ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে হবে

সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে হবে

মূল্যস্ফীতির লাগাম যেন কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। হু হু করে বাড়ছেই। এতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, তাদের আয় বাড়েনি। ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সীমা অতিক্রম করে গেছে। কষ্টে কাটছে তাদের জীবন। দীর্ঘদিন ধরেই এ পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে। সীমিত আয়ের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অবস্থা কাহিল। তারা আয়ের সাথে ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না। মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান কমে যাওয়ায় যা আয় করে, তা দিয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কিনতে পারছে না। মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড ১৩.৮০ শতাংশে পৌঁছেছে। গত এক বছর ধরে গড়ে ১০ শতাংশের উপরে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ড. আহসান এইচ মনসুর দুঃসংবাদ দিয়ে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে অন্তত এক বছর লাগবে। এর অর্থ হচ্ছে, নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য সহসা কমছে না। মানুষকে কষ্টের মধ্যেই থাকতে হবে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মূল্যস্ফীতি না কমার কারণ হিসেবে বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ভুল নীতির কথা বলেছেন। তবে, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্র্বতী সরকার দ্রুত নিত্যপণ্যের মূল্য তাদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসবে। তাদের এ প্রত্যাশা পূরণের পরিবর্তে নিত্যপণ্যমূল্য ক্রমাগত বাড়ছে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের অর্থনীতির মেরু- ভেঙে দেয়া হয়েছে। সীমাহীন লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থপাচার অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়েছে। তার পতনের পর এর পুরো বোঝা এসে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপর। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুই অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার কীভাবে অর্থনীতিকে প্রায় শূন্যাবস্থায় রেখে গেছে, তারা সে চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তা পুনরুদ্ধারে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে বিগত সরকারের দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি জানিয়েছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরে দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করা হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে হাসিনা সরকারের দুর্নীতিবাজরা শুষে খেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দ্রুত কিছু উদ্যোগ নিয়ে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে লুটপাট হয়ে যাওয়া ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে স্বল্প সময়ে পুনরুদ্ধার করা সহজ কাজ নয়। এজন্য সময় প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষ যে কষ্টের জীবন অতিবাহিত করছে, সবার আগে তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। কী করলে, কীভাবে করলে, সাধারণ মানুষ অন্তত কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে, এ বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। আমরা দেখেছি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, পশ্চিমাবিশ্বসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থাগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতি কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সে আশা পূরণ হচ্ছে না। প্রতিশ্রুত বিদেশি অর্থ দেশে আসছে কি না, কেন আসছে না, এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি না, তার আপডেট মানুষ জানতে পারছে না। তারা শুধু দেখছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় দেশের অর্থনীতি যে গতিতে এগুনোর কথা, সে গতিতে এগুচ্ছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না। বিনিয়োগকারিদের জড়তা কাটছে না এবং আস্থার সংকট রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে। সাধারণত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধি থেকে বিনিয়োগের চিত্র পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছর এই আমদানি ২৫ শতাংশ কমেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও শ্রমিক আন্দোলনের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে উদ্যোক্তারা মনে করছেন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নীতি সুদের হার অন্তরায় হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হয় না। উৎপাদন ব্যাহত হলে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ হ্রাস ও বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি জনজীবনে টানাপড়েন সৃষ্টি করে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। সাধারণ মানুষের যা প্রয়োজন, তা কিনতে পারে না। এতে পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। মানুষ কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়বৃদ্ধি ঘটে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ খুবই দুর্গতির মধ্যে রয়েছে। তারা আয় দিয়ে কোনোভাবেই চলতে পারছে না। প্রয়োজনের সাথে আপস করে চলতে হচ্ছে। এতে শারীরিক ও মানসিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত করার দিকে। তাদের আয়-ব্যয় কীভাবে হচ্ছে, কীভাবে দিন পার করছে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিদিন টিসিবির ট্রাকের সামনে দরিদ্রের পাশাপাশি নিম্ন থেকে মধ্যবিত্তের মানুষের ভিড় যে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে, তা থেকেই বোঝা যায়, পরিস্থিতি কতটা নাজুক। এই পরিস্থিতির দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। কীভাবে দ্রুত মানুষের কষ্টের জীবনযাপন সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও তাদের উত্তরণের পথ বের করতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে, তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিনিয়োগ ও ব্যবসাকে সহজ করতে হবে। বিদেশি যেসব আর্থিক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাদের তাগিদ দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বুঝতে হবে, দেশের মানুষ কষ্টে আছে। যেভাবেই হোক, তাদের কষ্ট দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে কোনো সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন নির্ভর করে দেশের মানুষের ভালো থাকার উপর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত