নাজুক। তারা আদৌও খাবার পাচ্ছে কিনা তা তালাশ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তারা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। মানুষের ব্যয়ের সাথে আয় কুলাচ্ছে না। মূল্য বৃদ্ধিতে কুলাতে না পেরে প্রতিনিয়ত খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
বিগত সরকারের আমলে মূলবৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হতো। সিন্ডিকেট নাকি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কুশীলবরা এর সাথে জড়িত ছিল বলে জানা যাচ্ছে। এই বৈষম্য নিরসনের জন্য ছাত্র জনতা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বসিয়েছে।
এখন তো আর সিন্ডিকেট থাকার কথা নয়। তাহলে এখনো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করা যাচ্ছে না কেন? নাকি সব সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের সফলতা বিফলতা নিয়ে টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চুলচেড়া বিশ্লেষণ হয়েছে। সফলতা ও সীমাবদ্ধতার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি কেন ঠেকানো যাচ্ছে না এই বিষয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ও কৌশলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন।
রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের মহানতম দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এটি নিসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যদিও বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কানাঘুঁষা চলছে। কোন রাজনৈতিক দল মনে করছে সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া এর কোনো নিদিষ্ট সীমারেখা নেই। আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আগে সংস্কার পরে নির্বাচন এই ধরনের মত ব্যক্ত করেছেন। সর্বোপরি বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের একটি মোটামুটি স্থিতাবস্থা নিশ্চিত করেই নির্বাচন আয়োজন করবেন বলে মনে হচ্ছে। বিগত সরকারের সময় করোনা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ডলার সংকটের কথা বলে সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে। করোনা বাদে বাকি সংকটগুলো এখনো বিদ্যমান। বরং এর সাথে নতুন সংকট যুক্ত হয়েছে ইসরায়েল ফিলিস্তিন লেবানন যুদ্ধ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন। সংকট থাকবেই। সংকট উত্তরণের জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বর্তমান পুঁজিবাদী সিস্টেমে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ গুটিকয় লোকের নিকট জিম্মি। বাকিরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। খোদ বাংলাদেশেই দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে শতকরা ২৯ ভাগ লোক। অথচ দেশে অগণিত নতুন নতুন কোটিপতি তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির দুষ্টচক্র ও কালোটাকা তৈরিতে সরকারগুলোর প্রচ্ছন্ন সহায়তা এই বৈষম্য তৈরির আগুনে ঘি ঠেলেছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রকাশিত ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন’-এ বলা হয়েছে বাংলাদেশের শতকরা ২৬ ভাগ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এটা গত বছরের নভেম্বরের জরিপের তথ্য। বর্তমান তথ্যের হালনাগাদ পাওয়া গেলে বোঝা যেত বর্তমান অবস্থা কেমন। বাস্তবতা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য কমাতে না পারলে গণআসন্তোষ তৈরি হবে। গণআসন্তোষ গণবিরোধী মনোভাব সৃষ্টিতে সহায়ক। জনগণ তখন সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। অতএব দেশে স্থিতিশীলতা আনয়নে দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব না হলে অন্তত বৃদ্ধি ঠেকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট