যান্ত্রিক সভ্যতার এমন রমরমা দাপট তথা দ্রুত থেকে দ্রুততর অগ্রগতি বা আগ্রাসী করাল থাবা মানবজীবনে আশীর্বাদ না অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসছে, তা বর্ণনা করতে বসে সর্বাগ্রে যে কথাটি বলে নেয়ার তাগিদ অনুভব করছি তা হচ্ছে, ‘লেখকরা কেবল নিন্দা করার জন্যই কলম ধরেন।’ যাদের উদ্দেশ্যে কলম ধরা তাদের প্রায় অনেকেরই মনে এই ধারণাটাই বদ্ধমূল হয়ে আছে। তাই আলোচনার প্রারম্ভেই একটা দৃষ্টান্তের অবতরণা করছি। ধরুন, এক বছরের একটি শিশু একটা খেলনা হাতে নিয়ে খেলা করছে। যে মুহূর্তে আপনি আরেকটি নতুন খেলনা নিয়ে তার সামনে হাজির হলেন, সেই মুহূর্তেই সে তার হাতের পুরোনো খেলনাটি ধপাস করে মাটিতে ফেলে দিয়ে নতুনটিকেই আঁকড়ে ধরে। হাত থেকে পড়ে গিয়ে হয়তো পুরোনোটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। হয়তো বা ফেলে দেয়া বস্তুটি নতুনটির চেয়ে আরো অধিক মূল্যবান ছিল। তবে অবুঝ শিশুটির তো তা জানার কথা নয়। তাই শিশুদের কেউ নিন্দা করে না। তাই বলে গুণগত মানের কোনোরূপ পার্থক্য বিচার না করে কেবল অতি উপাদেয়, অতি আরামদায়ক, অতি হালকা ও সূক্ষ্ম নতুন নতুন বস্তুর মোহে আপনার সাবালক ছেলেটিও যদি অনুরূপ কোনো কার্য করে থাকে, যা তার স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক, তা হলে আপনি কি তার নিন্দা করবেন না? ধরুন যান্ত্রিক সভ্যতার বদান্যতায় আপনার সাবালক ছেলেটি সারাক্ষণ ‘ইয়ার ফোন’ কানে লাগিয়ে গান শুনছে, যা তার কর্ণমূলের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে। অনুরূপ কাজে আপনি কি আপনার ছেলের নিন্দা করবেন না?
সেভাবে নতুনের প্রবল টানে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বস্তুসম্ভারকে যারা তাচ্ছিল্যভরে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বলতে ব্যবহারিক জীবনে পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে চাল-চলন, আদব-কায়দা, প্রেম নিবেদনের ঢং ও ভাষা, সাহিত্য তথা সংস্কৃতিচর্চা, শিল্পকলা ও বিনোদন প্রক্রিয়ায় অত্যাধুনিক রকমারি রং এবং মানবজীবনে প্রেম-প্রীতি ও ভলোবাসার স্থান ও সময় সঙ্কোচন তথা হৃদয়ক্ষেত্রের মরুভূমিতে উত্তরণ ইত্যাদিকে বোঝাবার চেষ্টা করছি। দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, ভুক্তভোগী মাত্রেই তাদের নিন্দা করছেন। তবে প্রকাশ্যে এসবের নিন্দা করার উপায় অনেকেরই নেই। মনে মনে তারা সৃষ্টিকর্তা-আল্লাহর দরবারেই তা নিবেদন করে মনের ভার লাঘব করার চেষ্টা করেন। তবে এ ব্যাপারে লেখক-কবিরা কিন্তু একধাপ এগিয়ে রয়েছেন। তারা কাগজ-কলমে তাদের মনের ক্ষোভ পাঠকদের দরবারে পেশ করে দেন। পার্থক্যটা কেবল এখানেই। আর সমস্যা সমাধানের দায় লেখকদের নয়, পাঠককুলেরই।
এই ক’বছরে আমাদের ব্যবহারিক জীবনযাপনের উপকরণগুলো যেভাবে দ্রুত পটপরিবর্তনের করাল গ্রাসে সমাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, বিগত পঞ্চাশ বছরেও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা তথা যন্ত্রপাতির নব নব উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা প্রণালীর মানও যে উন্নত হচ্ছে, তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ আমাদের চারিদিকে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি। মোবাইল আজ কীভাবে আমাদের এই প্রত্যন্তÍ অঞ্চলের আমজনতাকেও পেয়ে বসেছে, নিম্নোক্ত গানের কলিটিই হচ্ছে তার প্রমাণ- ‘ও টুনির মা, তোমার টুনিরে বোঝাও না/যখন-তখন মিসকল মারে, ফোন করে না।’ হ্যাঁ, সহজলভ্য এবং সঙ্গে নিয়ে বেরোনো যাবে, এমন টেলিফোনের কথা এ অঞ্চলেও আমরা ১০/১২ বছর আগেও কল্পনা করতে পরিনি? পনেরো বছর আগে ঘরের সামনেই পিসিও পেয়ে আমরা ভেবেছিলামণ্ড এই বুঝি আমাদের পৃথিবী। এর বাইরেও যে জগৎ রয়েছে তা আমরা চিন্তÍÍা করিনি! দেখলাম, দেখে আশ্চর্য হলামণ্ড মোবাইল এসে কেমন করে পিসিওকে দূরে হাটিয়ে দিল। ঘরের ল্যান্ডফোনও আজ অনাদরে-অবহেলায় বিদায় নেয়ার প্রহর গুনছে। অনেকটা বিদায় নিয়েও ফেলেছে।
বাস্তবিকই আজ আমাদের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে রং-বেরঙের বিভিন্ন আন্তÍÍর্জাতিকমানের গাড়ির বহর। অথবা নিদেন পক্ষে অসংখ্য অটোরিকশা। কেবল পকেটে টাকা থাকলেই কেল্লাফতে। উঠতে মোবাইল, বসতে মোবাইল- এটা যে আজ আমাদের চব্বিশ ঘণ্টার জীবনসঙ্গী! এটা ছাড়া আজ আমরা এক মুহূর্তও ভাবতে পারি না। অথচ ক’বছর পূর্বেও আমাদের এটার কোনো দরকারই ছিল না। নিদেনপক্ষে ল্যান্ডফোন তাও আমজনতার নাগালের বাইরে ছিল। চিঠির মাধ্যমেই আমাদের ব্যবহারিক জীবন দিব্যি কেটে গেছে। কোথাও আকাশ ভেঙে আমাদের মাথায় পড়েনি। আজ এক মোবাইল থেকেই রকমারি সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে নতুন প্রজন্ম। স্বল্প পরিসরে এসব বর্ণনা করার উপায় নেই। ঘরে বসে কম্পিউটারে আজ আপনি দেখে নিতে পারছেন ব্যাংকে আপনার কত টাকা অবশিষ্ট আছে। এছাড়া কম্পিউটারকে আপনি ডায়রি হিসেবেও ব্যবহার করতে পারছেন। ইন্টারনেটে আপনি কোনো বিদেশিনির সঙ্গে প্রেমপর্ব সেরে নিতে পারছেন অথবা এর সহযোগে সুদূর বিদেশ থেকেও আপনি দেখে নিতে পারছেন আপনার বাড়ির নারকেল গাছটি কত বড় হয়েছে কিংবা বিছানায় শুয়ে আপনার শিশু কীভাবে হাত-পা নাড়ছে! এটিএমের সাহায্যে যে কোনো মুহূর্তেও যে কোনো স্থানে আপনি ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে পারছেন। আজ আপনার মোবাইলে সংরক্ষণ করে রাখতে পারছেন পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত। প্রয়োজনে আপনি দেখে নিতে পারছেন এটা কত নম্বর আয়াত।
বলতে গেলে মাত্র ক’বছরেই যেন একই সঙ্গে আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের এসব অসংখ্য উপকরণ! এমনটি আগে কখনও দেখা যায়নি। তবে রাতারাতি এমন অত্যাধুনিক সুখী জীবন যাপনের সোনালি উপকরণগুলো লাভ করেও মানুষের নৈতিক অবক্ষয় দিন দিন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতেই আমাদের আক্ষেপ। মানব সভ্যতার বিকাশে সম্প্রতি বিজ্ঞানের এত আশীর্বাদ তথা এতগুলো অভিনব উপকরণ লাভ করেও আজ মানুষে-মানুষে এত হানাহানি, চারিদিকে প্রবঞ্চনা, সীমাহীন বিশ্বাসঘতকতা, দুর্নীতি, অভাব-অনটনের এতটুকুও কমতি নেই। বরং এগুলো যেন দিনকে দিন তীব্র গতিতে বেড়েই চলেছে! বিলেতের কায়দায় চলতে বাধ্য হয়ে আজ আমাদের প্রতিমুহূর্তেই হোঁচট খেতে হচ্ছে। কারণ, আয়ের ঢের তফাত আছে। আর এই গরমিলটা পুষিয়ে নিতেই আজ মানুষ জীবনের শাশ্বত তথা চিরন্তÍÍন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে অবলীলায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রাত-দিন কেবল টাকার পেছনেই ছুটছে! আজ আমাদের ঘরে ঘরে কেবল ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার তৈরির ধুম লেগে গিয়েছে। সিভিলিয়ান তৈরির পথ কেউ মাড়াচ্ছেন না! সমাজে যেন আজ জজ-ব্যারিস্টার, আইনজীবী, জেলা-প্রশাসক, এসপি, কমিশনার, অধ্যাপক, লেখক-কবি ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন নেই! আজকের দিনে ডাক্তাররা সমাজকে কী দিচ্ছেন অথবা রাত-দিন টাকা লোটা ছাড়া পরিবার-পরিজনদেরও তারা কতটুকু সান্নিধ্য দিচ্ছেন, মা-বাবা তো দূরের কথা, স্ত্রীকেই বা কতটুকু সান্নিধ্য দিচ্ছেন, সর্বোপরি এই দুর্লভ মানবজীবনের সুখ-শান্তিÍÍ কতটুকু বা তিনি নিজে উপভোগ করতে সক্ষম হচ্ছেন? তার লোলুপ দৃষ্টি যে সারাক্ষণ টাকার ওপরই সীমাবদ্ধ রয়েছে। মডার্ন যুগের ইঞ্জিনিয়ারদের অবস্থা তো আরো করুণ। বিশেষত, অধিক টাকার প্রাইভেট কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারদের তো কথাই নেই। এ ব্যাপারে একটি ছোট দৃষ্টান্তের অবতারণা করছি। ক’বছর আগে আমাদের পাড়ার আব্দুস সালাম সাহেবের স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। কানাডা থাকে। সম্প্রতি মেয়েরও দূরদেশে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভাবলেন, এবার ছেলের কাছে কিছুদিন থাকবেন। ছেলে তাকে ভাগ্যগুণে বিমানবন্দর থেকে আপ্যায়ন করে বাসায় নিয়ে গেল। তবে ছেলের সঙ্গে এটা তার প্রথম ও শেষ দেখা। বলাবাহুল্য, সপ্তাহখানেক তিনি সেখানে থেকে হাঁপিয়ে ওঠেন। রাতে ছেলে কখন কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে এবং ভোরে কখন বের হয়ে যায়- সপ্তাহদিনের মধ্যে একবারও আর তিনি তার দেখা পাননি! ভাগ্যিস, ছেলের বউ চাকরিজীবী ছিল না। তাই সে-ই তাকে আদর-যত্ন করেছে। তবুও ছেলে বলে কথা! এমনকী আসার দিনেও তিনি তার ছেলের মুখ দর্শন করতে পারেননি। পাঠক, এর নাম জীবন? বলা হচ্ছে, এটা নাকি ফার্স্ট লাইফ! কিন্তু এত ফার্স্ট দিয়ে কী হবে? যেখানে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে।
