বিশুদ্ধ বাতাস, স্বচ্ছ ও নিরাপদ পানীয় জল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং নিরাপদ বাসস্থান-স্বাস্থ্য সম্পদের এই মৌলিক চাহিদাগুলোকে প্রভাবিত করছে জলবায়ু পরিবর্তন। সাম্প্রতিক অতীতে, বছরে অতিরিক্ত ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে শুধুমাত্র বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে। জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ও সংবেদনশীল স্বাস্থ্য-সমস্যাগুলো, যেমন- অপুষ্টি, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু ইত্যাদি ভয়াবহ আকার নিতে চলেছে। আগে পৃথিবীর যেসমস্ত অঞ্চলে ভৌগোলিক কারণে এগুলোর প্রকোপ ছিল না বা কম ছিল, জলবায়ু পরিবর্তন সেই অঞ্চলগুলোতে ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে নতুন স্বাস্থ্য-সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এই সমস্যার আকস্মিকতা ও ব্যাপ্তি সামলানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। শুধুমাত্র রোগের বিরুদ্ধে লড়াই। পরিবেশকে শীতল ও নির্মল করার সমস্ত উদ্যোগের পাশাপাশি, উন্নততর যাতায়াত, খাদ্য ও জ্বালানি ব্যবহার স্বাস্থ্য-সমস্যার এই নতুন দিকটিকে অনেকটা সামাল দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে এমনটাই জানা যাচ্ছে।
কিন্তু সমস্যার মূলে যে জলবায়ু পরিবর্তন সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশ-বিরোধী নানারকম ক্রিয়াকলাপের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি জীবাণু জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোকে উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে যার ফলে বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে তা প্রভাবিত করছে পৃথিবীর জলবায়ুকে। বিভিন্ন অঞ্চলে বদলে যাচ্ছে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের প্রকৃত, পরিমাণ এমনকী ‘ঋতুছন্দ’ও। গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর উষ্ণতা প্রতি দশকে প্রায় ০.১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়ে চলেছে। গলে যাচ্ছে হিমবাহ ও মেরু প্রদেশের বরফ। সমুদ্রতলের উচ্চতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। প্রসঙ্গত, ‘এশিয়া অঞ্চল’- এর সমুদ্রতল ৪০ সেমির বেশি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়ার চরমতা প্রায়ই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঠান্ডা বা গরমের তীব্রতা লক্ষ্যণীয়ভাবে স্পষ্ট হচ্ছে।
বিশেষ করে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তনগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রকমের স্বাস্থ্যসমস্যা ডেকে আনছে। যেমন, তীব্র গরম, কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। বয়স্ক মানুষ বেশি সংখ্যক এর শিকার হচ্ছেন। উচ্চতাপমাত্রা, বায়ুতে ওজোন এবং অন্যান্য দূষণের মাত্রা বাড়তে সাহায্য করছে। এই ধরনের দূষিত আবহাওয়া শহরাঞ্চলে অ্যাজমার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা যায় বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এর শিকার।
জলাবায়ুর পরিবর্তনে, গত অর্ধ-শতাব্দীতে আবহাওয়া সংক্রান্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকা প্রায় ৩ গুণ বেড়ে গিয়েছে। প্রচলিত চিকিৎসা ও পরিকাঠামো এক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকার হচ্ছে না। সমুদের পানিতল বৃদ্ধি ও আবহাওয়া সংক্রান্ত নানা দুর্যোগ বিশেষ করে ক্ষতি করছে তাদের, যারা সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলে বাস করেন। প্রসঙ্গত, পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সমুদ্র থেকে ৬০ কিমি-এর মধ্যে বসবাস করেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে এরা নিজেদের বাসস্থান থেকে দূরে সরতে বাধ্য হলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা ও সংক্রামক ব্যাধিসহ অজানা পরিবেশের শিকার হতে পারেন।
বৃষ্টিপাতে প্রকৃতি ক্রমাগত বদলে যাওয়ার কারণে আগামী দিনে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার সমস্যা তীব্রতর হতে পারে। পুুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা ইত্যাদি পানির অন্যতম উৎস বৃষ্টি। বৃষ্টি প্রধান উৎস ভৌম পানিরও যে পানি আমরা পান করি এবং কৃষিক্ষেত্রে সেচের কাজে ব্যবহার করি। সুতরাং বিশুদ্ধ পানির অভাব বা সমস্যা হলে মানুষ পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হবেন। বাড়বে ডায়রিয়ার ঝুঁকি, যে রোগে প্রত্যেক বছর প্রায় ২২ লাখ মানুষ মারা যান। আবার পানির অভাব তীব্র হলে খরা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। মনে করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন, ২০৯০ সালের মধ্যে, খরাপ্রাপ্ত এলাকাকে অনেক বাড়িয়ে দিবে। ঘন ঘন দেখা দিবে তীব্র খরা। প্রকৃতপক্ষে এর সম্ভাবনা প্রায় ২ গুণ বেড়ে যাবে আর খরার গড় সময়কাল বেড়ে যাবে প্রায় ৬ গুণ। অন্যদিকে, বন্যার সংখ্যা ও ভয়াবহতাও বাড়বে। এর ফলে যেমন পানি দূষিত হয়ে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণ বাড়বে, তেমনই বন্যা পরবর্তী জমা পানিতে মশা ও নানা কীটপতঙ্গের রমরমায় বাড়বে নানারকম রোগ। এ ছাড়া, বন্যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে একদিকে যেমন জীবন ও সম্পত্তিহানি ঘটবে, অন্যদিকে তেমন যাতায়াত ও চিকিৎসা পরিষেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সব থেকে বড় কথা হল, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন যথেষ্ট কমে যাবে। দৃষ্টান্তস্বরুপ, ২০২০ সালের মধ্যে আফ্রিকার অনেক পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমলে সার্বিকভাবে বাড়বে অপুষ্টি, যাতে এখন বছরে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ মারা যান।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। কারণ জলবায়ূ পরিবর্তনে প্রভাবিত হচ্ছে নানারকম কীটপতঙ্গ। শামুক জাতীয় প্রাণী ও বিভিন্ন শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর মাধ্যমে সাধারণভাবে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হয়। প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তিত জলবায়ু, সংক্রমণের আদর্শ সময়কালকে দীর্ঘায়িত করছে, বাড়ছে রোগাক্রমণের ভৌগোলিক সীমানায়। চীনে শামুকজাতীয় প্রাণীবাহিত সিস্টোসোমিয়াসিস রোগ অনেকটা অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবীতে অ্যানোফিনিস মশা-বাহিত ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রত্যেক বছর মারা যাচ্ছেন প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। এডিস মশা-বাহিত ডেঙ্গু দ্রুত ছড়াচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে, ২০২২ সালের মধ্যে আরও অতিরিক্ত ২ বিলিয়ন মানুষের ডেঙ্গু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি রোগের প্রকোপের সরাসরি সম্পর্ক লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেমন-অতিরিক্ত উষ্ণতা ও তাপমাত্রায় অনেক সময় কলেরার মত ব্যাকটেরিয়াজাত সংক্রমণ মহামারীর আকার নিতে পারে। একই ভাবে বেড়ে যেতে পারে অ্যানোফিসিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া। উষ্ণ ও শুষ্ক সময়কালে সাহারা সংলগ্ন আফ্রিকায় প্রকোপ বাড়া-কমার ক্ষেত্রেও উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাতের তারতম্যের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত স্পষ্ট। কিউলেক্স মশাবাহিত জাপানি এনসেফেলইটিসের বাড়-বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যায় বর্ষার আবহাওয়ায়, যখন বেশি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে তাপমাত্রা অন্তত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কার্য-কারণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত। একপক্ষ মনে করেন, মানুষের ক্রিয়া-কলাপের ফলেই এই অবাঞ্চিত পরিবর্তন। অন্যদল মনে করেন, পৃথিবীতে মানুষ আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ভূ-তাত্ত্বিক যুগে, প্রাকৃতিকভাবেই কখনো পৃথিবী উষ্ণ হয়েছে, কখনও শীতল। তবে কারণ যাই হোক না কেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্যতা এবং তার ফলস্বরূপ নানা ধরনের স্বাস্থ্য-সমস্যা ক্রমশ একটা চ্যালেঞ্জ হয়েই দেখা দিচ্ছে।
পৃথীবীজুড়ে শুরু হয়েছে আবহাওয়া এবং পরিবেশগত ব্যাপক পরিবর্তন। বলাই বাহুল্য, এসব পরিবর্তন আমাদের জন্য কোনো শুভ বার্তা বয়ে আনছে না। অর্থাৎ এসব হচ্ছে নেগেটিভ বা নেতিবাচক পরিবর্তন। বিশ্ব আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৮টি দেশের উপকূলীয় এলাকায় বিরূপ পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী ইতোমধ্যেই করা হয়েছে। ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি এক গবেষণার পর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, বিশ্ব্যব্যাপী বায়মন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এতে এসব অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লাখ লাখ লোক ‘পরিবেশগত উদ্বাস্তুতে’ পরিণত হবে। তারা অবশ্য এ কথাও বলে আশ্বস্ত করেছেন উন্নত পরিবেশ, দূষণরোধ প্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি লাঘব হতে পারে।
ওয়াশিংটন আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ২৭ মাসব্যাপী ৬০ জন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ এবং ৮টি এশীয় দেশের সরকার এ জরিপ কাজে অংশগ্রহণ করেন। ওয়াশিংটন আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের জরিপে বলা হয়েছে, উপকূলের ব্যাপক এলাকা সাগরের স্ফীত পানিতে নিমজ্জিত হবে এবং ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হবে। মিষ্টি পানির প্রবাহে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে। উপকূলীয় ব্যাপক এলাকায় মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপও বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলীয় ৮টি দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বসবাস করে। বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে- পূর্ব এশিয়ার এই দেশগুলো।
‘গ্রীন হাউজ এফেক্ট’ এর জন্য বন উজাড়কেই প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হয়। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশকে সুন্দর-সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অত্যাবশ্যক। সেখানে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারী হিসাব মতে শতকরা ৯ ভাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বনভূমির পরিমাণ ৬ ভাগের বেশি হবে না বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। দেশে বনভূমির এই অস্বাভাবিক হ্রাসের কারণে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত ‘বাংলাদেশে গ্রীণ হাউসের প্রভাব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এখন জলবায়ু ঠান্ডা হবার কোন প্রবণতা নেই বলে গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে আগামী ২০৩১ সাল নাগাদ দেশে বর্তমানের তুলনায় তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ জিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সার নাগাদ ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা কর হচ্ছে। উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গে বর্ষা ঋতুও দীর্ঘায়িত হতে পারে। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ, নিউজিল্যান্ডস্থ ওয়াইক্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড রিসার্চ স্টাডিজ এবং গ্রেট ব্রিটেনস্থ ইস্ট অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেটিভ রিসার্চ ইউনিট কর্তৃক প্রণীত এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ৭ খণ্ডের গবেষণা গ্রন্থ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এই গবেষণায় আরো জানা যায়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা পানি বিভাজন এলাকাতে ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাতের বৃদ্ধিতে সে দেশে বন্যার ভয়াবহতা বাড়বে। অন্যদিকে, বর্ধিত বৃষ্টিপাত নদীর প্রবাহ বাড়িয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশকে প্রশমিত করতে সাহায্য করতে পারে বলে এই গ্রন্থে বলা হয়েছে। তবে এ গ্রন্থে যে তথ্যটি সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তা হলো, তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বা গরান কাঠের বনভূমি সুন্দরবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদের দেশে সুন্দরবন যেন মরুভূমির মধ্যে শ্যামল মরুদ্যান। দেশের অন্যতম প্রধান এই বনভূমি এখন ধ্বংস এবং বিপর্যয়ের মুখে। সুন্দরবন বাংলাদেশের সমগ্র বনভূমির প্রায় ১৭.৭৩ শতাংশ। মানুষের লোভ আর হস্তক্ষেপের ফলে সুন্দরবন তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। দেশ হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ফারাক্কা বাঁধের মরণ ছোবল আমাদের দেশকে শুধু পানি শূন্যই বা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রায় মরুভূমিতে পরিণতই করেনি, আমাদের দেশের সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। ফারাক্কার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি সুন্দরবন অঞ্চলেও, যেমন ফারক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ার ফলে পদ্মা নদীর পানির সরবরাহ ও নাব্যতা কমে যায়। ফলে সুন্দরবনে প্রবাহিত শাখা নদীগুলোর মধ্য দিয়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি অভ্যন্তরভাগে অধিক দূর পর্যন্ত প্রবেশ করে। এর ফলে সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান বৃক্ষ কম লবণাক্ততায় টিকে থাকার উপযোগী উদ্ভিদ সুন্দরী গাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সুন্দরী বৃক্ষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গাছপালা, পশু পাখি, জীবজন্তু ও মাছের মারাত্মক ক্ষতির আশংকা দেখা দিয়েছে।
নানা কারণেই আজ সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বনভূমি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আমরাও দিন দিন গ্রীন হাউস এফেক্টের নির্মম শিকারে পরিণত হতে চলেছি। দেশের বনাঞ্চলগুলোর সম্পদের অধিক ও অনিয়ন্ত্রিত আহরণ আজ আমাদের পরিবেশ ও প্রতিরোধের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষই পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। যেখানে মানুষের উচিত নিজেদের কলুষমুক্ত পরিচ্ছন্ন পবিত্র রাখার জন্য যথাসম্ভব পরিবেশকে রক্ষা করা, তখন এই মানুষের কারসাজিতেই বনভূমি উজাড় হচ্ছে, যেখানে সেখানে ইটের ভাটা গড়ে উঠছে, বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, পশুপাখি নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, অপরিকল্পিত শহর গড়ার কারণে প্রকৃতির সবুজ শ্যামলিমাকে বিপন্ন করা হচ্ছে। এদিকে উপচেপড়া জনসংখ্যার কারণে দেশে গড় ভূমি বণ্টনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে নদী সিকস্তি পরিাবারের সংখ্যা বাড়ছে।
এসব ভূমিহীন, বেকার সর্বহারা লোকজন গ্রামের অবারিত সবুজ প্রান্তর ছেড়ে জঠর জ্বালা নিবারণের জন্য শহরে ছুটে আসছে। কোন রকমে একটা কাজ জুটিয়ে বস্তির অপরিসর নোংরা ঘিনঘিনে পরিবেশে ঠাঁই নিচ্ছে। এতে শহরের পরিবেশ যেমন ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে তেমনি এ রকম অস্বাস্থ্যকর দূষিত পরিবেশে থেকে বস্তির মানুষগুলোও দিনে দিনে জীর্ণ-শীর্ণ-রোগাগ্রস্ত হচ্ছে। রাজধানীর মোট ১ কোটি ৭০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৩০ শতাংশই বস্তিবাসী।
জনসংখ্যা, ভূমির স্বল্পতা ও সম্পদের অপ্রতুলতা ফারাক্কা এবং তিস্তাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীর কারণে আমাদের দারিদ্র্য যেমন দূরীভূত হচ্ছেনা, তেমনি আমাদের পরিবেশও নানা ধরনের ভারসাম্যহীনতার শিকার হচ্ছে। সুষম এবং পরিমিত জনসংখ্যার গুরত্ব দেশবাসীকে বোঝাবার দায়িত্ব দেশের শিক্ষিত এবং সচেতন নাগরিকের ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে সচেতন নাগরিকরা যদি নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যান তাহলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে যে ব্যাপক ধ্বংস নেমে আসবে সে ক্ষতির ভার সবাইকে বইতে হবে- যা হবে কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
সাংবাদিক-কলামিস্ট