ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বার্ধক্য মোকাবিলায় এনজিওদের ভূমিকা

হাসান আলী
বার্ধক্য মোকাবিলায় এনজিওদের ভূমিকা

এনজিও বলতে বুঝায় এমন কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যারা সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, পরিবেশ, ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো বাংলাদেশে মানবিক সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। তাদের কাজ ছিল ত্রাণ, পুনর্বাসন, পূর্ণগঠন, চিকিৎসা বিষয়ে। সত্তুর দশক পেরিয়ে আশির দশকে দেশীয় এনজিওগুলোর বিস্তার লাভ করতে থাকে। আমাদের দেশে তিন রকমের এনজিও কাজ করে যথা আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং আঞ্চলিক। বাংলাদেশে কত এনজিও কাজ করে এটা সুনির্দিষ্ট করে বলাটা কিছুটা কঠিন বৈকি!

খোঁজ-খবর করে জানতে পারলাম সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ৫৮৪৬৫টি, এনজিও ব্যুরো থেকে ২৬৩৮টি, পিকেএসএফ ২০২টি, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে সোসাইটি অ্যাক্টে ১৫৮৯৭টি, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ১৭৩৭৮টি, সমবায় অধিদপ্তর থেকে ১৮২০৭১টি, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি ৭২৪টিসহ সর্বমোট ২৭৭,৩৭৫টি। এর মধ্যে একই প্রতিষ্ঠান একাধিক সংস্থা থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে।

আমরা ধরে নিতে পারি বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ এনজিও কাজ করছে। বড় এনজিও বলতে আমরা বুঝি ব্র্যাককে। ব্র্যাক সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় এনজিও। দেশীয় এনজিওগুলোর মধ্যে ব্র্যাক, প্রশিকা, আশা, গণস্বাস্থ্য, টিএমএসএস, ভার্ক, বিভিএইচএস, ইকো, গার্ক, এসডিএস, রিক ইত্যাদি। চার্চভিত্তিক কয়েকটি সংস্থা কাজ করে সেগুলো হলো, ওয়ার্ল্ড ভিশন, সিসিডিবি, কারিতাস, হীড বাংলাদেশ ইত্যাদি।

এদের সবার লক্ষ্য হলো হতোদরিদ্র বা দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। এনজিওরা প্রশিক্ষণ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (শিশু ও বয়স্ক), প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, গৃহায়ণ, ক্ষুদ্র ঋণ, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু পালন, মানবাধিকার, কৃষি উন্নয়ন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গঠন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, পরিবেশ সুরক্ষা, স্যানিটেশন, অবকাঠামো উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, আইন সহায়তা, কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন, নিরাপদ মাতৃত্ব, মা ও শিশুর যত্ন, টিকা ইত্যাদি।

অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় প্রবীণের উন্নয়নে কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি প্রচেষ্টার ঘাটতি পূরণে এনজিওরা কাজ করে। শিক্ষার চাহিদা পূরণে দূরবর্তী এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে, বৃত্তি দিয়ে স্কুলে সন্তোষজনক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পুষ্টির তথ্য, টিকা দান, কৃমি নাশক ওষুধ বিতরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, অসংক্রামক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতি, প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করে দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সহয়তা করছে। রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, মা ও শিশুর যত্ন নিয়ে অনেক এনজিও কাজ করছে। আমাদের দেশের কয়েক লাখ মানুষ এনজিওতে চাকরি করে। অতীতে আমাদের দেশের মানুষ এনজিওদের মধ্যে একটা সামাজিক ও মানবিক চেহারা দেখতে পেতো। সেটা দিন দিন উজ্জ্বলতা হারাতে হারাতে ম্লান হয়ে আসছে। অন্যদিকে মানুষের কাছে এনজিওদের ব্যবসায়িক মুখ বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, পাঁচতারা হোটেল, রিসোর্ট, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গেস্ট হাউজ, আড়ং, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করণ, হ্যাচারী, বিকাশ, প্রিন্টিংসহ নানা রকম আয় বর্ধক কার্যক্রম চালু রয়েছে। যদিও বলা হয় এনজিওরা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কিন্তু তাদের আয়বর্ধক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত মুনাফার গন্তব্যস্থল কোথায়? এটা আমজনতার বোধগম্য নয়। গত পঞ্চাশ বছর ধরে অধিকাংশ এনজিওরা কাজকর্ম করে নিজেদের জন্য স্থায়ী অফিস, কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন, ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন, গ্র্যাচুইটি, কল্যাণ তহবিল, চিকিৎসা সুবিধাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পেরেছে। জাতিসংঘ বলেছে, বাংলাদেশে অতি দরিদ্রের সংখ্যা ৪ কোটি ১৭ লাখ। বাংলদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০২০) বলছে, জনসংখ্যার ১৮.৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। গত ৫৩ বছর ধরে সরকারের এবং এনজিওদের প্রচেষ্টায় দারিদ্র্য দূরীকরণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়ার পরও ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি প্রবীণের বসবাস যা মোট জনসংখ্যার ১১ শতকের বেশি। বিপুল সংখ্যক প্রবীণের জীবন মানোন্নয়নে এনজিও উদ্যোগ তেমন দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, চক্ষু শিবির, শীত বস্ত্র বিতরণ, সীমিত আকারে ভাতা প্রদানের মধ্যে এনজিও কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এনজিওদের অনেক কিছু করার রয়েছে বলে আমি মনে করি। এনজিওরা কাজ করে টার্গেট গ্রুপের সদস্যদের কল্যাণের জন্য। এই টার্গেট গ্রুপ এনজিওদের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, ক্ষুদ্র ব্যবসা করেছেন, উদ্যোক্তা হয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন, কিস্তি পরিশোধ করেছেন এবং অবশেষে প্রবীণ হয়েছেন। এই দুর্দশাগ্রস্ত প্রবীণদের দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এনজিওদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্দশা লাঘবে কর্ম এলাকার দুঃস্থ প্রবীণদের মাসিক ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা দেয়া। সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধপত্র, চিকিৎসাসেবা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া। বড় ধরনের রোগ হলে এককালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান। সক্ষম প্রবীণ বিনা সুদে অথবা স্বল্প সুদে, সহজ শর্তে ঋণ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এনজিও কর্ম এলাকায় যেসব প্রবীণ নিরাপত্তা হীনতায় ভোগেন তাদের তালিকা প্রণয়ন করে নিরাপত্তা বলয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রয়োজন মনে করলে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা গ্রহণ করা। সকল প্রবীণের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি তিন মাস পর অবস্থার উন্নতি কিংবা অবনতি খাতায় লিপিবদ্ধ করা। যেসব প্রবীণ নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হন তাদের আইনি সহায়তা দিয়ে সুবিচার প্রাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা দেয়া। প্রবীণদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য মূলক আচরণ বন্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সকল রকমের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রবীণদের অংশগ্রহণ থাকা উচিত যাতে করে উন্নয়ন প্রবীণবান্ধব হয়। বয়স বিদ্বেষী মনোভাব থেকে কেউ যেন প্রবীণদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার চেষ্টা না করে সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম প্রবীণরা কাজের মধ্যে থাকলে অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো থাকবেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত