বাংলাদেশে খনিজ সম্পদে সম্ভাবনা খাত হিসেবে দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সংশ্লিষ্ট খাতে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন প্রকৌশলী দরকার, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানসম্পন্ন লোক গড়ে তুলতে প্রয়োজন নিরন্তর গবেষণা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
পাশাপাশি, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণে প্রয়োজন প্রযুক্তির প্রয়োগ। দ্রুত এসব করা সম্ভব হলে আমাদের মাটি, পাহাড় ও পানির নিচে লুকিয়ে থাকা বিপুল খনিজ সম্পদ বিশেষ করে তেল, গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ আবিষ্কার, অনুসন্ধান, আহরণ করে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা সম্ভব হবে।
বর্তমানে দ্বীপ জেলা ভোলা, পাহাড়ি অঞ্চল সিলেট, নোয়াখালীর সুবর্নচর, নদ-নদী পাহাড়ের সমম্বয়ে গড়ে ওঠা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস প্রাপ্তি এবং তা উত্তোলন করা হচ্ছে। দেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর, দ্বীপাঞ্চলসহ দেশের অপরাপর নদ-নদীতে অনুসন্ধান চালানো গেলে অদূর ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এজন্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আরো উদ্যোগী হলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস হতে পারে। আবার এগুলো দিয়ে চলমান জ্বালানি সংকট নিরসন, এমনকি জ্বলানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সম্ভব।
পনিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ১৬টি জেলায় ১০ ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- কয়লা, পিট, কঠিন শিলা, সাধারণ পাথর বা বালু মিশ্রিত পাথর, সিলিকা বালু, সাদামাটি, খনিজ বালু, চুনাপাথর, ধাতব খনিজ ও লোহার আকরিক। প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্য দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি)। তাদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রাকৃতিকভাবে মজুদ খনিজ সম্পদের মূল্য তিন দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন (তিন লাখ ২৬ হাজার কোটি) ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩৪১ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন (তিন কোটি ৪১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০০ কোটি) টাকা।
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে আবিষ্কৃত উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা, কঠিন শিলা, সাধারণ পাথর বা বালু মিশ্রিত পাথর, সিলিকা বালু ও সাদামাটি উত্তোলন করা হয়ে থাকে। নদী ও উপকূলীয় এলাকা কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মেঘনার হাতিয়া, যমুনা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদে খনিজ বালু আছে। বড় নদীগুলোতে আছে মূল্যবান খনিজ বালু।
এসব খনিজ বালু উত্তোলনের পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই। তবে কিছু কিছু সাদামাটি স্থানীয়ভাবে উত্তোলন হচ্ছে। সঙ্গে কিছু কাচবালুও উত্তোলন হচ্ছে। দেশে আবিষ্কৃত খনিজ সম্পদের যে আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করা হয়েছে, তা মূলত মজুদ থেকে পাওয়া ধারণাগত একটি সংখ্যা। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা সম্ভব হলে খনিজ সম্পদের পরিমাণ যেমন বাড়বে, তেমনি এ সম্পদের যথাযথ আকার, আকৃতি ও ধরন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি বাজারমূল্য অনুযায়ী সম্পদের প্রকৃত আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করা সম্ভব হবে। দেশের অধিকাংশ খনিজ সম্পদের আবিষ্কারক ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর বা জিএসবি। খনিজ সম্পদের আরো অনুসন্ধান ও গবেষণা বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য অনুসন্ধান ও গবেষণা কাজে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ দেয়া দরকার।
অথচ এজন্য বছরে বরাদ্দ থাকে মাত্র পাঁচ কোটি টাকারও কম। প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্য প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। আর্থিক বরাদ্দ ছাড়াও জিএসবির অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও পরিবহনেরও সংকট নিরসন করা জরুরি। এপর্যন্ত জিএসবি দেশে আবিষ্কৃত নয় ধরনের খনিজ সম্পদ আবিষ্কার করেছে তারমধ্যে শুধু কয়লা রয়েছে সাত হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টন। জিএসবি আবিষ্কৃত কয়লা ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে শুধুমাত্র বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।
উত্তোলিত কয়লা দিয়ে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। দিঘিপাড়া ও খালাশপীর কয়লা ক্ষেত্রের ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করা হয়েছে। জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্রের অবস্থান গভীরে থাকায় এখান থেকে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে চাহিদার ভিত্তিতে ইউজসি পদ্ধতি ব্যবহার করে অথবা কোল বেড মিথেন আকারে উত্তোলন করা যেতে পারে। এছাড়া পিট কয়লার সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টন। চুনাপাথর রয়েছে তিন হাজার ৫২৭ কোটি টন। টনপ্রতি ৩০ ডলার হিসেবে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০ হাজার ৮১০ কোটি ডলার। কঠিন শিলা আছে ২০ কোটি ১০ লাখ টন, যার আর্থিক মূল্যমান ৫৪২ কোটি ডলার। ২৩ কোটি টন সাদামাটির মূল্য দুই হাজার ৯৯০ কোটি ডলার। কাচবালু আছে ৫১১ কোটি ৭০ লাখ টন, যার মূল্য ছয় হাজার ১৪০ কোটি ডলার। ২২০ কোটি টন নুড়িপাথরের মূল্যমান তিন হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এবং সাড়ে ৬২ কোটি টন লৌহের মূল্য ছয় হাজার ৮৮০ কোটি ডলার। তথ্য অনুযায়ী দেশে খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ জেলা সমূহের মধ্যে রয়েছে- সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাগুলো। পাঁচটি কয়লাক্ষেত্রের মধ্যে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ১৯৮৫ সালে আবিষ্কার করে। এতে কয়লা মজুদ আছে ৩৯০ মিলিয়ন টন। দিনাজপুর দিঘীপাড়া কয়লাখনি জিএসবি ১৯৯৫ সালে আবিষ্কার করে। এতে ৭০৬ মিলিয়ন ১৯৯৭ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লাখনিটি আবিষ্কার করে। এতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। এছাড়া ১৯৫৯ সালে জিএসবি আবিষ্কৃত কয়লাখনি জয়পুরহাটের জামালাগঞ্জে ৫৪৫০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। দিনাজুপরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি রয়েছে। আর সাধারণ পাথর বা বালু মিশ্রিত পাথর কোয়ারি রয়েছে সিলেটে আটটি, সুনামগঞ্জে দুইটি, পঞ্চগড়ে ১৯টি, লালমনিরহাটে ১১টি এবং পার্বত্য জেলা বান্দারবানে ১০টি। এসব স্থানে মোট এক হাজার ৯৬৬ হেক্টর আয়তনে পাথর বা বালু মিশ্রিত পাথর রয়েছে। এছাড়া সিলিকা বালু রয়েছে- সিলেটে তিনটি, মৌলভীবাজারে ৫২টি এবং হবিগঞ্জে ২৩টি। এসব স্থানে ৩৩২ হেক্টর আয়তনে সিলিকা বালু রয়েছে। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) তথ্য মতে, পার্বত্য অঞ্চলে অনেক ধরনের খনিজ সম্পদ থাকতে পারে, তবে কী ধরনের খনিজ রয়েছে তার সম্ভাবনা সম্পর্কে আরো বেশি বেশি স্টাডি প্রয়োজন। চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লা উত্তোলনে অনেক দুর্ঘটনার সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশ হয়, কিন্তু আশার কথা জচ্ছে বাংলাদেশে কয়লা উত্তোলনে তেমন কোনো দুর্ঘটনা নেই। তাই আরো বেশি হারে কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। আমাদের দেশে কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ কম। সাধারণ বালুও একটি খনিজ সম্পদ, বালু থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় হয়। চুনাপাথর মজুদের বিষয়ে জিএসবির তথ্য, দেশে সবচেয়ে বেশি চুনাপাথর মজুদ রয়েছে উত্তরের জেলা নওগাঁয়। জেলায় তাজপুর, বদলগাছি, ভগবানপুরে ২৫ হাজার মিলিয়ন টনের বেশি চুনাপাথর মজুদ রয়েছে। এছাড়া জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট সদরে ২৭০ মিলিয়ন টন, পাঁচবিবি উপজেলায় পাঁচ কোটি ৯০ লাখ টন এবং সুনামগঞ্জের বাঘালীবাজারে এক কোটি ৭০ লাখ টন, টেকেরঘাটে এক কোটি ২৯ লাখ টন ও লালঘাটে এক কোটি ২৯ লাখ টন চুনাপাথরের মজুদ রয়েছে। খনিজ সম্পদ হিসেবে মূল্যবান সাদামাটি রয়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে সাড়ে ১২ কোটি টন, হবিগঞ্জের মাধবপুরে ছয় কোটি ৮০ লাখ টন, নেত্রকোনার বিজয়পুরে আড়াই কোটি টন। দেশের ছয় জেলায় বিপুল পরিমাণ নুড়িপাথর মজুদের তথ্য জানায় সংস্থাটি। এসব জেলায় নুড়িপাথরের মোট মজুদের পরিমাণ ২২০ কোটি টন। দিনাজপুরের হাকিমপুরে আকরিক লৌহ মজুদ রয়েছে ৬৫ কোটি টন। এ ছাড়া কাচবালির মজুদ রয়েছে তিন হাজার ২০০ কোটি টনের বেশি। জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবীর খান ইতোপূর্বে বলেছেন, দেশের খনিজ সম্পদের উজ্জ্বল সম্ভাবনার তথ্য সরকারের কাছেও আছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও জানান তিনি। জ্বলানিী ও খনিজ সম্পদ খাতে সম্ভাব্যতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও বস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতিই আমাদের প্রত্যাশা। এসব বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে জ্বালানি সংকট সমাধানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে নব যুগের সূচনা ঘটবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।