‘ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা, তুমি জান না কো, কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ওই পথ, ওই জাহাজ, শকট, অট্রালিকার মানে!’- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কুলি-মজুর কবিতার কয়েকটি লাইন থেকেই বোঝা যায় আজ আমরা যে আরামের অট্টালিকায় দিন কাটাই সেসব শ্রমিকের ঘামে গড়া। প্রতিটি ইটে লেগে আছে ঘাম। শ্রম, শ্রমিক এই দুয়ের উপরেই আজকের আধুনিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের সুউচ্চ অট্টালিকা শ্রমিকদের ঘামের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে তাজমহলকে নিয়ে আজ বিশ্বের এত মাতামাতি সেই তাজমহল তৈরিতে লেগেছে শ্রমিকদের ঘাম। অথচ আজকের সমাজে যেন কুলি-মজুর এবং সাহেব এই দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেছে। সভ্যতা যতই অগ্রসর হচ্ছে ততই এই বিভাজন শক্ত হচ্ছে। এই পার্থক্য গড়ছে অর্থ। যার অর্থ আছে সে মালিক। আর যার নেই সেই শ্রমিক! অথচ সবাই কাজ করে, ফলে সবাই শ্রম দেয় অর্থাৎ শ্রমিক। তবু মালিকের ভূমিকায় যারা আছেন তারা এই সহজ সত্য উপলদ্ধি করতে পারে না আর পারলেও তা স্বীকার করতে চান না। এতে তাদের আরামণ্ডআয়েশের অসুুবিধা হবে। শ্রম ও শ্রমিক শব্দ দুটি একে অপরের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। শ্রমিকের কাজের সাথে জড়িত কয়েকটি বিষয় ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এর মধ্যে কর্মপরিবেশ, ন্যায্য পারিশ্রমিক, কর্মঘণ্টা, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা এবং কাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছিল কর্মঘণ্টাকে কেন্দ্র করে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বহু জল গড়িয়েছে। শ্রমিকের কর্মঘন্টা কমেছে। তবে এখনও অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। কথায় কথায় ছাটাইয়ের শিকার হয়। নারী শ্রমিকের দুর্দশা তো আরো একধাপ এগিয়ে। কাজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয় অনেকে। তারপর বেতন বৈষম্য তো থাকেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বৈশ্বিক মজুরি রিপোর্ট ২০২৪-২৫: বৈশ্বিক মজুরি বৈষম্য কি কমছে?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ দেশে মজুরি বৈষম্য কমছে। আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালের শুরু থেকে মজুরি বৈষম্য অনেক দেশে গড়ে বছরে শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। আইএলও জানিয়েছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে গত দুই দশকে মজুরি বৈষম্য বার্ষিক গড়ে ৩ দশমিক ২ থেকে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হারে কমেছে, যা বৈশ্বিক হারের চেয়ে অনেক বেশি।
ধনী দেশগুলোতে এই হ্রাসের হার তুলনামূলক ধীর গতির। উচ্চণ্ডমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বৈষম্য বার্ষিক শূন্য দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং উচ্চ আয়ের দেশে শূন্য দশমিক ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে কমেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী মজুরি বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে দ্রুততর হয়েছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক বাস্তব মজুরি ১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৪ সালে প্রাক্কলন বৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হয়েছে, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে মুদ্রাস্ফীতির চাপে মজুরি বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ থেকে এ বৃদ্ধি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নআয়ের ১০ শতাংশ শ্রমিক মোট বৈশ্বিক মজুরির মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পান। অন্যদিকে সবচেয়ে উচ্চ আয়ের ১০ শতাংশ শ্রমিক পান প্রায় ৩৮ শতাংশ। নিম্নআয়ের দেশগুলোতে মজুরি বৈষম্য সবচেয়ে প্রকট। এসব দেশে প্রায় ২২ শতাংশ শ্রমিক নিম্ন মজুরি পান। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশেও তাৎপর্যপূর্ণ মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান।
সভ্যতার আধুনিকায়নের সাথে সাথে সমাজে শ্রেণি বিভাজন গড়ে ওঠে। নগর সভ্যতা বিকশিত হওয়ার শুরু থেকে এই বিভাজন আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদল মালিক শ্রেণি এবং অন্যদিকে থাকে শ্রমিক। এক শ্রেণি ভোগবাদিতাকে গ্রহণ করতে থাকে এবং অন্যশ্রেণি তাদের ভোগের রসদ যোগান দিতে ব্যস্ত থাকে। শ্রম দিয়েই সভ্যতার অগ্রযাত্রা আজ অবধি প্রবাহিত হয়ে চলেছে। আজ আমাদের অর্থনীতির এক বিপুল শক্তি বা জিয়োনকাঠি হলো গার্মেন্টস শিল্প। এই খাতে লাখ লাখ নারী পুরুষ দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে। তাদের ঝরানো ঘামেই আমাদের অর্থনীতিতে প্রাণ এসেছে। অর্থনীতি বেগবান হয়েছে। আজ যখন সারা পৃথিবীতে করোনার মহামারি চলছে, যখন সবকিছু বন্ধ তখন আমরা বেতনের দাবিতে কতিপয় গার্মেন্টেসের শ্রমিককে রাস্তায় বিক্ষোভ করতে দেখেছি। আমরা যখন ঘরে নিরাপত্তা খুঁজছি, সেসব শ্রমিক রাস্তায়। এরা আমাদের দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাদের হাতেই, তাদের ঘামেই দেশের উন্নয়নের ইট গাঁথা হচ্ছে। যত বড় বড় স্থাপনা হয়, অবকাঠামো হয় সেগুলো তৈরি করে যারা তারাই তো সেই মহান মানুষগুলো। তাজমহল বানানোর পর সবাই তার জন্য বাহবা দেয় স¤্রাট শাহজাহানকে। অথচ একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে এই তাজমহল তৈরি করতে গিয়ে কত শ্রমিকের ঘাম ঝরানো আছে। সেসব মানুষকে কেউ মনেও রাখেনি। প্রশংসা যেন তাদের প্রাপ্য নয়। সবাই স¤্রাটকেই বাহবা দেয়! যদি শ্রমিকের ঘাম না ঝরতো তাহলে কোথায় থাকতো এই সুনাম? আজকের সভ্যতার প্রতিটি উন্নয়নের পেছনেই রয়েছে এই কুলি শ্রেণির মানুষের অবদান। আমরা সেই অবদান টাকা দিয়ে পরিশোধ করতে চেয়েছি মাত্র। তাও অনেক সময়ই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সমাজের স্যুট বুট পরা বাবু সাহেবদের কাছে ঘামে ভেজা মানুষের দাম কোনোকালেই ছিল না। আমরা তাদের মূল্যায়ন কোনোদিনই করতে পারিনি। অথচ আজকের সভ্যতার চারদিকে তাকালে যে বিলাসবহুল অট্রালিকা চোখে পড়ে, বড় বড় ইমারতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যে নির্মাণশৈলি আমাদের মনে কবিতার পঙতি এনে দেয় তার পেছরে রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের দু’হাতের শ্রম। আমরা কেবল এসব ইমারতের মালিককেই প্রশংসায় ভাসাই। পেছনে পরে থাকে এসব শ্রমিকের ইতিহাস। আমরা ভুলে যাই যে সভ্যতার রুপায়ণ ঘটেছে শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতে। অথচ সেই হাতুড়ির সঠিক মূল্য আমরা কোনোদিনই দিতে চাইনি। তারা বারবার অধিকার হারা হয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে তাই অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। আজ শ্রমিকদের জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা গেলেও আজও তাদের কাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা বিধান করা যায়নি। বিভিন্ন খাতে যে শ্রমিক কাজ করছে তাদের ন্যায্য পাওনার সাথে প্রতিটি কাজেই উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাক, তারাও নির্দিষ্ট সময় কাজ করুক এবং সম অধিকার ভোগ করুক।
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট