ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উৎপাদন বাড়িয়ে ভারতনির্ভরতা কমাতে হবে

মিজানুর রহমান
উৎপাদন বাড়িয়ে ভারতনির্ভরতা কমাতে হবে

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের মহিলাদের পছন্দের কাপড় ছিল ভারতীয় শাড়ি। কারণ, আমাদের দেশে যে শাড়ি তৈরি হতো তা মানে যথেষ্ট ভালো ছিল না। রং পাকা ছিল না। কিন্তু ভারতীয় শাড়িতে আস্থা হওয়ার কারণ, রঙে ছিল পাকা। কীভাবে পাকা রঙের কাপড় তৈরি করতে হয়, তা শিখতে আমাদের তেমন বিলম্ব হয়নি। বাংলাদেশের শাড়ি শতভাগ মান নিয়ে ফিরে এলো। ভারতীয় শাড়ি আমাদের শাড়ির কাছে হারতে বাধ্য হলো। তাই তো ভারতে আমাদের টাংগাইল শাড়ি (জিআই পণ্য হিসেবে গণ্য), জামদানি শাড়ি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও চাহিদার শীর্ষে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা সফল হয়েছি। পশু পালনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে বেশ সময় লেগেছে। আমাদের কোরবানিটা নির্ভর করত ভারতীয় পশুর ওপর। কোরবানি উপলক্ষে প্রতিবছর গরু, ছাগল, ভেড়া আমদানি করতে হতো। গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক এবং এনজিওগুলো ব্যাপকহারে গ্রামে পশুবর্গা ঋণ দিতে শুরু করে। অতি দ্রুত গরু মোটাতাজাকরণ খামারও গড়ে ওঠে। খামারিরা লাভবান হতে দেখে খামারের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। মৎস্য ও পশুসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩০টি, ২০২৪ সালে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি। এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি। তাহলে কোরবানি দেয়ার পরও পশু অতিরিক্ত ছিল প্রায় ২২ লাখ। অর্থাৎ বর্তমানে পশুতে কোনো প্রকার ঘাটতি আমাদের নেই। বিগত পাঁচ বছর ধরে দেশ ভারত থেকে কোনো গরু আমদানি করেনি। সেটা সম্ভব হয়েছে আমাদের কৃষকদের দ্বারা। দেশে এক সময় প্রচুর আলু উৎপাদন হতো। সরকার ভাতের উপর চাপ কমাতে আলু খাওয়ার অভ্যাসের কথা বলেছিল। ভাতের পরিবর্তে আলু খাও, এটা স্লোগানও ছিল। আলুর সহজলভ্যতার কারণে দেশ আলু দিয়ে অনেক খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তার মধ্যে চিপসামগ্রী অন্যতম। আলু রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। কিন্তু সে আলু এখন আর আগের মতো চাষ হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ কোটি ১৬ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ মেট্রিক টন। দেশে আলুর চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম নয়। কিন্তু আলু পচনশীল। ৩০ শতাংশ আলু কোল্ড স্টোরে যাওয়ার আগেই পঁচে যায়। যেহেতু আলু কোল্ড স্টোরে রাখা হয়, এ সুযোগটা ব্যবসায়ীরা কাজে লাগায়। মজুদের কারণে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়। বাজারে এর প্রভাবে দাম বেড়ে যায়। আলু যদি কৃষকেরা সরাসরি বাজারে দিতে পারতো তাহলে এ সমস্যা হতো না। আলু গরিবের খাদ্য। দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়। তাই সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে আলু আমদানি করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে ২০২৩ সালের আগে কখনও আলু আমদানি হয়নি। বরং প্রতি বছর আলু রফতানি করেছে। ২০২৩ সালে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য অক্টোবরে আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২৩-২৪ অর্থববছরে ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৭ লাখ ডলারের আলু আমদানি করেছে। কৃষকরা একটু দায়িত্বশীল হলে অনায়াসে আলুর এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। প্রয়োজনবোধে কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। এতে করে আলু উৎপাদনে উৎসাহিত হবে। পেঁয়াজের ঝাঁজ মাঝে মাঝে পোহাতে হয়। উৎপাদনে ঘাটতি হওয়ার কারণে অমনটি হয়ে থাকে। পেঁয়াজের এই সমস্যা অনেকদিন যাবৎ। দেশে পেঁয়াজ নিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রত্যেক সরকারের সময় হয়েছে। পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য প্রতি বছর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থছরের জন্য ৩৭ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সেই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রায় ৩৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫-৩০ শতাংশ সংগ্রহের পূর্বেই নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের কোনো আধুনিক ব্যবস্থা নেই। যার ফলে পেঁয়াজে ঘাটতি হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ কম পড়ে। পেঁয়াজ সাধারণত ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন। উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে এই চাহিদা পূর্ণ হওয়া উচিত। কিন্তু ২৫-৩০ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদনজনিত কারণে বিনষ্ট হয়ে যায়। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পেঁয়াজ-রসুন জাতীয় পণ্যের রপ্তানি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু এ বছরই ২০ কোটি ডলারের পণ্য পাঠিয়েছে ভারত। বাংলাদেশে বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ হয়ে থাকে। এ পেঁয়াজ চাষের জন্য কৃষকদেরও সহযোগিতা করা দরকার। এ পেঁয়াজের মানও ভালো। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন সম্প্রসারিত করা হলে আর চাহিদার ঘাটতি থাকবে না।

আওয়ামী সরকারের আমলে দেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করা হতো। কিন্তু চাল আমদানি থেমে থাকেনি। তাহলে স্বয়ংসম্পূর্ণতার তথ্য কি সঠিক ছিল? এটা কি রাজনৈতিক তামাশা ছিল? এভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনীতি করার সার্থকতা কী? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে জানা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশে চাল আমদানির তথ্যে বছরভেদে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। একেক বছরের আমদানি একেক রকম। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেড় কোটি ডলারের চাল রফতানি করা হয়েছিল বাংলাদেশে। তবে এর আগের অর্থবছরে ৩১ কোটি ডলারের চাল রফতানি করা হয়। উৎপাদনের গড়মিলের কারণে অমন অবস্থা হচ্ছে। যেমন সর্বশেষ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ কোটি ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৪ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন। তাহলে এখানে পরিকল্পনা মোতাবেক ফসল উৎপাদন না হওয়ায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল আমদানি করতে হয়।

অন্যদিকে জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক ডাটাবেইজ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৮ কোটি ডলারের বেশি চাল রফতানি করেছে ভারত। পরিমাণের দিক থেকে ২ লাখ ১৫ হাজার টন প্রায়। অবশ্য ভারত ছাড়াও ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ড থেকেও চাল আমদানি করে বাংলাদেশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ২০২৪ সালে দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়ার আশংকা রয়েছে। কৃষক-লেবার খরচ, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে ফসল উৎপাদনে ক্ষতির শিকার হওয়ায় ফসল উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ না হলে ফসল উৎপাদনে লাভবান হওয়াটাও দুষ্কর।

কাঁচামরিচ কোনো সময়ই বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়নি। এবারের বর্ষা মৌসুমে কাঁচামরিচের কেজি ছয়শ’ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। ২০২৩ সালেও কাঁচামরিচ আমদানি করতে হয়েছে। এক সময় আমাদের মা-চাচিরা বাড়ির আঙিনায় কাঁচামরিচের বীজ বপন করে সারা বছর পারিবারিক কাঁচামরিচের চাহিদা পূরণ করতেন। এখন তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। চীন শীতকালীন সবজি বর্ষাকালে আবাদ করে সারা বছরের চাহিদা বাস্তবায়ন করছে। আমাদের দেশে বর্ষাকালে কিছু কিছু এলাকায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় সবজি চাষাবাদ হচ্ছে। এ চাষাবাদ আরো সম্প্রসারণ করা গেলে সবজির চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। আর নতুবা এ সব নিত্যপণ্যের ঘাটতি থেকেই যাবে।

গত দুই বছর ডিমের বাজারে অস্থিরতা সরকারকে নাড়া দিয়েছে। ডিম কখনো আমাদের আমদানি করতে হয়নি। কিন্তু এ বছর ডিম নিয়ে হাহাকার শুরু হয়। দেশে ডিম উৎপাদনের তথ্য নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মতভেদ রয়েছে। উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতভেদ আছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পোল্ট্রি শিল্পের উদ্যোক্তাদের মাঝে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস)-এর মতে, দেশে ডিমের মাথাপিছু বার্ষিক চাহিদা (আনুমানিক) ১০৪টি। সেই হিসাবে ১৭ কোটি জনসংখ্যার জন্য বছরে ১ হাজার ৭৬৮ কোটি ডিমের প্রয়োজন এবং গড়ে প্রতিদিনের চাহিদা দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮৪ লাখ ডিম। ডিএলএসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বার্ষিক মাথাপিছু উৎপাদন ১৩৫টি। জনসংখ্যার বিবেচনায় বছরে ২ হাজার ২৯৫ কোটি এবং গড়ে দিনে ৬ কোটি ২৮ লাখ ডিম উৎপাদন হওয়ার কথা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, হঠাৎ করে ডিমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে ডিমের চাহিদা ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৯ কোটি ৩০ লাখ ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। দেশের ৪৩টি প্রতিষ্ঠানকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে অক্টোবর মাসে দুই দফায় ১৯ প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৮ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দেয়। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অনুমতি বলবৎ থাকবে। এ সকল ডিম আসবে ভারত থেকে। আমাদের পোল্ট্রি ফার্মের খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেক পোল্ট্রি ফার্ম বন্ধ হয়ে গেছে। এ জন্য ডিমের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ডিম আমদানি করে আমাদের খেতে হয়, এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে ডিম উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে খামারিদের ভূমিকা নিতে হবে। ডিম আমদানি করা হলে একদিন আমাদের খামারিদের ডিমের বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে। কারণ, ভারতীয় ডিম স্বস্তায় মেলে। দেশের স্বার্থে ডিমের কথিত সিন্ডিকেটও নির্মূল করা দরকার। সরকার খামারিদের স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর। কৃষি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা হতে পারিনি। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও তা বাস্তবায়ন, বাজার ব্যবস্থার উন্নতি ও মনিটরিং করা, সিন্ডিকেট নির্মূল করা, কৃষিবীমা চালু করা, কৃষিপণ্য সরবরাহের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, কৃষিপণ্যের মজুদের ব্যবস্থা, সর্বোপরি স্বল্পসুদে সহজ শর্তে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ সহায়তা পেলে কৃষক তার মেধা দিয়ে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ করে ফেলবে। আমরা তাদের পাশে থাকলে কারো প্রতি দেশকে নির্ভরশীল হতে হবে না।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত