পতিত ও বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গুম, খুন, অপহরণ, তুলে নেয়া ইত্যাদি ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। সাড়ে ১৫ বছর কত মানুষকে যে অপহরণ ও তুলে নেয়া হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনো হয়নি। স্বৈরাচার হাসিনা গোটা দেশে ভীতি ও আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সরকারের সমালোচক, ভিন্ন মতাবলম্বী ও ভারতবিরোধীদেরই টার্গেট করা হতো। তাদের সাধারণত রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে গুম অথবা খুন করা হতো। কারো কারো অকথ্য নির্যাতনের পর রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেয়া বা ফেলে দেয়া হতো। তারা ঘরে ফিরে নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। আবার গুমের ভয়ে তারা কিছু বলতেন না। গুমের শিকার ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন সরকারের কাছে লাগাতার আবেদণ্ডনিবেদন জানিয়েও ফল পেতেন না। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পালিয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকার গণদাবি অনুযায়ী গুম সংক্রান্ত কমিশন গঠন করে। ২৭ আগস্ট মইনুল হোসেন চৌধুরীকে প্রধান করে এ কমিশন গঠিত হয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয় কমিশনকে। কমিশন গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন তুলে দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের প্রকাশযোগ্য অংশ গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। প্রতিবেদনের সরবরাহকৃত অংশের ভিত্তিতে পত্রপত্রিকায় যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তা একইসঙ্গে অচিন্তনীয় ও লোমহর্ষক। শেখ হাসিনা কত নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার ছিলেন, প্রতিবেদন সূত্রে সেটা জানা গেছে। কমিশন বলেছে, সাড়ে ১৫ বছর ধরে গুমের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। তথ্যমতে, শেখ হাসিনা ছাড়াও গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান, পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। চরম মানবাধিকারবিরোধী গুম-খুনের সঙ্গে সরকারপ্রধান, তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, সামরিক বাহিনী ও পুলিশের উচ্চ পদাধিকারীদের সম্পৃক্ততার কথাই প্রতিবেদনে উঠে আসেনি, একইসঙ্গে ভারতীয়দের সংশ্লিষ্টতার কথাও উল্লেখিত হয়েছে। কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় যুক্ত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বয়ানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্মরণযোগ্য, গুম হয়ে যাওয়া একাধিক ব্যক্তির ভারতে সন্ধান মিলেছে, যার একজন হলেন বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ। ভারতীয়রা সংযুক্ত না থাকলে এটা কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়। ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য স্বৈরাচারের যাবতীয় অপকর্ম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে ভারতের মোদি সরকারের জড়িত থাকার বিষয় এখন সর্বজন বিদিত।
সাড়ে ১৫ বছরে যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের পক্ষে প্রতিবেদন এ পর্যন্ত কমিশনে জমা পড়েছে ১৬৭৬টি অভিযোগ। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই হয়েছে ৭৫৮টি। দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছে। বাকি ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন) নিখোঁজ রয়েছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে গড়ে ওঠা ‘মায়ের ডাক’-এর হিসাবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গুম হওয়া ১৫৫ জনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম প্রমুখ নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন। কমিশনের তথ্যমতে, র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশ প্রভৃতি সংস্থা গুমের সঙ্গে জড়িত। কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছেন, যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়। বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করেছে। গুমকারীরা গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ওপর কী ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতন করেছেন, তার বিবরণ পড়লে রক্ত হিম হয়ে যায়। অত্যাচার-নির্যাতনের কয়েকটি নজির তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনোরূপ অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই ঠোঁট সেলাই করে দেয়া হয়েছে। এক ব্যক্তির যৌনাঙ্গে ও কানে ইলেকট্রনিক শক দেয়া হয়েছে। এক ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করে হত্যা করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর সিমেন্টের বস্তার সঙ্গে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। কখনো লাশ ফেলা হয়েছে চলন্ত ট্রেনের নিচে, কখনো জীবিতকে ফেলা হয়েছে চলন্ত গাড়ির নিচে। এমন নৃশংসতা, এমন বর্বরতা অকল্পনীয়। সেই রাজা-বাদশাহদের আমলে কোনো কোনো রাজা বা বাদশাহর বিভিন্ন নিষ্ঠুরতার বিবরণ পাওয়া যায়। শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতা সেই নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি নিজেকে রাজা-বাদশাহই মনে করতেন। তার কথাই ছিল আইন। এমনও শোনা যায়, হত্যা-নির্যাতনে তিনি উল্লসিত হতেন, অনন্দ লাভ করতেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তিনি গণহত্যা চালিয়েছেন। আরো হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন। ক্ষমতা টিকেয়ে রাখা ও তা প্রলম্বিত করার জন্য তিনি এমন কোনো অপকর্মণ্ডঅপরাধ নেই, যা তিনি করেননি।
গুম-খুনের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার এবং এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো বিকল্প নেই। গুম সংক্রান্ত কমিশন গুম-খুনের একটা বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিশনের প্রধান জানিয়েছেন, আগামী বছর মার্চে আরো একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবে কমিশন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে আরো এক বছর লাগবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। আশা করা যায়, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গুমবিষয়ক সব কিছু অর্থাৎ কারা নির্দেশদাতা, কারা নির্দেশ বাস্তবায়নকারী এবং ভারত কীভাবে ও কতটা জড়িত বিশদভাবে জানা যাবে। আয়নাঘরের বিষয়টাও গুমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আয়নাঘর কোথায় কোথায় ছিল, তার সব জানা যায়নি। জনশ্রুতি এই যে, আয়নাঘর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছিল। যার সব বের করা সম্ভব হয়নি। কমিশনকে সব খুঁজে বের করতে হবে। এখনো আয়নাঘরে কেউ আছেন কি না দেখতে হবে। গুম-খুনের বিচারের প্রক্রিয়াও দ্রুত শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গুমের বিচার করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এটা অবশ্যই সুখবর। সবাই আশা করছেন, আইসিটির বিচার হবে স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন। আন্তর্জাতিক দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে এ বিচারের প্রতি। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের যারা জীবিত আছেন, অবর্ণনীয় নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন তারা এবং যারা নিহত ও নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের আত্মীয়-স্বজনরা যাতে ন্যায়বিচার পান তা নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো মূল্যে এবং দ্রুততম সময়ে।