শুকিয়ে গিয়েছে। টাকাটাই কি সর্বস্ব? জীবনে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার কোনো মূল্য কি নেই? টাকা রোজগারের দৌড়ে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা আদান-প্রদানের সময় যে একেবারেই কমে গিয়েছে? আগের দিনে তো এরকম ছিল না। এটা বোধকরি ভেবে দেখার মতো বিষয়ই বটে। যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের রমরমা মানুষকে যেমন যন্ত্রবিশেষ বা রোবটে পরিণত করে দিচ্ছে, ঠিক সেরকম মানবসভ্যতাকেও বে-আব্রু করে দিচ্ছে। বড় বড় শহরে কাপড়ের দোকানের ভেতরে মেয়েদের কাপড় ফিটিং করে নেয়ার গোপন কক্ষ করেছে। যুবতীর খদ্দেরদের অজান্তেÍ তার স্পর্শকাতর নগ্নদেহের দৃশ্য ক্যাসেটবন্দি পর্নোগ্রাফি হয়ে যাচ্ছে মোবাইলে, কম্পিউটার ও ইন্টারটের সহযোগে! ঠিক সেরকম কারো বাথরুমের গোসলের স্পর্শকাতর দৃশ্য, এমনকী বেডরুমের সহবাসের অতি স্পর্শকাতর দৃশ্যসম্ভারও এসবের সাহায্যে মজুত করে বাজারে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এর নাম সভ্যতা? এর নাম আধুনিকতা? অথবা এর নাম যান্ত্রিক সভ্যতার আশীর্বাদ?
যান্ত্রিক সভ্যতা তথা বিশ্বায়নের পাল্লায় পড়ে এক বছরের জীবনটাকে দ্রুত থেকে এমন দ্রুততর করে তোলায় এবং সময়ের পরিসরকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলায় আমরা কি এমন স্বর্গসুখ পেলাম? বরং চিরন্তÍÍন-শাশ্বত তথা নৈসর্গিক জীবনধারাকেই খুইয়ে বসেছি। মোবাইলের দৌলতে আজ গোটা পৃথিবীটা আমজনতার হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে। কিছু অফিসিয়াল কাগজপত্র ছাড়া ডাকবক্সে আমজনতার চিঠিপত্র যেন আর পড়ছে না। এতে প্রজন্ম কী হারাল, সেই ক্ষতিটাও কিন্তু অবহেলার মতো নয়। চিঠি থেকে মোবাইলে ফিরে এসে মানুষ সময় বাঁচিয়েছে। তবে চিত্তের প্রসারতার, মনের পরিধি বিস্তারের ক্ষেত্রে, সর্বোপরি হৃদয়ের মাধুর্য আরেকটি হৃদয়ে উজাড় করে ঢেলে দিতে অর্থাৎ হৃদয় বীণার তারে আরকেটি হৃদয় বীণার তারকে জুড়ে দিতে কিংবা প্রেম-প্রীতি ও স্নেহের বন্ধন আরো সুদৃঢ় করে দিতে চিঠির বিকল্প নেই। যন্ত্রের যুগে চিঠির অভাবে মানুষের মন সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে যাচ্ছে। চিঠির ভাষা ও আবেগ স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত ছিল। চিঠি লেখা ও চিঠি পড়ার স্বর্গীয় অনুভূতি-মাধুর্য ভুক্তভোগী ছাড়া আর কাউকেই বলে বোঝানো যাবে না। চিঠি ও তার উত্তরের অপেক্ষায় মনে যে রোমাঞ্চকর ইমেজ বিরাজ করত তা বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। ‘প্রেমপত্র’ তথা প্রেমিক- প্রেমিকার চিঠির ভাষা ও আবেগ ছিল একেকটি মহাকাব্যসদৃশ। এখন তো চিঠি লেখার প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবে এনাফ ইজ এনাফ। উপকরণ বৃদ্ধির ঠ্যালায় ভুলে গেলে চলবে না অতীতের সুন্দর বিষয়বস্তুগুলোকে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে পরম মমতায়। কেননা, যতই যান্ত্রিক হয়ে উঠি না কেন, আদতে আমরা যে রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। সেটা মনে রাখতেই হবে।
সাংবাদিক-কলামিস্ট