ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় দেখেছি বছরের কিছু সময় বাদে ভ্রমণ পিপাসুরা পর্যটন এলাকাগুলোতে ঘুরে বেড়ান। তাছাড়া বেশিরভাগ পর্যটকই বছরের কয়েকটা মৌসুমে ভ্রমণের প্রতি বেশি আগ্রহী থাকেন। অধিকাংশই বর্ষাকাল ও শীতকালে। তবে স্থান ভেদে কেউ শীত, কেউ বর্ষায় আবার কেউ বছরজুড়েই ভ্রমণ করেন। কিন্তু শীত আর বর্ষা মৌসুমে পর্যটন স্পটগুলোতে বেশি পদচারণ দেখা যায়। আর সিলেটকে উদ্দেশ্য করে সেসব ভ্রমণ প্রেমীরা ঝর্ণা ও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আসা স্বচ্ছ শীতল পানিতে গা ভাসাতেই বেশি পছন্দ তাদের। তাই সিলেট ভ্রমণের ক্ষেত্রে বর্ষাই তাদের প্রথম টার্গেট হয়ে থাকে। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে শীতের সময়টাতেও প্রচুর পর্যটকে মুখরিত থাকে সিলেট। কারণ ডিসেম্বরে বাচ্চাদের পরিক্ষা শেষ। স্কুল-কলেজও বন্ধ। সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগান অনেকেই। আমাদের ভ্রমণ যাত্রা যেভাবে শুরু করি। ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ মঙ্গলবার রাত ১১ টায় বাসা থেকে ফকিরাপুল বাস কাউন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পৌঁছাই রাত ১১.৩০-এ। বাসা থেকে বাস কাউন্টারের দূরত্ব ২০-২৫ মিনিট, গাড়ি ছাড়বে রাত ১২.৩০ (বুধবার)। কিন্তু সিলেটের উদ্দেশ্যে বিলম্বে গাড়ি ছাড়ে ১টার পরে। রাস্তায় বেশ জ্যাম পোহাতে হয়। অবশেষে আড়াই ঘণ্টা বিলম্বে সকালে সিলেট পৌঁছাই। তাছাড়া এ সময়টাতে প্রচুর পর্যটক থাকাতে একদিন আগেই আমাদের রুম বুকিং করি। তারপর হোটেলে ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে কালবিলম্ব না করেই লেগুনা ভাড়া করি। ১০ জনের টিম নিয়ে বের হয়ে পড়ি। প্রথম দিন মালিনীছড়া চা বাগান। শহর থেকে অনেকটা কাছেই। তাছাড়া বেশির ভাগ পর্যটকই ওই পথে গেলেই বাগানে ঢুঁ মারে। আমরাও সেটা করলাম। কিছু সময় চা বাগানে গ্রুপের অন্যদের সাথে ফটোসেশানে নিজেকে স্বাক্ষী রাখলাম। তারপর রাতারগুল, সাদা পাথর ঘুরে রাতে হযরত শাহজালাল মাজারে প্রবেশ করি। রোডের আশপাশে আড্ডায় সময় কাটাই এবং ডিবির হাওর ও জাফলংয়ের জন্য ওই রাতেই একটা হাইস ভাড়া করি। পরের দিন সাতসকালে উঠেই প্রথমে ডিবির হাওর শাপলা বিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। কারণ ভ্রমণের অংশ এটি। অবশেষে সেটাই হলো। একটা বিষয় মনে রাখবেন। কিছু জায়গায় ঘুরতে গেলে অবশ্যই ভোরে উঠে রনা দিবেন। তাহলে আপনার ভ্রমণ স্বার্থক হবে। তা না হলে আধাআধি দেখায় অতৃপ্তি থেকে যাবে। এবারের ভ্রমণ গল্পটা সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা ডিবির হাওরকে উদ্দেশ্য করে। শাপলা বিল কিন্তু কয়েকটি জেলাতেই রয়েছে। প্রথমত বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামের কথা বলতে পারি। ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার শিমুলিয়া গ্রামে রয়েছে শাপলা বিল। গাজীপুরের কাপাসিয়ার নরাইট বিল। নেত্রকোণার কাগতি ইউনিয়নের নাড়িয়াপাড়া গ্রামে ঘোড়াদিঘীতেও রয়েছে চোখজুড়ানো শাপলা বিল। এছাড়া দেশের আনাচে-কানাচেও ছোট-বড় বহু শাপলা বিল রয়েছে।
