চলতি বছর এ পর্যন্ত হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এক লাখ ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম নয়। প্রতি মাসেই মৃত্যুহার বাড়ছে এবং চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ৫৬১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হলেও এবার শীত মৌসুমেও প্রায় সমান্তরালেই প্রকোপ বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে, ষড়ঋতুর এদেশে এখন বছরব্যাপী ডেঙ্গু আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বলেছেন, ফেব্রুয়ারি নাগাদ হয়তো ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমে আসতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গুর ভয়াবহতার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি সরকারের দায়সারা পদক্ষেপ, এডিস মশার প্রজনন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘাটতি, পর্যাপ্ত গবেষণা না করা ও জনসচেতনতার অভাবই এত মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা ইতঃপূর্বে বলেছি, ডেঙ্গু দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণগুলো খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। মশাবাহিত এই রোগের প্রথমত জরুরি প্রতিকার হলো, মশার বংশবিস্তারের উৎসস্থল ধ্বংস করা এবং এর পাশাপাশি মশক নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মহলগুলোর তরফে যে চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে সংগতই প্রশ্ন জাগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তারা কি যথাযথ তৎপর? এই প্রশ্নের উত্তর যে প্রীতিকর নয় বিদ্যমান বাস্তবতা এও বলে। আমরা জানি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণযোগ্য ব্যাধি। এ ক্ষেত্রে প্রথমত জরুরি জনসচেতনতা, দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের যূথবদ্ধ প্রয়াস। একজন ব্যক্তির যেমন তার আশাপাশে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার সুযোগ রয়েছে তেমনি সামাজিক উদ্যোগে বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় বহুমুখী উদ্যোগ নেয়ারও অবকাশ রয়েছে। পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল ও সিটি কর্পোরেশনের যূথবদ্ধভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে এও আমরা সম্পাদকীয় স্তম্ভেই বলেছিলাম। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই দায়সারা ভাব পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় কার তা চিহ্নিত করে প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করা উচিত।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা এবং ব্যবস্থাপনা দুই-ই জরুরি। ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে সেই প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু মোকাবিলায় যূথবদ্ধ কার্যক্রম চালানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত সরকারকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রমে মনোযোগ বেশি রাখতে হচ্ছে বিধায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সেভাবে মনোনিবেশ করা সম্ভব হচ্ছে না- এমন অভিযোগ কোনো কোনো মহল থেকে উঠেছে। আমরা মনে করি, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি যা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি মহলকে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের পাশাপাশি মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করতেই হবে। মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন কোনোভাবেই জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে না আনতে পারে সেজন্য সবাইকে অধিকতর সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। বাসাবাড়িসহ পরিপার্শ্ব পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা যাতে বংশবিস্তার করতে না পারে, সে ব্যাপারে স্ব-স্ব ক্ষেত্র থেকেই জোরদার ভূমিকা পালন করা বাঞ্ছনীয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো স্বীকৃত টিকা এখন পর্যন্ত না থাকলেও সতর্ক থাকলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা কঠিন কিছু নয়। তাই আতঙ্ক নয় বরং প্রয়োজন সচেতনতা। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আগেও ছিল, এখনো আছে। আমরা চাই, প্রাণঘাতী এই মশা নিয়ন্ত্রণে সংহত পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন। সরকারি পর্যায় থেকে শুরু করে বেসরকারি পর্যায়ের সব স্তরে অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমের ভিত্তিতে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রয়াস জোরদার করতেই হবে। আমরা আরো মনে করি, জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় সমন্বয়হীনতা ঘোচানো জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক দায়ের পাশাপাশি ব্যক্তি কিংবা নাগরিক সমাজে সচেতনতা বাড়াতেও জোর দিতে হবে। ডেঙ্গু যেমন একদিকে প্রাণহানি ঘটাচ্ছে অন্যদিকে বাড়াচ্ছে আর্থিক ক্ষতি এবং এর পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক সংকটও প্রকট হচ্ছে। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা একটি বিজ্ঞানভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা কিছু করণীয় তা নিশ্চিত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।