যদিও মূলধারার মার্কিন মিডিয়া ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের অত্যাচার, উত্তর গাজায় জাতিগত নিধনের বাস্তবতা আড়াল করতে আগ্রহী, তবে সুশীল সমাজ, ছাত্র, অধ্যাপক, মানবাধিকার সংস্থা, স্বাধীন সাংবাদিক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক আদালতব্যবস্থা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। তাদের প্রচেষ্টা বিশ্বজুড়ে ইসরায়েল কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার নিন্দার এক অভূতপূর্ব তরঙ্গ তৈরি করেছে। নভেম্বরে ইহুদিবাদী নীতির কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ইসরায়েলি সংসদ সদস্য ওফার কাসিফকে নেসেট (ইসরায়েলের সংসদ) থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তাকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে গাজার গণহত্যার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা আনার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার অভিযোগে তদন্ত করা হয়। ইসরায়েলের এথিক্স কমিটি কাসিফকে ‘ইসরায়েলি সৈন্যদের রক্ত ঝরানোর উস্কানি’ দেয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। তার অপরাধ ছিল- পশ্চিম তীরে দখল প্রতিরোধকারী ফিলিস্তিনিদের ‘স্বাধীনতা যোদ্ধা’ হিসেবে বর্ণনা করা। কমিটি আরো দাবি করে যে, তার বক্তব্য ‘গণহত্যার অভিযোগ মোকাবিলা করতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে’ এবং এটি ‘ইসরায়েলি প্রচার’ ব্যাহত করেছে। তবে কাসিফকে চুপ করানোর এই প্রচেষ্টা উল্টো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নেসেট থেকে জোরপূর্বক বহিষ্কারের পর তিনি একটি ইউরোপীয় সফরে যান। এই সফরে তিনি লন্ডনের মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরি এবং ওয়াইএমসিএ-তে বিশাল জনসমাগমের সামনে বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি ইসরায়েলি নীতির কঠোর সমালোচনা করে গাজায় সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা-ই হোক, এক সময়ের অত্যন্ত কার্যকর ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা মেশিনটি ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে কেবল কাসিফ একাই কাজ করেননি। ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর, স্বাধীন প্রকাশনা সংস্থা OR Books, ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্ট সাইডে তাদের ছোট্ট কার্যালয়ে ফিলিস্তিনি শিক্ষক ও কবি রিফাত আল-আরাইরের বই ওভ ও Should Die: Poetry and Prose প্রকাশের আয়োজন করে। দুর্ভাগ্যবশত, রিফাত আল-আরাইরকে ৬ ডিসেম্বর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় হত্যা করা হয়। বইটির ভূমিকা লিখেছেন, সৃজনশীল ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক সুজান আবু আল-হাওয়া। তিনি উল্লেখ করেছেন, রিফাতের সাথে তার প্রথম পরিচয় ঘটে যখন তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস Morning in Jenin নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস লিখছিলেন। এরপর থেকে, টুইটার (বর্তমানে এক্স) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়। তারা নিয়মিত বার্তা ও আলোচনা বিনিময় করতেন। কিন্তু ২০২৩ সালের শুরুর দিকে, সুজান আবু আল-হাওয়ার অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়, ইহুদিবাদী প্রচারণার ফলস্বরূপ আবু আল-হাওয়া বইয়ের ভূমিকার একটি স্মরণীয় অংশে লিখেছেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলার সময় রিফাত তাকে টুইটারে একটি নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে বলেন: ‘আমাদের সেখানে আপনার কণ্ঠস্বর দরকার।’ তিনি মজা করে উত্তরে বলেন, ‘আপনার প্রথম চারটি অনুসরণকারী।’ এই কথোপকথনের মধ্যেই বন্ধুত্বের গভীরতা এবং প্রতিরোধের চেতনা ফুটে ওঠে। আবু আল-হাওয়া দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন: ‘সুজান আবু আল-হাওয়া আর কখনো চুপ করা হবে না।’
If I Should Die বইটির প্রকাশনা ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডার দেয়ালে একটি শক্তিশালী আঘাত হানে। বহুদিন ধরে ইসরায়েলি প্রচার যন্ত্র ফিলিস্তিনিদের মানবিক চেতনা, শিল্প ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু এই বইটি সেই মিথকে চ্যালেঞ্জ করে। বইটি প্রকাশের পরই বিশাল সাফল্য লাভ করে। প্রকাশকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, প্রিন্ট কপি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। শিগগির এটি বিশ্বের ৫০টি সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের মধ্যে স্থান পায়। অন্য এক অঙ্গনে, অক্সফোর্ড ইউনিয়ন একটি ঐতিহাসিক বিতর্ক হয়েছে। যার শিরোনাম ছিল: ‘এই হাউস বিশ্বাস করে যে ইসরায়েল গণহত্যার জন্য দায়ী একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র।’ বিতর্কের অন্যতম প্রধান বক্তা ছিলেন ফিলিস্তিনি লেখক ও কবি মুহাম্মদ আল-কুর্দ। তিনি তার বক্তৃতা শুরু করেন এক শক্তিশালী ও গভীরভাবে স্পর্শকাতর বক্তব্য দিয়ে: ‘ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে করি না যে, জ্বলন্ত মাংসের উপস্থিতিতে বিতর্কের অবকাশ আছে।’ এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি সরাসরি ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যার প্রতি ইঙ্গিত করেন। আল-কুর্দি জোর দিয়ে বলেন, গণহত্যার মতো একটি স্পষ্ট ইস্যুতে আলোচনা করা ঘৃণ্য ও অমানবিক। তার ভাষায়, ‘জায়নবাদ হলো জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, হত্যা ও জমি চুরির ওপর ভিত্তিশীল একটি আদর্শ। এই সত্য বিতর্কের বিষয় নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্বের অধিকারই তাদের চোখে অপরাধ। তাদের সমস্যা আমাদের জীবনযাত্রার সাথে নয়, আমাদের অস্তিত্বের সাথে।’ অন্য বক্তা, সৃজনশীল ঔপন্যাসিক সুজান আবু আল-হাওয়া, তার বক্তব্যে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি ইতিহাসের জন্য এখানে আছি। আমি এখনো জন্মগ্রহণ না করা প্রজন্মের সাথে কথা বলছি, এই অদ্ভুত যুগের ঘটনাগুলো রেকর্ড করছি যেখানে প্রতিরক্ষাহীন আদিবাসীদের ওপর বোমা হামলাকে বৈধ বলে মনে করা হয়। আমি এখানে আমার দুই দাদির জন্য আছি, যারা নিঃস্ব শরণার্থী হিসেবে মারা গেছেন, আর বিদেশি ইহুদিরা তাদের চুরি করা বাড়িতে বসবাস করছে।’ বিতর্ক শেষে প্রস্তাবটি ভোটের মাধ্যমে পাস হয় এবং এটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদিত হয়। বিতর্কের পর আর্সেন অস্ট্রোভস্কি, একজন ইসরায়েলি ডিফেন্ডার, র২৪ চ্যানেলে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তিনি এটিকে ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘এটি আলোকিত চিন্তা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ছদ্মবেশে হামাসকে উৎসাহিত করছে।’ তবে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, ইসরায়েলি অবস্থান আগের চেয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ৭৫০ পৃষ্ঠার একটি মামলা জমা দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ৩০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে। এই ঘটনাগুলো ইসরায়েলের অবস্থানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও চাপে ফেলছে এবং বর্ণবাদী ও গণহত্যাকারী রাষ্ট্র হিসেবে তাদের পরিচিতি সুদৃঢ় করছে। ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সাড়া এবং প্রতিবাদে এটি স্পষ্ট যে, ইসরায়েলি সৈন্যদের কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী চিত্রিত ভিডিও ক্লিপগুলোর মাধ্যমে উঠে এসেছে। তবে, পশ্চিমা মিডিয়া এবং তাদের সরকারগুলো তা উপেক্ষা করেছে। এই ভিডিওগুলো তাদের ক্রিয়াকলাপের প্রকৃত চিত্রকে প্রকাশ করেছে, কিন্তু সেই প্রমাণগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগে বাধা দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ রামজি বারুদ উল্লেখ করেছেন যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এটি ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধীদের জবাবদিহিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং একটি নতুন আন্তর্জাতিক স্তরে বিচার শুরু করার সংকেত।
ইসরায়েল একটি নতুন এবং অপ্রতিরোধ্য আন্তর্জাতিক প্রবণতার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি ইসরায়েলের গণহত্যামূলক শাসনকে এখন সমালোচনায় পরিণত করেছে। ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা আর তার কর্মকাণ্ডকে বিশ্বব্যাপী ন্যায্যতা দেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। গাজার ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে তার নির্মূলের প্রচেষ্টা এখন আন্তর্জাতিক বিচার এবং জবাবদিহিতার আওতায় এসেছে। ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা, যারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, তাদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে গণহত্যার চিত্র বিশ্বকে জানিয়ে চলেছেন। এভাবে বিশ্বব্যাপী এই বিষয়টি আরও জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে, আমেরিকার জনমত ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখাচ্ছে। সম্প্রতি জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ আমেরিকান এখন ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার পক্ষে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই চেতনা আরো প্রবল হয়ে উঠছে। আমেরিকান নির্বাচনের পর, ফিলিস্তিনের সমর্থনে তরুণরা মার্কিন সিনেটে স্লোগান দিচ্ছিল, যাতে তারা ২০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র প্যাকেজ বাতিলের দাবি জানায়। যদিও প্যাকেজটি বাতিল হয়নি, কিন্তু ১৯ সিনেটর অস্ত্রের চালান বন্ধ করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন, যা মার্কিন কংগ্রেসের ইতিহাসে একটি অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ। অবশেষে, রিফাত আল-আরাইর, যিনি একজন শিক্ষক এবং কবি ছিলেন, তার উত্তরাধিকার এখনো জীবিত রয়েছে। তার কাজ এবং শৈলী আজও অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে। তিনি সবসময় একটি বই হাতে তরুণদের সঙ্গে লেখালেখির বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন, যা তার কাজকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখে। এখন ইসরায়েল যে ‘মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতার প্রতীক’ হিসেবে প্রচার করেছিল, তার মিথ ভেঙে পড়েছে। সেই মিথের প্রতি জনগণের বিশ্বাস আর নেই এবং সময়ের শক্তি ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কোনো ‘রিসেট বাটন’ নেই। শব্দ, শিল্প এবং মানবতার মাধ্যমে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে এবং এটি বিশ্বকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিচার বিবেচনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক