সেই ছোটবেলায় ‘আদর্শলিপি’ দিয়ে আমাদের আধুনিক শিক্ষার পাঠদান শুরু। সকালে উঠিয়া মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি, সদা সত্য কথা বলিব, এমনি অনেক নীতিবাক্য ছিল। সময়ের বিবর্তনে ওসব এখন কেউ পড়ে বা পড়ানো হয় বলে মনে হয় না। শিক্ষার উন্নয়নের নামে প্রতিবছর কারিকুলাম পরিবর্তনের নামে হাসিনা সরকার শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে ধংস করে গেছে। শিক্ষাদান এখন শিক্ষাঙ্গন থেকে কোচিং সেন্টার নির্ভর হয়ে পড়েছে। ছাত্রদের শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, শিক্ষকের তার ছাত্রদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা নেই। পরামর্শ নিতে এখন আর প্রয়োজন হয় না- মা-বাবা বড় ভাই-বোন কিংবা আত্মীয়স্বজন। প্রয়োজনে আছে ভুরিভুরি ফেসবুক বন্ধু। জীবন গড়তে হবে কীভাবে তার জন্য প্রয়োজন নেই পিতা-মাতা আপনজন, গুরুজন। চারিদিকে আছে আজকাল প্রেরণামূলক বক্তৃতা এবং তার বক্তারাও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশের কয়েকজনের প্রেরণামূলক বক্তৃতা শোনার এবং দেখার পরে, আমার কাছে ভালো লাগেনি এবং এ ব্যাপারে শোনার বা দেখার প্রতি এখন আর কোনো আগ্রহ বোধও করি না। আমার দেখা বেশিরভাগ স্পিকার তারা কোথাও না কোথাও চাকরি করেন অর্থাৎ কি না কর্মচারী। তারা যে কোনোভাবেই হোক জীবনে সাফল্যের একটা কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছেছেন। সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, বিলাসবহুল গাড়ির মালিক হয়েছেন এবং হতে পারেন স্বাস্থ্যকর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মালিক। কিন্তু তারা চাকরি তৈরি করেন না বা তাদের নিজস্ব কোনো প্রতিষ্ঠান নাই,যে প্রতিষ্ঠানে তিনি মালিক হিসেবে কাউকে কাজ দিতে পারেন। তাদের কাছে এমন কোনো বাস্তব পণ্য নেই, যা দিয়ে তারা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারেন। তাদের কাছে আছে কেবলই তাদের ঠোঁট পরিষেবা (লিপ সার্ভিস) এবং আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন দেখার গল্প। আমার কাছে মনে হয়েছে তাদের এই আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখার গল্প মানুষের মাঝে অতিমাত্রায় ঈর্ষা জাগাতে এবং অর্থ উপার্জন করতে বেশ প্রলুব্ধ করে। কীভাবে এবং কত দ্রুত ক্যারিয়ারের সিঁড়িতে আরোহণের কৌশল রপ্ত এবং কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য পাগল প্রায় করে ফেলে। এই ঈর্ষাতে হারিয়ে যায় মানবিকতা, শালীনতা এবং সহমর্মিতাবোধ।
বক্তারা তাদের পরামর্শকে শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্পের উপর ভিত্তি করে প্রচার করতে পারেন। তারা ভালো উদাহরণ দিতে, বলতে পারেন- তাদের নিজেদের ভালো পদ পদবি এবং ভালো উপার্জন এবং ভালো প্রতিষ্ঠানের কথা। তারা যদি আগামীকাল নতুন একটি ভালো সুযোগ পেয়ে যান, সন্দেহ নেই, কোনো দ্বিধা ছাড়াই তারা তাদের প্রশংসা করা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করবেন। আজ, তারা যে ব্র্যান্ডের প্রচার একেবারে ঠোঁট থেকে কান অবধি লম্বা হাসি দিয়ে প্রচার করেছিলেন আগামীকাল একইভাবে তারা অধিক সুবিধা পেয়ে অন্য প্রতিষ্ঠান এবং সেই প্রতিষ্ঠানের ব্রান্ডের প্রচারণায় গলদঘর্ম হবেন। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের দেশের মতো অনুন্নত দেশের রাজনৈতিক কিছু নেতাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য আনুগত্য পরিবর্তন করার সাথে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ওই সমস্ত ব্যক্তির চ্যালেঞ্জিং গল্প শুনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, যিনি তার যৌবনে অক্লান্ত কঠোর পরিশ্রম এবং রক্ত-ঘামের বিনিময়ে নিজেকে সাফল্যের চূড়ায় পৌছেছেন। একসময় যিনি কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র একজন সাধারণ কর্মচারী ছিলেন, তিনি তার নিষ্ঠা-সততা কর্মদক্ষতায় দিয়ে এখন একটা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন এবং অন্যদের কর্মসংস্থান করার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এই ধরনের একজন ব্যক্তির বক্তৃতা তার জীবনের গল্প যে কাউকে নৈতিকতার আন্তরিকতার, মর্যাদাপূর্ণ সৎ মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে তা নিশ্চিত। বিপরীতে, কর্মচারী-বক্তাদের এই গভীরতার অভাব রয়েছে। তারা শেখায় না কীভাবে একজন ব্যক্তি প্রকৃত মানুষ হতে পারবেন, কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে সততা এবং সম্মানজনক আচরণ করতে পারবেন, বা পদণ্ডমর্যাদা নির্বিশেষে সহকর্মীদের সাথে কীভাবে সম্মানের সঙ্গে আচরণ করতে পারবেন। তাদের বক্তৃতা গুলি কীভাবে উচ্চতর নৈতিকতা গড়ে তুলতে হয় বা একটি সুগঠিত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হওয়া যায় তা বোঝাতে পারে না। তারা পারিবারিক-সামাজিক এবং জাতীয় সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় বা করতে হবে, সে ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে পারেন না। পারেন না পরিবার সমাজে একে অপরের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করতে বা দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য নির্দেশিকা প্রদান করতে।
এইভাবে, অনুপ্রেরণামূলক বক্তার অনুগামীরা সবসময় নিজেদের নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন নিজেদের সব জায়গায় প্রদর্শন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন আশপাশে সামনে পেছনে কারো দিকে তাকানোর তারা প্রয়োজন অনুভব করেন না। সব সময় তাদের আচার-আচরণে বাচন ভঙ্গীতে মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো মনে হয়। সেখানে আন্তরিকতার লেশমাত্র নেই। এরা কর্মক্ষেত্রে তার পাশের সহকর্মীদের দিকে তাকানোর সময় পান না, তাদের বিপদের সময় তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন না। তাদের কোনো কাজে উৎসাহিত করার বা সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দেয়ার আগ্রহী হতে পারেন না। তাদের লক্ষ্য নিজে কীভাবে কত দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে কত উচ্চতর আসনে আরোহণ করা যায়। কীভাবে অনেক অনেক বেশি নিজের জন্য অর্থ-সম্পদ অর্জন করা যায়।
সম্ভবত আমার দুর্ভাগ্য যে আমি সত্যিকারের কোনো অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তি বা প্রেরণাদায়ক বক্তা খুঁজে পাইনি। পরিবর্তে, আমি দেখেছি কীভাবে মানুষ ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য নিজের নীতি-নৈতিকতা, সততা এবং ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিতে পারেন। আমি প্রত্যক্ষ করেছি, মিটিং চলাকালীন একজন জুনিয়র অফিসার চিৎকার করে অফিস প্রধানকে ‘তুমি ইডিয়ট তুমি একটা স্টুপিড বলে অপমান করতে। কিন্তু সেই অফিস প্রধানের কাছে এসব কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় নেই। উনি মুখে হাসি ধরে রেখেছেন। তিনি শান্তভাবে মিটিং শেষ করে মিটিংযের সফলতায় মুখে লম্বা হাসি রেখে মিটিং থেকে বেড়িয়ে গেছেন। ঘটে যাওয়া ঘটনায় একেবারে ভাবলেশহীন, তার সাফল্যই যেন মিটিং সফল করা। তিনি তা পেরেছেন সেখানেই সফলতা। তিনি রাগতে পারেন না কারণ তিনি শিখেছেন কোনো অবস্থায় রাগ করা যাবে না কারণ রাগ করলেই হারতে হবে।
দীর্ঘদিন পর পরিচিতজন ফোন করে হতাশার সাথে জানালেন তার অফিসে নতুন দায়িত্ব প্রাপ্ত বসের সাথে ভালো যাচ্ছে না। তাই ভাবছেন অন্য কোথাও সরে যেতে। অনুরোধ করলেন ভালো কোনো সুযোগ জানা থাকলে তাকে যেন জানাই। আমি তাকে যেখানে আছে, সেখানেই মানিয়ে চলতে বললাম। কারণ বয়স প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই এই বয়সে নতুন কোথাও আর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সয্যোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভালো প্রতিষ্ঠান ভালো বেতন সযোগ-সুবিধায় এখানেই মানিয়ে বাকি দিন পার করতে বললাম। নেহাত প্রতিষ্ঠান যদি ছেড়ে দেয় সে অন্য কথা। আমাদের সকলকে ভাবতে হবে, গোষ্ঠীগত যে কোনো কাজে কর্মে সহকর্মীদের সকলে মিলেই একটি পরিবার। সবার মধ্যে দৃঢ় সৌহার্দ্য সহমর্মিতা বজায় রাখতে হবে। প্রধানকে অবশ্যই অন্যদের উপর কর্তৃত্ব করা এবং তাদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করার পার্থক্য বোঝা অপরিহার্য। যদি কেউ নিজ প্রতিষ্ঠানে উপরে ওঠার আকাঙ্ক্ষা করে, তবে তাকে নিশ্চিত করা উচিত যে তার প্রস্থানে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে, হিংসা বা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় না নিয়ে পরবর্তী কাউকে তার স্থানের জন্য তৈরি করা। মনে করা প্রয়োজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, মানুষ তার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যায় না, তারা তাদের বসকে ছেড়ে যান বা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। সত্যিকারের জীবনের সাফল্য হবে, তখনই আপনি চলে যাওয়ার পর আপনার অবর্তমানে সকলে না হওক অন্তত একজনও যদি শ্রদ্ধার সাথে আপনাকে স্মরণে রাখেন।
সবাই, আসুন জীবনের প্রতিক্ষেত্রে মানবিক হই, সহমর্মী হই, সবাইকে সম্মান দিতে শিখি। কারো অগ্রযাত্রায় কিংবা উন্নতিতে সহায়তা করতে না পারলেও কোনোভাবেই যেন প্রতিবন্ধকতা কারণ না হই।
কলাম লেখক