আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রমণ্ড ভারতের নচিকেতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে এই গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বহু মানুষ এই গান শুনে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন। হৃদয় ছোঁয়া এই গান শুনে এবং গেয়ে কেউ কেউ নিজেদের সান্ত¡না দেবার চেষ্টা করে। জনপ্রিয় এই গানের শ্রোতাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। খোকার বাবার আমলের আসবাবপত্র, ঘড়ি, ছড়ি সারাজীবন সংরক্ষণ করতে হবে? খোকার লালন-পালন সবাই কি একইভাবে করে না? খোকার সাথেই থাকতে হবে কেন? একশ’ বছর বেঁচে থেকে খোকাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাবার মানসিকতা কতখানি গ্রহণযোগ্য? নিজকে কম দামি ভাবতে হবে কেন?
বৃদ্ধাশ্রম কি জেলখানা? খোকার পদ পদবিকে ‘মস্ত অফিসার’ বলে ব্যঙ্গ করা কতটুকু শোভন হয়েছে?
উপরের এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রথমত আসবাবপত্র, বাসাবাড়ি, থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল প্রতিনিয়ত নানা কারণে পরিবর্তন করতে হয়। কোনো ব্যক্তির আয় রোজগার কম থাকার সময় কিংবা জীবনের শুরুতে ছোট ফ্ল্যাটে বা ঘরে বসবাস করতে হয়েছে। এখন সামর্থ্য হয়েছে বড় ফ্ল্যাটে থাকে অথবা আলীশান বাড়িতে থাকার সুযোগ হয়েছে। মানুষ তো এই সুযোগ করবে। পুরাতন আসবাবপত্র নিয়ে উঠতে হবে কেন? নতুন ফার্নিচার, পর্দা, সোফা, ডাইনিং টেবিল, হাঁড়ি-পাতিল, চুলা, ওভেন, ফ্রিজ, গীজার কিনতে হবে না? পুরোনো আসবাবপত্রের উপর জীবন চালিয়ে দিতে হবে? নাতি নাতনিরাও এসব স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকবে? স্মৃতি সংরক্ষণ করতে থাকলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। সব পরিবারে নানা রকমের স্মৃতি থাকে সেসব সংরক্ষণ করতে শুরু করলে সারা দেশকে যাদুঘর বানিয়ে ফেলতে হবে। মানুষকে বেশি অতীত মুখী করে কি অর্জন হবে? মানুষকে কি অতীতে বসবাস করতে হবে? সন্তান লালন-পালনের আকুলতা প্রকৃতি প্রদত্ত সহজাত প্রবৃত্তি। প্রাণী জগতে সকল প্রাণী অনেক কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাচ্চা পালন করে।
বাচ্চা পালনে মায়ের বড় ধরনের ভূমিকা থাকে। এই ভূমিকা পালনের জন্য কোনো প্রাণীই সন্তানের কাছে কোনো কিছু প্রত্যাশা করে না।
মা জীবন বাজী রেখে সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। মা নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে সন্তান রক্ষা করে। সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্ক শর্তহীন। দেশে হাজার হাজার শিশুকে বোর্ডিং স্কুল, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে পাঠানো হয়। বহু শিশু ডে-কেয়ার সেন্টারে দিনের প্রায় পুরো সময় ধরে থাকে কিংবা বাসায় গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে থাকে। মায়ের অভাব নিয়ে বড় হওয়া শিশুদের মনোবেদনা নিয়ে তো কোনো গান হয় না!
কখনো কখনো সন্তান ফেলে মা চলে যায়। অনেক কর্মজীবী মা সন্তানকে নানি কিংবা দাদির কাছে রেখে আসে। বাবা-মা দুজন কর্মজীবী হলে সন্তান বাবার কাছে থাকার ঘটনা চোখে পড়ে। এসব সন্তান মায়ের অভাব নিয়ে অনাদরে অবহেলায় বড় হয়। নচিকেতার গানটি বিদ্বেষমূলক যা গ্রহণ করা ন্যায়সঙ্গত নয়।
গানের মা কতটা প্রতিহিংসা পরায়ন হলে একশ’ বছর বাঁচতে চেয়েছেন শুধুমাত্র ছেলেকে একই বৃদ্ধাশ্রমে পাবার আশায়। নিজের জীবনের বিনিময়ে মা সন্তানকে রক্ষা করে আর গানের মা নিজের প্রাপ্ত কস্ট সন্তানকে ভোগ করতে দিতে চান। এ যেনো চোখের বদলে চোখ তোলার দাবি।
খোকার মা নিজেকে সবচেয়ে কম দামি বলে অভিহিত করেছেন। মা নিজেকে এতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে না ভাবলেও চলতো। সংসারে কার কত দাম তার মূল্য তালিকা টানানো থাকে না। জীবনের শেষ দিনগুলোতে সন্তানের সাথে থাকা, সেবাযত্ন পাওয়া গেলে জীবন অনেক মূল্যবান কিংবা দামি হবে এটা ভাবার কোনো মানে হয় না। বহু মানুষের ছেলে-মেয়ে বিদেশে চাকরি করে কিংবা পড়তে যায়। চাকরি ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে মানুষের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন হয়ে যায় ফলে সাধ থাকলে ও সাধ্য থাকে না বাবা মাকে নিজের সাথে রাখতে। আবার যাঁরা আদরের খোকার সাথে থাকেন তারা আনন্দে আহ্লাদে আছেন তাও শোনা যায় না। জীবনের লক্ষ্য শুধু সন্তানের সাথে থাকতে পারা নয়। লক্ষ্য হবে শান্তিপূর্ণ স্বস্তিদায়ক জীবন। একা একা এরকম জীবন পাওয়া দুষ্কর। সবাইকে যুক্ত করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি নিহিত আছে।
মানুষ জীবনযাপনে আত্মকেন্দ্রিক আর সেবা পাবার ক্ষেত্রে সামাজিক। বড়ই বিচিত্র মনোভাব!
বৃদ্ধাশ্রমকে জেলখানা হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবার বিলুপ্ত হবার পথে। একক পরিবার নানা কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। স্বামী-স্ত্রীর কর্মস্থল পর্যন্ত আলাদা হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েকে বোর্ডিং স্কুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। সন্তান লালন-পালন কে করবে এসব দুঃশ্চিন্তায় দম্পতিরা সন্তান নিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে।
মানসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণরা বরং ভালো থাকেন। আমাদের তরুণ তরুণীরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সংকটের কবলে পড়ে দিশাহারা। অনেক সময় তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ফলে তৈরি হয় হতাশা, আসে সংকট, জাগে উৎকণ্ঠা। আজকের তরুণদের ক্যারিয়ার, উচ্চশিক্ষা, প্রতিষ্ঠা লাভ, উদ্যোক্তা হবার জন্য নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই সময়ে তাদেরকে নচিকেতার গান ইমোশনাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। মনে রাখতে হবে, সন্তান বাবা মার মাধ্যমে পৃথিবীতে আসলেও সে সমাজের সম্পদ। মানুষ সামাজিক জীব তাই বার্ধক্য মোকাবিলা সমাজকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
খোকার মা খোকাকে ‘মস্ত অফিসার’ বলে ব্যঙ্গ করাটা অশোভন হয়েছে। সব বাবা-মা সন্তানকে ভালো মানুষ হবার চাইতে বড় অফিসার হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। বড় অফিসারের বড় ক্ষমতা, দাপট, আয় রোজগার, গাড়ি বাড়ি দেখে নিজের সন্তানকে সেই জায়গায় নেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। নানা কারণে আমাদের দেশের বড় অফিসারদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়ে আছে। নচিকেতার গান বড় অফিসারদের প্রতি বিরক্তি বাড়াতে সহায়তা করবে। আমি একজন মাকে জানি যার দশটি সন্তান রয়েছে। তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মা নিজ বাড়িতে স্বেচ্ছায় একা থাকেন। তাকে আমি আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, আমার একটা সন্তান মুর্খ থাকলে এখন আমার সাথে থাকতো। আমাদের প্রবীণদের মধ্যে মেনে নেয়া, মানিয়ে চলার, নতুন পরিস্থিতিকে সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা কতখানি তা চিন্তা করার সময় এখনই। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে নচিকেতার এই একটি গান আমাদের চিন্তা ভাবনায় সন্তানের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করতে সহায়তা করছে।
সকল নেতিবাচক বিষয়ের একটি ইতিবাচক দিক থাকে। এই গানটির ইতিবাচক দিক হলো, ছেলে মস্ত অফিসার হলে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়। ফলে মানুষ আগে থাকতেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকবেন।
ছেলের উপর ভরসা করা বোকামি এটা মনের মধ্যে গেঁথে থাকবে। সন্তান নির্ভর প্রবীণ জীবন ঝুঁকি পূর্ণ হবে বিধায় সমাজ নির্ভর প্রবীণ জীবনের প্রস্তুতি শুরু করবে। মানুষ শুধু সন্তান লালন পালন করে না, সমাজকে নানা ভাবে পালন করে, সেবা দেয়, কর-ভ্যাট দেয়। ফলে বার্ধক্যের দায় শুধু সন্তানের নয় সমাজ এবং রাষ্ট্রের।
তাই প্রবীণদের নানা ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে বার্ধক্যকে স্বস্তি দায়ক এবং শান্তি পূর্ণ করতে হবে। প্রবীণরাই তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসবে। নচিকেতার গান গেয়ে, শুনে সমস্যার সমাধান হবে কি না তাতে অনেক সন্দেহ আছে।
লেখক : কলামিস্ট