ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নীরব ঘাতক ঢাকার বিষাক্ত বাতাস!

মো. তাহমিদ রহমান
নীরব ঘাতক ঢাকার বিষাক্ত বাতাস!

বাতাস হলো মহাবিশ্বের আত্মাস্বরূপ যা প্রাণীদের জিয়নকাঠি। অপরিহার্য এই উপাদানটি আমরা প্রতি মুহূর্তে প্রশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু সেই জিয়নকাঠি নিয়েই ঢাকাবাসী পড়ে গেছে শ্বাসরোধকর অবস্থায়। নগরায়নের চাকচিক্যের মোহে ঢাকা শহরের জনঘনত্ব অনেক আগে থেকেই বিপৎসীমার ঊর্ধ্বে।

একদিকে পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে নগর সভ্যতার পত্তন অন্যদিকে ঢাকা শহরের জল স্থল এবং আন্তরীক্ষে চলছে অবাধ দূষণ। শীত পড়তে না পড়তেই বায়ুদূষণের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে ঢাকাতে। শীতকালে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন ধুলা সড়কে পড়ে এবং ২ হাজার মেট্রিক টন ধুলা বাতাসে উড়ে। পরিবেশবিষয়ক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ঢাকার বায়ু নিয়ে যে তথ্য দিয়েছে তা ভয়াবহ। ঢাকা শহর সহ দেশের বৃহৎ শহরগুলোতে বায়ুদূষণের অবস্থা প্রতিমুহূর্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত তা তুলে ধরে এবং মানুষকে সতর্ক করে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) যে স্কেলে বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয় তা হলো। চলতি বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার বায়ুর মান অনেক দুর্যোগপূর্ণ, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গত সপ্তাহে বিশ্বের ১২৬টি দূষিত শহরের মধ্যে শীর্ষে ছিল ঢাকা। এ সময় ঢাকার স্কোর ছিল ৪৮৯।

যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত নিরাপদ মানের তুলনায় খারাপ দিক থেকে প্রায় ৯ গুণ বেশি। দ্বিতীয় স্থানে ছিল মিসরের কায়রো, স্কোর ৩৩০। কোনো এলাকায় টানা তিন দিন তিন ঘণ্টা ধরে বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকলে সেই এলাকায় স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা উচিত। ঢাকায় এখন যে অবস্থা, তাতে অবশ্যই জনসাধারণকে দূষণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জরুরি বার্তা দেয়া উচিত। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে জনসচেতনতায় কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি।

ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫-এর উপস্থিতি। জনসংখ্যার অনুপাতে ঢাকায় গাছপালার সংখ্যা অনেক কম তার উপর এই শীতের সময় কালো ধোঁয়ায় জনজীবনের বিপন্ন হওয়ার উপক্রম। গাড়ির কালো ধোঁয়া বেড়ে যাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসে মানুষ গ্রহণ করছে বিষ। ঢাকাবাসী প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিষাক্ত বায়ু গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরকে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করেছে। ঢাকা শহরের বাতাসের এই দূরাবস্থা হঠাৎ করে হয়নি।

গত দুই যুগ থেকে ঢাকার বাতাসকে ক্রমবর্ধমানভাবে বিষাক্ত করে তোলা হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক অতীতে ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে একজন চীফ হিট অফিসার নিয়োগ করা হয়েছিল কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বায়ুদূষণ সব বয়সী মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ, অ্যাজমা রোগী ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বায়ুদূষণ শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণ মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বায়ুদূষণের প্রভাবে ঢাকা শহরের অধিবাসীদের বৃহৎ অংশই শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা এবং অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক সমস্যার শিকার হয়ে বেড়ে উঠছে।

বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো বাতাসে- সূক্ষ বস্তুকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার ১০ ও পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ও ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ঢাকার বায়ুদূষণে ভয়ঙ্কর ভূমিকা পালন করছে মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান, অটোরিকশার ব্যাটারীসহ অন্যান্য ই-বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য তথা পলিথিন ও পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার, যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত ধূমপান, যত্রতত্র পোড়ানো পলিথিন প্যাকেটে আবদ্ধ গৃহস্থালির ময়লা, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, নির্মাণসামগ্রীর ধূলা, এবং জৈব জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। ঢাকাবাসী চায় বুক ভরে শ্বাস নিতে কিন্তু সেই পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু উৎস। ঢাকাবাসীর বিশুদ্ধ বাতাসের প্রধান অন্তরায় অবকাঠামো নির্মাণসামগ্রী যেগুলোর ফলে এই তিলোত্তমা শহরটির ৩০ শতাংশ বায়ু আজ দূষিত। শহরের আশপাশে গড়ে উঠা ইঁট ভাটা ও কলকারখানা দূষণ ঘটিয়েছে ২৯ শতাংশ বায়ুর। ফিটনেসবিহীন যানবাহন দূষিত করে ১৫ শতাংশ বায়ু। গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে দূষিত হয় প্রায় ১৭ শতাংশ এছাড়াও আন্তঃদেশীয় বায়ুপ্রবাহ থেকে প্রায় ১০ শতাংশ বায়ু ঢাকা শহরে নিত্যদিন দূষিত হয়। এই দূষিত বায়ুর নিঃশ্বাসের কারণে ঢাকা শহরের অধিবাসীগণের প্রতিবছর গড় আয়ু ৬ বছর ৮ মাস কমে যাচ্ছে। অথচ চাইলেই এই মায়ার শহরকে আমরা তিলোত্তমা করে গড়ে তুলতে পারি। ঢাকার বাতাসে কালো ধোঁয়া, ধুলাবালির পাশাপাশি নাইট্রোজেনের উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এমনিতেই ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরী তার উপর নতুন নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে তুলে শহরের আশপাশের বনায়ন ধ্বংস করা হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে গিয়ে ঘটানো হচ্ছে প্রকৃতি বিনাশী কর্মকাণ্ড। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অনেকটা যত্রতত্রভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্প, কল-কারখানা। শহরের সকল খাল, লেক ও চতুর্দিকের নদীগুলোতে শিল্পকারখানার বর্জ্য ও পলিথিন দিয়ে পূর্ণ হওয়ায় জীববৈচিত্র্যের বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। উদ্যানগুলোতেও বিশুদ্ধ অক্সিজেনের ঘাটতি। শহরের লেকগুলোর চতুর্দিকে ফুটপাত দিয়ে চলাচলের সময় নাকে রুমাল বা মাস্ক ব্যবহার না করলে হাঁটা দায়। এসব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে শহরের রাস্তায় যত্রতত্র ইউরিন নিঃসরন। জৈব জ্বালানি পোড়ানোয় শহরের বায়ুতে মিশছে বিষাক্ত গ্যাস। ঢাকার বায়ুদূষণ প্রায় পুরোটাই মানুষের সৃষ্ট। সরকার যদি ঢাকা শহরের লেকগুলোকে সংস্কার করে। হাতিরঝিল লেককে মনু নদী দ্বারা শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে সংযুক্ত করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পারে, তাতেই ঢাকা শহরে নির্মল বায়ু অনেকটাই বেড়ে যাবে। জনগণকে সচেতন হতে হবে খালগুলোতে ময়লা না ফেলতে, বিশেষ করে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকতে। নির্মল বায়ু প্রাপ্তিতে সবুজায়নের কোনো বিকল্প নেই। তাই ঢাকাবাসীকে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচাতে, দূষণ রোধে হাইকোর্ট ৯ দফা নির্দেশনাসহ যে আদেশ দিয়েছিল সেগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। আমরা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, বায়ুদূষণে শীর্ষ স্থান দখল বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। আর এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় বনায়নের দ্বারা অরণ্য, নদী ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে আমাদের ফিরে যেতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে দেশে আইন আছে কিন্তু আইন মানার ইচ্ছা না থাকলে শত আইন করেও অপরাধ বন্ধ করা যায় না।

ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধে জনসাধারণের সচেতনতার বিকল্প নেই। প্রকৃতি ও পরিবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে কখনোই স্থান পায়নি। কখনোই কোন রাজনৈতিক দলকে মহানগরীর রাজপথে পরিবেশ দূষণ নিয়ে মিছিল মিটিং করতে দেখা যায়নি।

গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন বায়ুদূষণ রোধে বিচিত্র কর্মসূচি পালন করছে। এবার তাদেরই একজন শুদ্ধমতির বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা। তাই আমাদের দাবি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হলেও ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বন্ধ করুন।

লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত