বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বব্যাপী যে দিনটাকে সবচেয়ে বেশি মানুষ উদযাপন করে সেটি হচ্ছে বড়দিন। যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন। ফিলিস্তিনের বেথেলহেমে এই দিনে এক জরাজীর্ণ গোয়ালঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এক মহামানব যার নাম যীশুখ্রিষ্ট। তখন থেকেই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিকে বড়দিন হিসেবে পালন করে আসছে। দেড়হাজার বছরের অধিককাল ধরে পালিত হয়ে আসছে বড়দিন। ব্যাপক আড়ম্বরের মাধ্যমে দেশে দেশে এই দিনটি পালিত হয়। সান্তা ক্লজের আবির্ভাব, ক্রিসমাস ট্রি, আলোকসজ্জা, উপহার, কেক, ঘোরাঘুরি, মজার খাবার, গীর্জায় প্রার্থনা এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কাটানো হয় দিনটি পরম আনন্দে। এটা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ‘বড়দিন’ শব্দটি সম্ভবত প্রথম ব্যবহার করেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কারণ কবি ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত ‘বড়দিন’কে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছেন। ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘যদিও আমরা হই হিন্দুর সন্তান। বড়দিনে সুখি তবু, খ্রিষ্টান সমান।’ আরেকটি ‘বড়দিন’ কবিতায় তিনি ইংরেজ সাহেব সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন, ‘খ্রিষ্টের জন্মদিন, বড়দিন, বড়দিন নাম। বহু সুখে পরিপূর্ণ, কলিকাতা ধাম।’ ‘কেরানী, দেওয়ান আদি, বড়বড় নেট। সাহেবের ঘরে ঘরে, পাঠাতেছে ভেট।’ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘বড়দিন’ কবিতায় যীশু খ্রিষ্ট ও কৃষ্ণকে তুলনা করে এক চমৎকার উপমা বেঁধেছেন, ‘কেথলিক, দল সব, প্রেমানন্দে দোলে। শিশু ঈশু গড়ে দেয়, মেরিমার কোলে, বিশ্বমাঝে চারু রূপ, দৃশ্য মনোলোভা যশোদার কোলে যথা, গোপালের শোভা, এখানে মেরি ও যীশুর সঙ্গে যশোদা ও কৃষ্ণের তুলনা করেছেন। যে যীশু নাজারেথের যীশু, বিদেশি ইংরেজদের যীশু, সেই যীশু ও মেরী, বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষি মানুষের আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখনীর মাধ্যমে যীশু খ্রিষ্টের নাম ও বড়দিনের বিষয়ে তুলে ধরেছেন। তার বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থের ‘সত্য-মন্ত্র’ কবিতায়, খ্রিষ্ট নাম উচ্চারিত হয়েছে এভাবে ... ‘চিনেছিলেন খ্রিষ্ট বুদ্ধ, কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও রাম, মানুষ কী আর কী তার দাম।’ তিনি প্রলয়-শিখা কাব্যের নমস্কার কবিতায় লিখেছেন, ‘তব কলভাষে খল খল হাসে বোবা ধরণীর শিশু, ওগো পবিত্রা, কূলে কূলে তব কোলে দোলে নব যিশু।’ চন্দ্রবিন্দু কাব্যগ্রন্থের ‘ভারতকে যাহা দেখাইলেন’ সেই কবিতায় তিনি লিখেছেন ...‘যীশু খ্রিষ্টের নাই সে ইচ্ছা/ কি করিব বল আমরা! / চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি/ ভারতে বিলিতি আমড়া।’ ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় তিনি অসাম্যের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন, / ‘বড়লোকদের ‘বড়দিন’ গেল, আমাদের দিন ছোটো, /আমাদের রাত কাটিতে চায় না, খিদে বলে নিবে ওঠো। পচে মরে হায় মানুষ, হায়রে পঁচিশে ডিসেম্বর। /কত সম্মান দিতেছে প্রেমিত খ্রিষ্টে ধরার নর। / ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষ শিশু?/ আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছে যিশু!’ তার বিখ্যাত কবিতা ‘দারিদ্র্য’-এর মধ্যে দারিদ্র্যের জয়গান করতে গিয়ে তিনি যীশু খ্রিষ্টের উপমা তুলে ধরেছেন...
‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান/ তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান/ কণ্টক মুকুট শোভা।’ নজরুল তার ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় মা মেরীর মাতৃত্বের জয়গান গেয়েছেন। তিনি এখানে মা অহল্যা ও মা মেরীর উপমা তুলে ধরেছেন... ‘মুনি হলো শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা শিশু, / বিস্ময়কর জন্ম যাহার-মহাপ্রেমিক যিশু! / অহল্যা যদি মুক্তি লভে না, মেরী হতে পারে দেবী, / তোমরাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি?’/
ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় স্বার্থহীন ভালোবাসার কথা বলেছেন... ‘তাই তোমার জন্মদিনের নাম দিয়েছি আমরা বড়দিন, /স্মরণে যার হয় বড় প্রাণ, হয় মহীয়ান চিত্ত স্বার্থহীন। / আমরা তোমায় ভালোবাসি, ভক্তি করি আমরা অখ্রিষ্টান, /
তোমার সঙ্গে যোগ যে আছে এই এশিয়ার, আছে নাড়ির টান।’ কবি জীবনানন্দ দাশের ‘আজ’ কবিতায় বড়দিনের ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাই। তিনি বলেছেন... ‘আর ওই দেবতার ছেলে এক ক্রুশ তার বুকে, / সে শুধু জেনেছে ব্যাথা, ক্রুশে শুধু যেই ব্যাথা আছে! / ...এ হৃদয়ে নাই কোনো ক্রুশ কাঠ ধরিবার সখ, / পাপের হাতের থেকে চাই নাকো কোনো পরিত্রাণ! / শীতল করিতে পার, ক্রশ, তুমি আমার উত্তাপ, /নির্মল করিতে পার, ন্যাজারিন, এই আবিলতা?’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় বড়দিনের অনেক চিত্র দেখতে পাই। তার পুনশ্চ কাব্যের ‘শিশু তীর্থ’ কবিতায় শিশু যীশুর চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তার শিশু, উষার কোলে যেন শুকতারা। ...উচ্চস্বরে ঘোষণা করলেন জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।’ তিনি পুনশ্চ কাব্যের ‘মানবপুত্র’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মৃত্যুর পাত্রে খ্রিস্ট যেদিন মৃত্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন রবাহূত অনাহূতের জন্যে, তারপরে কেটে গেছে বহু শত বছর। আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত্যধাম থেকে মর্তধামে। চেয়ে দেখলেন, সেকালেও মানুষ ক্ষতবিক্ষত হত যে-সমস্ত পাপের মারে...।’ রবীন্দ্রনাথ ‘খ্রিষ্ট’ প্রবন্ধগ্রন্থের ‘ যীশু চরিত’ ‘মানবসম্বন্ধের দেবতা’ ‘খ্রিষ্টধর্ম’ ‘খ্রিষ্টোৎসব’ ‘বড়োদিন’ ও ‘খ্রিষ্ট’ প্রবন্ধগুলোর মধ্যে যীশু খ্রিষ্টের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ‘ যীশু চরিত’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি আপনাকে বলিয়াছেন মানষের পুত্র। মানবসন্তান যে কে তাহাই তিনি প্রকাশ করিতে আসিয়াছেন। তাই তিনি দেখাইয়াছেন, মানুষের মনুষত্ব সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য্যরেও নহে, আচারের অনুষ্ঠানেও নহে; কিন্তু মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ আছে এই সত্যেই সে সত্য। মানব সমাজে দাঁড়াইয়া ঈশ্বরকে তিনি পিতা বলিয়াছেন। ... তাই ঈশ্বরের পুত্ররূপে মানুষ সকলের চেয়ে বড়ো, সাম্রাজ্যের রাজারূপে নহে।’ তিনি লিখেছেন, ‘মানুষকে এই মানবপুত্র বড়ো দেখিয়াছেন বলিয়াই মানুষকে যন্ত্ররূপে দেখিতে চান নাই।’ অপরদিকে ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘যিনি বড়ো তিনি যে প্রেমিক। বড়দিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘বড়োদিন’ নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আজ তার জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে? অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কালগণনায়? সেদিন সত্যের নাম তাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়োদিন যে তারিখেই আসুক। ...সেদিন বড়োদিন নিজেকে পরীক্ষা করার দিন, নিজেকে নম্র করার দিন।’ তিনি ‘খ্রিষ্টোৎসব’ প্রবন্ধ শুরু করেছেন তার ‘গীতাঞ্জলি’র একটি কবিতা বা একটি গান দিয়ে, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার’ পর, তুমি তাই এসেছ নিচে। আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন ‘বড়দিন’ নিয়েই শুধু রচনা করেননি। তিনি যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন ‘বড়দিন’ দেশে বিদেশে যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই পালন করেছেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম তিনি বড়দিন উৎসব পালনের আয়োজন করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি ২৫ ডিসেম্বর ‘বড়দিন’ পালিত হয়ে আসছে। ২৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের মন্দিরে যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন পালন করা হয়। ধ্বনিত হয় যীশু খ্রিষ্টের প্রার্থনা সঙ্গীত, নাম জপ ও বাইবেল পাঠ। ধ্যান প্রার্থনার পর সবাই জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে ছাতিমতলায় সম্মিলিত হয়। কবি জীবনান্দ দাশের ‘আজ’ কবিতায় বড়দিনের ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাই। ‘আর ওই দেবতার ছেলে এক ক্রুশ তার বুকে, সে শুধু জেনেছে ব্যথা, ক্রুশে শুধু যেই ব্যথা আছে! ...এ হৃদয়ে নাই কোনো ক্রুশ কাঠ ধরিবার সখ, পাপের হাতের থেকে চাই নাকো কোনো পরিত্রাণ! শীতল করিতে পার, ক্রুশ, তুমি আমার উত্তাপ, নির্মল করিতে পার, ন্যাজারিন, এই আবিলতা?’
কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের লেখনীতেও বড়দিনের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি ‘মৃত্যুর নীলপদ্ম’ গল্প গ্রন্থের ‘নাজারেথ’ গল্পে যীশুর জন্মকথা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আনন্দ করো নাজারেথবাসী আজ সেই অমর পুত্রের জন্মদিন। আনন্দ করো নাজারেথবাসী তোমরা যোসেফ ও মেরীকে এই পাহাড়ি শহরে এক সময় দেখেছিলে।’ ২৫ ডিসেম্বর দিনটি শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবধারায় বিশ্বাসী মানুষজনের কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
ঠাকুরের দেহত্যাগের পর স্বামী বিবেকানন্দসহ তার বারোজন শিষ্য আঁটপুরে এসেছিলেন। ধুনি জ্বালিয়ে তারা নিজেরাই সন্ন্যাস নিয়েছিলেন বড়দিনের আগের রাতে। স্বামী বিবেকানন্দ খ্রিষ্টধর্মের পাপ ও নরকের তত্ত্ব মানতে পারতেন না- এসব আসলে মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য পাদ্রিদের সৃষ্টি। কিন্তু ঈশ্বরপ্রেরিত, করুণা ও ত্যাগের প্রতিমূর্তি রূপে খ্রিষ্টের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধার কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন বক্তৃতায়... বলেছেন, যীশুর সমকালে তিনি উপস্থিত থাকলে চোখের জল দিয়ে নয়, বুকের রক্ত দিয়ে তার পা ধুইয়ে দিতেন।
লেখক :কবি ও প্রাবন্ধিক