ঢাকা ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হজ ব্যবস্থাপনা ও জনআকাঙ্ক্ষা

জাহারুল ইসলাম
হজ ব্যবস্থাপনা ও জনআকাঙ্ক্ষা

বেশ কিছুদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন হজ এজেন্সির নানা রকম অফার, সাশ্রয়ী মূল্যে হজ সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতির বিজ্ঞাপন চোখে পড়ছে। গত হজ সম্পন্ন হয়েছে কিছুদিন আগে। এর মধ্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে হজে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। হজ ও ওমরাহর যাত্রীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় গত বছর সারা বিশ্ব থেকে ১৮ লাখের ও বেশি মানুষ হজ পালন করেছেন। সৌদি আরবের তরফ থেকে আমাদের দেশের এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের হজে যাওয়ার আনুমতি থাকলেও গিয়েছিলেন ৮৫ হাজার ২২৫ জন। খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কোটা পূরণ হয় নাই। পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার চেয়েও আমাদের হজের খরচ বেশি। গত বছর আমাদের দুটি হজ প্যাকেজের দাম ছিল পাঁচ লাখ ৯০ হাজার ও ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ টাকার খাতওয়ারী কোনো হিসাব কারো কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তাই খরচের ব্রেকাপ সম্পর্কে অন্ধকারে থাকতে হয়। স্বাভাভিকভাবে তাও ঢাকা-সৌদি আরব, সৌদি আরব-ঢাকার বিমান ভাড়া ৭০-৭৫ হাজার টাকা অথচ হজের সময় এত টাকা কেন নেয়া হয় তা বোধগম্য নয়। ধরেই নিলাম হজের সময় সৌদি আরবে যাত্রী নামিয়ে বিমান যাত্রীশূন্য অবস্থায় ফিরতে হয়। সেক্ষেত্রে ভাড়া দেড়লাখ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু নেয়া হচ্ছে এক লাখ ৯৬ হাজার টাকা। হজ প্যাকেজের টাকা বেশি নেয়ার যুক্তি হিসেবে অনেকে বলে থাকেন বায়তুল্লাহ ও মসজিদে নববী থেকে হাজীদের অনেক দূরে রাখে; কিন্তু আমাদের হজ যাত্রীদের কি কাছাকাছি রাখা হয়। বাংলাদেশের বহু মুসলিমকে বায়তুল্লাহ থেকে ২৫-৩০ মিনিটের হাঁটাপথের দূরত্বে রাখা হয়। এতদূরে অবস্থানের কারণে তাদের পক্ষে ইবাদত-বন্দেগি করা কঠিন হয়ে পড়ে। ছয় থেকে আটজনকে একরুমে রাখা হয়। একজনের পক্ষে একটি টয়লেট শেয়ার করাও কষ্টসাধ্য। এজেন্সির মাধ্যমে ভিআইপি প্যাকেজে যেসব যাত্রী হজে যান তাদের পাঁচ তারকা হোটেলের পরিবর্তে তারকা ছাড়াই হোটেলে রাখা হয়। এ বিষয় নিয়ে মদিনা ও অজিজিয়ায় হজ যাত্রীদের মধ্যে কথাবার্তা হলেও যেন প্রতিকার নেই। আশকোনা হাজী ক্যাম্পে ইমিগ্রেশনের আগে যে রুমে রাখা হয় সেখানে কিছু প্লাস্টিকের চেয়ার ফ্যান থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। হজ ক্যাম্পের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুম, পর্যাপ্ত চেয়ার/সোফা, আনুসঙ্গিক সুবিধা থাকা সময়ের দাবি।

হজ যাত্রীদের বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা সহজ করা জন্য সৌদি ব্যবস্থাপনার বিমানবন্দরে মক্কারুট ইনিশিয়েটিভ নামে ডিপারাচার লাউঞ্জ চালু হয়েছে যাতে হজযাত্রীরা জেদ্দা বিমান বন্দরে নেমেই লাউঞ্জের ভেতর দিয়ে মক্কা যাওয়ার বাসে উঠতে পারেন। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ, আমাদের বিমান বন্দরে ডিপার্চার লাউঞ্জে হজ যাত্রীদের বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ পড়তে হয়ে কিন্তু সেখানে ওজু করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অসুস্থ, বৃদ্ধ মানুষের কষ্ট হয়। এখানে এক সঙ্গে পাঁচণ্ডছয়জনের অজু করার ব্যবস্থা থাকা দরকার। মিনা ও আরাফাতের ময়দানে একই দেশের তাঁবুগুলো একই ব্লকে পাশাপাশি থাকে কিন্তু আরাফাতের ময়দানে সেরকম থাকে না। অনেকে তাঁবু খুঁজে না পেয়ে ৫২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ছটফট করে এমনকি কোনো স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, মক্কা-মদীনা-মিনা, মুজদালিফা, জামারাতে বাংলাদেশি হজ যাত্রীদের সহযোগিতা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো স্বেচ্ছাসেবকের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এবারে হজে মুজদালিফায় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। মিনা, আরাফা, মুজদালিফায় যেখানে বাংলাদেশিরা থাকেন সেখানে, স্বেচ্ছাসেবক, পর্যাপ্ত পানি ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা রাখাতে হবে। যেসব দেশে বেশি লোক হজে যায় তাদের সঙ্গে মেডিকেল টিম থাকে। বাংলাদেশিরা মক্কা মেডিকেল টিমের অবস্থান জানত কিন্তু মদিনায় এ টিমের অবস্থান সিংহভাগই হাজীই জানতেন না। যেহেতু মসজিদে নববীতে সবাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তাই তার আশপাশে মেডিকেল টিমের অবস্থান হওয়া বাঞ্ছনীয়। মিনা, আরাফা ও মুজদালিফায় ও জামারায় পাথর নিক্ষেপের স্থানে হেলথক্যাম স্থাপনসহ সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য সাইনবোর্ড নির্দেশফলক ঝুলিয়ে দিতে হবে।

মিনা ও আরাফাতে পর্যাপ্ত টয়লেট গোসল খানা, অজুখানার ব্যবস্থা করতে হবে। ওখানে যতগুলো আছে তাতে আট থেকে ১০ জনের পেছনে লাইন ধরে বসতে হয়। অনেক সময় পায়খানার বেগ বেশি হলে থাকা কষ্টকর। তা ছাড়া বাংলাদেশের বেশি মানুষ হজে যায় শেষ বয়সে তাদের এই বৃদ্ধ বয়সে আরো কষ্টসাধ্য। উন্নত দেশগুলো থেকে আসা হাজিদের জন্য অনেক ভালো আয়োজন থাকে। আসলে ইসলামের সমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আল্লাহর সব মেহমানদের সমণ্ডসুবিধা প্রদানের ওপর জোড় দেয়া উচিত। হজ সম্পাদনে শয়তানকে তিন দিন পাথর মারতে হয়। সাধারণত মিনা মক্কা ও আজিজিয়ার থেকে জামারাত যাওয়ার জন্য বাস সার্ভিস চালু আছ যা পর্যাপ্ত নয়। আবার অনেক সময় বন্ধ থাকে তখন হাজীদের হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না আজিজিয়া থেকে বাসে উঠতে যে চাপাচাপি তা বর্ণনাতীত। হাঁটতে গিয়ে গরমে হাজীরা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন এতে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। তাই এ পথে পর্যাপ্ত যান বাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ফ্লাইওভার বা চলন্ত পথের ব্যবস্থা করতে হবে। হজে গিয়ে ওদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে ব্যাপক কথা বলতে হয়। কিন্তু ওরা আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ হাজী-আরবি বোঝেন না এতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। আরবির পাশাপাশি আর্ন্তর্জাতিক দুই একটি ভাষায় ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি কিছু আদেশ ও নির্দেশনার অডিও রেকর্ড বসানো বা শোনানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

হজ আর্থিক, শারীরিক ও মানষিকভাবে সামর্থবান নারী পুরুষের জন্য একটি ফরজ ইবাদত। এছাড়া হজের সঙ্গে আবেগ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মিশে আছে। তাই মানুষজন জমিজমা ভিটেমাটি বিক্রি করে হাজার মাইল দূরে থেকে আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ দর্শনে ছুটে যান, তাই আবেগের এই জায়গাটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ামাদের হজ আয়োজনকে সাজাতে হবে। যদিও এরইমধ্যে হজের দুটি প্যাকেজের দাম কমানো হয়েছে যা পর্যাপ্ত নয়। ছাত্র জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে নতুন সরকার এসেছে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে হজের খরচ ও হজযাত্রীদের ভোগান্তি কমে আসবে। হাজীরা হজের প্রতিটি কার্যক্রম আরো স্বস্তির সঙ্গে সম্পাদন করতে পারবেন।

লেখক : প্রভাষক, পোড়াদিয়া ওয়াসিম উদ্দিন খান ডিগ্রি কলেজ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত