তাবলীগ জামাত মূলত মুসলমানদের মাঝেই ধর্মীয় বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে। যারা নামাজ, রোজা এবং এ জাতীয় ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বিমুখ থাকেন তাদের ধর্মমুখী করতে মসজিদভিত্তিক কাজ করে থাকে। তাবলিগ জামাতের সূচনা হয়েছিল গত শতকের ১৯২৪ সালের দিকে ভারতের মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর মাধ্যমে। ধীরে ধীরে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাবলিগের কার্যক্রম। একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে কাজ করতে ষাটের দশক থেকে প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমায় একত্রিত হন তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা।
২০১০ সাল পর্যন্ত এক পর্বে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হলেও অতিরিক্ত লোক সমাগমের কারণে ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। দুই পর্বেই টঙ্গীর তুরাগ তীরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তাবলিগ অনুসারীরা অংশগ্রহণ করতেন। এতে বয়ান করতেন ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তাবলিগের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা। বয়ানকারীদের মধ্যে তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর প্রপৌত্র মাওলানা সাদও ছিলেন।
তবে বিশ্ব ইজতেমাসহ তাবলিগের বিভিন্ন মজলিসে দেয়া মাওলানা সাদের কিছু বক্তব্যে আপত্তি রয়েছে বলে চিহ্নিত করে ভারতের অন্যতম ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগ। আপত্তিকর বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত হয় মাওলানা সাদের একক আমির দাবির বিষয়টি। কারণ, বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম একটি নিয়ন্ত্রণকারী পর্ষদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ওই পর্ষদব্যবস্থাকে শূরায়ে নেজাম বলা হয়। পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী কোনো সদস্য ইন্তেকাল করলে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এভাবে কয়েক যুগ ধরে পর্ষদব্যবস্থা চলে আসছে। ওই পর্ষদেরই একজন সদস্য মাওলানা সাদ কান্ধলভী। তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর অধস্তন পুরুষ হিসেবে পর্ষদে তার বিশেষ মূল্যায়ন ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি পর্ষদব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নিজেকে একক আমির ঘোষণা করেন। বিভক্তির মূলে এই বিষয়টিও রয়েছে। বিভক্তি দেখা দিলে বিষয়টি সমাধান করতে তাবলিগের শূরা কমিটি (পরিচালনা পর্ষদ) বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায়। এরমধ্যেই ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তাবলিগের দুই পক্ষ বা দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
এসময় তাবলিগের শূরায়ে নিজাম (মাওলানা জুবায়েরপন্থি) বলে পরিচিত পক্ষটি মাওলানা সাদকে বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়। এরপর তাবলিগের দুইপক্ষ দুটি মেরুতে অবস্থান নেন। শূরায়ে নিজাম (মাওলানা জুবায়েরপন্থি) বলে পরিচিত পক্ষটি কেন মাওলানা সাদের বিরোধিতা করছেন তা স্পষ্ট করতে দেশের বিভিন্ন জায়গা ওজাহাতী সমাবেশ বা ব্যাখা প্রদান সমাবেশ করেন। অপরদিকে এ সময় মাওলানা সাদের অনুসারীরা এতায়াতী বা অনুসরণকারী বলে পরিচিতি লাভ করে। দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার প্রাথমিক দিনগুলোতে দুই পক্ষ পরস্পর বিরোধি অবস্থানে থাকলেও বিষয়টি জটিলতায় রূপ নেয় ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর ইজতেমা মাঠে সংঘর্ষকে কেন্দ্র।
এই সংঘর্ষে মাওলানা সাদপন্থিরা আগে থেকেই ইজতেমার মাঠে অবস্থারত তাবলিগের সাথীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল বলে দাবি করে থাকেন শূরায়ে নিজামপন্থিরা (মাওলানা জুবায়েরপন্থি)। অপরদিকে হামলার দায় শূরায়ে নিজামপন্থিদের ওপর চাপিয়ে থাকেন মাওলানা সাদপন্থি। ২০১৮ সালের হামলার ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি মামলার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যেই গত কয়েক দিনে জোর ইজতেমাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয় টঙ্গীতে। সর্বশেষ আবারো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে তাবলিগের দুইপক্ষের দ্বন্দ্ব। এখন পর্যন্ত তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন এ ঘটনায়। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উত্তরা ও তুরাগ নদ সংলগ্ন এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। মাওলানা সাদকে ঘিরে তাবলিগের দ্বন্দ্বে এখন পর্যন্ত দুইবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিলেও এ নিয়ে গত কয়েক বছরে কোনো মন্তব্য বা সমাধানে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি মাওলানা সাদকে।
পুকুরে ঢিল ছুড়ে মারলে স্থির পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় এবং পানির কণাগুলো আন্দোলিত হয়ে তরঙ্গের সৃষ্টি করে। রাজধানীর অদূরে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে যেন মাওলানা সাদ কান্ধলভিপন্থিরা হঠাৎ ঢিল ছুড়েছে। এতে পানির ঢেউ অনুপ্রস্থ তরঙ্গের মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সংঘর্ষে চারজনের প্রাণহানি ঘটে। তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুইপক্ষই একে অপরকে দায়ী করছে। জুবায়েরপন্থিরা বলছেন, ইজতেমার মাঠে অবস্থানকালে রাত সাড়ে ৩টায় ‘ছুরি, ক্ষুর, হাতুড়ি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালান সাদপন্থিরা। অন্যদিকে সাদপন্থিদের দাবি, কামারপাড়া থেকে স্লুইস গেট পর্যন্ত সড়কে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়ার সময় রাত সাড়ে ৩টার দিকে জুবায়েরপন্থিরা তাদের দিকে ‘ইট-পাটকেল, জলন্ত মশাল’ নিয়ে হামলা করে। তাবলিগ জামাতের এই দুটি পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনার পর গাজীপুরে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ইজতেমা ময়দানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। খুনিদের তো কোনো অবস্থায়ই ছাড় দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। তবে ওরা নিজেরা বসেই সিদ্ধান্ত নিক।
তাবলিগ জামাতের ইজতেমা নিয়ে দুপক্ষের পুরোনো বিরোধ মীমাংসিত। গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা পালন করেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা। এরপর ইজতেমা মাঠে ২০ ডিসেম্বর থেকে পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দেন দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা। তারপরও কেন এই প্রাণঘাতী সংঘর্ষ? এর নেপথ্যে কি হাসিনা ও ভারতের ইন্ধন রয়েছে? ইসকন ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুতে বিশৃঙ্খল সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় ভারতের নাগরিক মাওলানা সাদ কান্ধলভীপন্থিদের নামানো হয়েছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনদের অনেকের ধারণা, ইজতেমা ইস্যুতে সংঘর্ষের নেপথ্যে রয়েছে ভারতের আশ্রয়ে থাকা গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার কালো হাত। প্রতি বছর টঙ্গী ইজতেমার অংশগ্রহণ করেন ধর্মপ্রিয় শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ এবং আলেম ওলামাগণ। টঙ্গী, উত্তরা, সাভার, আশুলিয়াসহ আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে এই ইজতেমা ধর্মীয় উৎসবের মতোই। এলাকার নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরা ইজতেমা উপলক্ষে নানা পেশায় নিযুক্ত হয়ে আয়-রোজগার করেন। হাসিনা রেজিমে বিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথকভাবে ইজতেমা করার রেওয়াজ করে দেয়া হয়। তারা সেটি মেনে নিয়ে কয়েক বছর ধরে দুইপক্ষই পৃথক পৃথকভাবে ইজতেমার আয়োজন করে। হঠাৎ করে এবার ইজতেমায় তৌহিদা জনতাকে উস্কে দিলো কারা? কারা রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড ঘটাল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরাকে উপেক্ষা করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করল? সংঘর্ষে জড়িতদের চিহ্নিত এবং গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ভুক্তোভোগীরা।
টঙ্গী ও পাশের উত্তরায় বসবাস করেন এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গেছেন। ইজতেমায় বিশৃঙ্খলা নিয়ে তারা চরম বিক্ষুব্ধ। তাদের অনেকেই বলছেন, দেশের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে টঙ্গীতে ইজতেমা করতে দেয়া উচিত কি না, তা নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের নতুন করে ভেবে দেখা উচিত। কারণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে ভারত একের পর এক ষড়যন্ত্র করছে। দেশি এজেন্ডদের দিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন।
ইজতেমায় ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ লোকের সমাগম ঘটে। এ সময় পলাতক হাসিনা কিছু তাঁবেদারকে ব্যবহার করে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনে এখনো হাসিনার অনুগত কর্মকর্তারা সক্রিয়। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে একাধিক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘ভারতের তাঁবেদারির’ অভিযোগ উঠেছে।