সিলেটের জৈন্তাপুরে মূলত চারটি জলাধারের সম্মিলনস্থল। এগুলো হলো ডিবি বিল, ইয়াম বিল, হরফকাটা বিল ও কেন্দ্রী বিলসহ প্রায় ৯০০ একর এলাকাজুড়ে ফোটে লাল শাপলা। এছাড়া জৈন্তাপুর শ্রীপুরেও শাপলা বিল রয়েছে। এই জলাশয়গুলোর অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মেঘালয়ের পাদদেশে। একপাশে পাহাড়, তার নিচেই বিস্তীর্ণ জলরাশি যা ভরে আছে শাপলায়। সব মিলিয়ে যেন এক জাদুকরী দৃশ্য তৈরি হয়। যেদিকে চোখ, সেখানেই রাশিরাশি লাল শাপলা যে কারো হৃদয়েই স্পন্দন জেগে তুলবে। আমাদের উদ্দেশ্যে যেহেতু ডিবির হাওর লাল শাপলা অভিযান। তাই দৃষ্টি আমাদের ওইদিকেই। ডিবির হাওর ঘুরতে গেলে কেবল শাপলার সৌন্দর্যই আপনাকে মুগ্ধ করবে না, সেখানে থাকা পরিযায়ী পাখি যেমন পিনটেল হাঁস, সারস বা মাছরাঙ্গার ঝাঁকও আপনাকে হাওরে স্বাগত জানাবে। সেই সাথে শীতের অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দ আপনাকে আরো বেশি শাপলা প্রেমের ভালোবাসায় মুগ্ধ করে দিবে। কীভাবে যাবেন এই বিলে! ডিবির হাওর শাপলা বিলে যাবার পথ খুবই সহজ। সিলেট থেকে এই শাপলা বিলে যেতে বাস, লেগুনা, নোয়া, হাইস, ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় সিলেট-তামাবিল সড়ক ধরে যেতে হবে জৈন্তাপুর। সময় ঘন্টা দেড়েক লাগবে। তারপর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্প ফেলে কাঁচা রাস্তা ধরে গেলেই দেখা মিলবে ডিবির হাওরের। আমাদের রিজার্ভ হাইস ভাড়া ছিল। তবে যে কোন গাড়ি ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় যাবেন, কতো সময় থাকবেন, কখন ফিরবেন সেটা দরদাম করে ক্লিয়ার করে নিবেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু হলে আপনার প্লানিং করা ট্যুরের আসল আনন্দটাই নষ্ট হতে পারে। শাপলা বিলে যেতে হলে অবশ্যই ভোরে যেতে হবে। এক কথায় সূর্য ওঠার আগেই। তাহলে আসল সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। কারণ সাতসকালে শাপলারা উঁকি দেয়। আবার সূর্য ওঠার পরেই ধীরে ধীরে নিজেরা নুইয়ে পড়ে। ভোরে ফোটা সতেজ শাপলা বেলা বাড়তে বাড়তে মিইয়ে যেতে থাকে, তাই শাপলা দেখতে হলে ভোরেই যেতে হবে। ভোরের লাল ফোটা শাপলা প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য দেখতেই মন জুড়িয়ে যায়। চারপাশে শাপলা, পাখির হালকা কিচিরমিচির শব্দ, পানির নীরবতা, আপনাকে যেন অন্য জগতে নিয়ে যাবে। যা আমাদের জাগতিক জগত থেকে একদম অন্যরকম জগতে নিয়ে যাবে। আমরা ডিবির হাওর শাপলা বিলে দশ জনের টিম নিয়ে প্রতি নৌকায় ঘন্টাপ্রতি ৪৫০ করে ৯০০ টাকায় দুইটা নৌকা ভাড়া করলাম। এর আগে গত ৪ বছর এ ভাড়া নির্ধারণ ছিল ৪০০ টাকা। চলতি মাসে ৫০ টাকা যুক্ত হয়ে ৪৫০ টাকা হয়েছে। তবে ১ ঘন্টার বেশি হলে প্রতিঘণ্টায় ২০০ করে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হবে। আমরা ঘণ্টাখানেক নৌকায় ছিলাম। তবে যারাই নৌকায় চড়বেন, ঘড়ির টাইম দেখে নিবেন। আর রোদ থেকে বাঁচার জন্য ১০ টাকার বিনিময়ে ছাতা ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। আমরা দুই নৌকায় ৬টা ছাতা নিয়েছি। নৌকার চড়ে বিলের আগাছা আর লতাণ্ডপাতায় ঘেরা হাজারো শাপলা আপনাকে চোখ জুড়াবেই। সারিবদ্ধভাবে নৌকা করে শাপলা বিল দূরদূরান্ত থেকে পাড়ি জমিয়েছেন অনেক পর্যটক। যারা এ সময়টাতে সিলেট জাফলং যাচ্ছেন, তাহলে যাওয়ার সময়ও একবার ঢুঁ মারতে পারেন শাপলা বিলে। জাফলং থেকে শাপলা বিলের দূরত্ব সামান্য কিছু পথ। আমরা যেটা করেছি জাফলং যাবার আগে প্রথমেই ডিবির হাওর শাপলা বিলের লাল শাপলার হাতছানি দিয়েছি। চোখের সমস্ত কৃপণতা রেখে অপলক দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিলাম গালিচা বিছানো লাল শাপলাকে। তারপর ওখান থেকে জাফলং জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়ল। মাত্র ২০ মিনিটের পথ। ছুটির দিন না হলেও পর্যটকে কোলাহল ছিল জিরো পয়েন্ট। আমরাও ঠান্ডা শীতল পানিতে গা ভাসালাম। সীমান্তে এপারওপার দুই পারের পর্যটকে ছিল পরিপূর্ণ। সবাই শীতল পানিতে গা ভাসাতে ব্যস্ত। আবার কেউ নৌকায় চড়ে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সূর্য নিচে নেমে আসতে শুরু করছে। আমরাও দলবল নিয়ে ওখান থেকে সোজা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। একটা বিষয় বলে রাখি, দেশের যে কোন পর্যটন স্পটগুলোকে সম্ভব হলে শুক্রবার শনিবার ও সরকারি ছুটির দিনগুলো এড়িয়ে চলবেন। যাদের শুক্রবার শনিবার কিংবা সরকারি ছুটির দিনগুলো ছাড়া ভ্রমণে বের হবার কোন সুযোগ নেই। তাদের ভ্রমণের জন্য এসব দিন। প্রশ্ন থাকতেই পারে যে, শাপলা বিল তো দেশের অনেক জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখা যায়। তাহলে সুদূর সিলেটের জৈন্তাপুর ডিবির হাওরে কেন যাবেন! প্রশ্নটা নিজের ওপর ছেড়ে দিন। কথায় বলে, এক ঢিলে দুই পাখি। এখানে এক ঢিলে অনেক পাখিই দেখা হবে। যেমন শীতে এ সময়টাতে যারা সিলেট বেড়াতে যাবেন। অবশ্যই দর্শনীয় স্থানের তালিকায় রাখতে পারেন এই শাপলা বিল। কারণ এ সময়টাতে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি আপনি বিলেও ঘুরে আসতে পারছেন। যেটা বছরের অন্য মৌসুমে দেখার সুযোগ নাও হতে পারে। যেহেতু শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করার সেরা সময় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। তাই এ সময়টাতে সিলেট গেলে ওখানেও ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে। সিলেটে এক দিনের ট্যুরে যেতে পারেন। আবার এক রাত দুই দিন সিলেটে থাকলে অনেক স্পটই ঘুরে আসা সম্ভব হবে। লাল শাপলা বিল দেখে ওখান থেকে জাফলং ঘুরে আসলেন। আবার ১ রাত দুই দিন থাকলে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, রাতারগুল, বিছানা কান্দি, লালা খালসহ আরো কিছু স্পট ঘুরে আসা যায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বর্ষা মৌসুমে মেঘালয় থেকে প্রচুর স্রোত নেমে আসে। এ সময়টাতে বিশেষ করে জাফলং, সাদা পাথর, বিছানা কান্দিতে প্রচুর পানির স্রোত দেখা যায়। অনেক পর্যটকই পরিবার নিয়ে এ সময়টাতে নিরাপদ মনে করে না। আমার কাছেও অতিরিক্ত স্রোতের সময়টাতে এসব স্থান ভ্রমণে স্বচ্ছন্দবোধ মনে হয়নি। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিংবা অভিমত বলতে পারি। আবার একেবারে শুকনো মৌসুম বা শীতে স্পটগুলো শুকিয়ে গেলে, তখন আনন্দদায়কও হয় না। তবে বর্ষায় অতিরিক্ত স্রোত বিপদের কারণ হতে পারে। তবে যারা সিলেটে ঝর্ণা বা পাহাড় থেকে বেয়ে আসা প্রচুর স্রোতে গা ভাসাতে চান। তাদের জন্য বর্ষার সময়ই উৎকৃষ্ট। ভ্রমণে গাড়ির বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকজন বাসযাত্রীদের সাথে কথা বল্লাম। সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে অল্প খরচে সিলেট ভ্রমণের ক্ষেত্রে ইউনিক সার্ভিসের বাসটা ভালো মনে হয়েছে। তাই ফেরার পথে ৭০০ টাকার মধ্যে নন এসিতে চড়ে ওদের সার্ভিসটা তুলনামূলক ভালো মনে হলো। এবারের সিলেট ভ্রমণে পাহাড়, মেঘালয়ের স্বচ্ছ জলরাশির সাথে লাল শাপলা বিলও দেখা হলো।
সাংবাদিক ও লেখক