পরিবেশের অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো বায়ু। বায়ু ছাড়া মানুষ ও অনান্য প্রাণী জগতের অস্তিত্ব কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। বায়ু দূষণ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা। আর যার অন্যতম কার্যকরী নিয়ামক হিসেবে কাজ করে যানজট। আধুনিক নগরজীবনের একটি অতি পরিচিত চিত্র হলো রাস্তায় গাড়ির লম্বা সারি, ক্রমাগত হর্ন ও কালো ধোঁয়ার দূষণ। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রতিদিনকার নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। যানজট শুধুমাত্র মানুষের সময় এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে না, সেইসাথে এটি বায়ুমণ্ডলে দূষিত গ্যাসের মাত্রাও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি করে। বায়ু দূষণ বর্তমান বিশ্বে একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এর অন্যতম কারণ হলো যানজট। যানজট শহরের জীবনযাত্রাকে যেমন ধীরগতি করে, তেমনি পরিবেশে বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। যানজটের কারণে বায়ু দূষণ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে, আর যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক। প্রথমেই একটু ছোট করে জেনে নেয়া যাক, যানজট বিষয়টি আসলে কি? যানজট বলতে রাস্তা বা সড়কে অতিরিক্ত গাড়ির ভিড়ের কারণে গতি ধীর হয়ে যাওয়া বা সম্পূর্ণ স্থির হয়ে যাওয়াকে বুঝায়।
যানজটের কারণে যানবাহনগুলো অনেক সময় ধরে একই স্থানে স্থির থাকে বা ধীরে চলে। এই অবস্থায় গাড়িগুলোর ইঞ্জিন চালু থাকে এবং পেট্রোল বা ডিজেল পুড়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এসব গ্যাস বায়ুমণ্ডকে দূষিত করে এবং মানুষের শ্বাসযন্ত্র, হৃদযন্ত্র এবং ত্বকের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
এছাড়াও অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়িসমূহ যথাসময়ে জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে পৌঁছাতে পারে না। উল্টো গন্তব্যে পৌঁছাতে তড়িঘড়ি করার কারণে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
৩.৯ বিলিয়ন মানুষ বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শহরে বাস করে। ধারণা করা যাচ্ছে যে ২০৩০ সালের নাগাদ প্রায় ৫ বিলিয়ন মানুষ শহরে বাস করবে। সারা বিশ্বের শহরগুলো পৃথিবীর ভূমির মাত্র ৩ শতাংশ দখল করে, তবুও শক্তি খরচের ৬০-৮০ শতাংশ এবং কার্বন নির্গমনের ৭৫ শতাংশের জন্য দায়ী। জাতিসংঘের পপুলেশন ফান্ডের মতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সর্বমোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৪৭ লক্ষ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে প্রায় ৮৮, ০০০ মানুষের মৃত্যু হয়ছে। যার মধ্যে ঢাকা বিভাগে মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক। দিন দিন ঢাকা শহরে ব্যাপক হারে বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যার প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে যানজট। যানজটের কারণে নির্গত দূষিত গ্যাসগুলো গ্রিনহাউজ প্রভাব বাড়িয়ে তোলে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ। বিষয়টি প্রায় খাল কেটে ঘরে কুমির আনার মতো। যার দায়ভার আসলে কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর চাপালে হবেনা, বরং এ দায় আমাদের সকলের।
বিশেষত শহুরে এলাকাগুলোতে যানজটের পরিমাণ প্রচুর পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। সব কিছুরই যেমন একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে, ঠিক তেমনি বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অতিক্রম করলে পরে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সাধারণ মানুষের শরীরে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে গড়ে ১০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত দূষণ সহনীয়। অতি উদ্বেগর বিষয় এই যে, ঢাকার বাসিন্দাদের গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম বায়ুদূষণ সহ্য করতে হচ্ছে। কিন্তু যানজটে আটকা পড়লে এই মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছায়। সারা দেশে বর্তমানে মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৫৯,৮২,৭৬৪টি, যা ২০১০ সালে ছিল ১৪,২৭,৩৬৮টি। এ থেকে সহজেই অনুমেয় মোটরযানের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যানজট ও বায়ু দূষণ দুটোই কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৩ সালে বায়ু দূষণে বিশ্বে শীর্ষস্থানে ছিল। ঢাকা শহর বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঢাকার বাতাসে ক্যাডমিয়াম প্রায় ২০০ গুণ বেশি, নিকেল ও সিসার মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্রোমিয়াম প্রায় ৩ গুণের বেশি। সিসা দূষণের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
এর ফলে বছরে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। শিশুদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মানদ- অনুযায়ী, স্কোরশূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু জানুয়ারি ১১, ২০২৪ তারিখে, সকাল ৯টায়, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (অছও) স্কোর ২৮০ নিয়ে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে শীর্ষ স্থান দখল করে নেয়। এছাড়া, ২০২৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ঢাকা টানা পাঁচ দিন বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। যা আমাদের দেশের জন্য বর্তমানে হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। এখন শীতকাল হওয়ায় বায়ু দূষণের প্রকোপ আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে বিভিন্ন দ্রুত গতির যানবাহন আবিষ্কার নিসন্দেহে জীবনকে গতিশীল করলেও, অন্যদিকে যানজট সেই গতিতে যোগ করেছে স্থবিরতা। তীব্র যানজটের কারণে শুধুমাত্র যে মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতির ক্ষতি হচ্ছে এমনটি নয়। দীর্ঘ যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূল্যবান সময়। রাজধানীর সড়কে পরিচালিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় দেখা যায়, গত বছর শুধুমাত্র রাজধানীতেই যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ কর্মঘণ্টা। আর তীব্র এ যানজটে নষ্ট হওয়া অতিরিক্ত সময়ের মূল্য গড়ে ঘণ্টায় ৭০ টাকা ধরে হিসেব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গবেষকরা মনে করেন, যদি রাজধানীর যানজট ৬০ শতাংশ কমানো যায়, তাহলে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তিন প্রকৌশলীর বর্ণনামতে, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতি মাসে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২২৭ কোটি টাকা। আর প্রতিবছরে যার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। আর যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসডিজি ১১-এর ১০টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হয়েছে এবং এটি ১৫টি সূচক দিয়ে পরিমাপ করা হচ্ছে।
সাতটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে টেকসই পরিবহনব্যবস্থা। এসডিজি ১১-এর উদেশ্য হলো বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব হ্রাস, শহরগুলির পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস এবং নিরাপদ, সবুজ এবং পাবলিক স্পেস অ্যাক্সেস প্রদান করা। যানজটের মূল কারণগুলো হলো: অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অতিরিক্ত যানবাহন, ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত না হওয়া, নিম্নমানের পেট্রোল ও ডিজেল ব্যবহার ইত্যাদি।
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন ও নীতিমালা সমূহ : পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (ঊহারৎড়হসবহঃ ঈড়হংবৎাধঃরড়হ অপঃ, ১৯৯৫) : এই আইনটি পরিবেশের সুরক্ষা ও উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। এর অধীনে বায়ু দূষণের জন্য দায়ী উৎস শনাক্ত করা, দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বিধিমালা, ১৯৯৭ : এই বিধিমালার মাধ্যমে নতুন শিল্প স্থাপন বা প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে বায়ু, পানি, মাটি এবং অন্যান্য পরিবেশগত উপাদানের উপর সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়।
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৫ : এই বিধিমালায় শিল্প, যানবাহন এবং অন্যান্য উৎস থেকে নির্গত বায়ু দূষণ সীমিত করতে বিশেষ নিয়মাবলী ও মান নির্ধারণ করা হয়েছে।
জাতীয় পরিবেশনীতি, ২০১৮ : এই নীতিমালার মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়, যার মধ্যে বায়ু দূষণ কমানো এবং সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করাও রয়েছে।
যানজট শুধু সময় ও অর্থের অপচয় করে না, বরং বায়ু দূষণের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যানজট কমানোর মাধ্যমে বায়ু দূষণ হ্রাস করা সম্ভব। এজন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ, সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা, উন্নত ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহনের ব্যবস্থা, মানুষকে গণপরিবহন ব্যবহার এবং যানজটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং সিস্টেম ও ট্রাফিক নজরদারি প্রযুক্তি চালু করতে হবে। সর্বোপরি উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে একটি দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব। যানজটের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণ শুধু পরিবেশের জন্য নয়, বরং মানুষের জীবনযাত্রার জন্যও ক্ষতিকর। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, সঠিক পরিকল্পনা, এবং কার্যকরী আইনের বাস্তবায়ন। যানজট কমিয়ে একটি দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলাই আমাদের সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। পরিশেষে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলি-
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।