এই সুন্দর পৃথিবীর প্রথম শত্রু যুদ্ধ এবং এর পরেই রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সারা বিশ্বেই বছরব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত করে। এর ফলে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদ্বাস্তু হয় অসংখ্য মানুষ। এক একটি মহাদেশে একেক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটার প্রবণতা বেশি থাকে। যেমন- বাংলাদেশে প্রতি বছরই বন্যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। জাপানে ভূমিকম্প। এছাড়াও নানা মাত্রার ঘূণিঝড়ও বিভিন্ন দেশেই ব্যাপক ক্ষতি করছে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনেও রয়েছে মানুষেরই অসচেতনতা। কয়েকদিন পরেই শেষ হতে চলেছে ২০২৪ সাল। এ বছর বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিমা ও পুনর্বিমা সংস্থা সুইস রে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে তাপপ্রবাহ, খরা, অতি-বর্ষণ, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অন্তত ৩১ হাজার কোটি ডলার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর বিশ্বজুড়ে ঘটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার ছিল ছয় শতাংশ বেশি। ফলে চলতি বছর ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে গত বছরের চেয়ে অধিক।
সুইস রে’র হিসেব অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে শুধু বিমাকৃত সম্পদকে ধরা হয়েছে। বিমার বাইরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি। সুইস রে’র দুর্যোগ ও বিপর্যয় বিভাগের প্রধান বাল্জ গ্রোলিমুন্ড জানান, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি। যেসব স্থাবর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেসব পুনর্নির্মাণের ব্যয়ও অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বেশি পড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন বাল্জ।
বৈশ্বিক বিভিন্ন জলবায়ু সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন টানা ও দীর্ঘ তাপপ্রবাহ ও খরা দেখা গেছে, তেমনি নানা দেশে হয়েছে বিধ্বংসী ও ব্যাপক বন্যা। সুইস রে’র রেকর্ড বলছে, বন্যার কারণে চলতি বছর শুধু ইউরোপে ধ্বংস হওয়া সম্পদের আর্থিক মূল্য এক হাজার কোটি ডলারের বেশি। চলতি বছর ইউরোপে যেসব বন্যা হয়েছে, সেসবের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বরিসের প্রভাবে মধ্য ইউরোপের বন্যা ও সেপ্টেম্বরে স্পেনে বন্যা ছিল সবচেয়ে বিধ্বংসী। স্পেনে বন্যায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২৩০ জন মানুষ। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে হেলেন ও মিল্টন নামে বড় দু’টি হারিকেন আঘাত হেনেছে।
শুধু এ দু’টি ঝড়ের জেরে দেশটির ধ্বংস হওয়া সম্পদের আর্থিক মূল্য অন্তত ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বছরের যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে যেসব হারিকেন এবং টর্নেডো আঘাত হেনেছে, তাতেও লোকসান হয়েছে শত শত কোটি ডলার। সামনের দিনগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন বাল্জ গ্রোলিমুন্ড।
বিশ্বজুড়েই পরিবেশ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেই মাত্রা এমন যে এখনই পদক্ষেপ না নিলে মানব সভ্যতাই হুমকিতে পড়বে। উন্নয়নের নামে সারা বিশ্বেই পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞ চলে বছরব্যাপী। উন্নয়নের প্রথম বলি হয় গাছ। অথচ এসব গাছেরও জীবন আছে। তাদেরও কষ্ট হয়। মরে যাওয়ার অনুভূতি আছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু এ কথা বহু আগেই প্রমাণ করেছেন। গাছ কেটে আমরা অথবা এই শিল্পনির্ভর বিশ্ব যে মহাভুল করছে সেকথা স্বীকার করলেও সেখান থেকে বাঁচার পথ না খুঁজে ফের গাছ কাটাতেই ব্যস্ত আছে। যার ফল পাচ্ছি হাতেনাতে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ অতীতের রেকর্ড তাপমাত্রায় পুড়েছে। পাকিস্তান পুড়ছে। ভারতও পুড়ছে। আবার অন্য প্রান্তে ভয়াবহ বন্যায় ও ভূমিধ্বসে শত শত মানুষ বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, অতি উত্তপ্ত এই বিশ্ব আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বহুমুখী। অর্থাৎ জলবায়ুর কারণে আমাদের ক্ষতির বোঝা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জিওগ্রাফির একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রবল গরম ও খরার মুখোমুখি হতে চলেছে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ। নেচার সাসটেনেবিলিটি পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবল উষ্ণায়ন ও স্থলভাগে পানির সংকট- এ দুই কারণে পৃথিবীজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দশগুণ বাড়বে। কার্বন নিঃসরণও সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকবে। এসব কারণে অর্থনীতিও প্রবাভিত হবে। ধনীরা আরো ধনী হবে এবং গরিব আরো গরিব হবে। খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে এ পরিস্থিতি। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, খরাবিধ্বস্ত হর্ন অব আফ্রিকায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২২ মিলিয়ন পৌঁছেছে। কেনিয়অ, সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মুখে পড়েছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন বিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি। যা দৈনিক গড়ে দুইটির কাছাকাছি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ দুই দশকে প্রতি বছর ৩৫০ থেকে ৫০০ টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী। এটি আগের তিন দশকের গড় দুর্যোগের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি। বৈশি^ক উষ্ণায়নের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ এর ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। শিল্প যুগ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর আবহমন্ডলের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ধ্বংস হওয়ার সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। এর দুইটি কারণই মানবসৃষ্ট। একটি হলো যুদ্ধ এবং অপরটি হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এমনকি বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি ঘটছে, মানুষের সম্পদের বিনষ্ট ঘটছে, স্থানচুত্যি ঘটছে এবং জীবিকার পরিবর্তনের মানুষের জীবনযাপনে বিরূপ প্রভাব পরছে। বজ্রপাতের মৌসুমেও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যেই তীব্র গরম আবহাওয়া বদলানো ইঙ্গিত দিচ্ছে। কয়েকদিন আগেই রোমেল আঘাত করেছে। এভাবে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ শেষ হতে না হতেই আর একটি দুর্যোগ আঘাত করছে। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও যে ক্ষয়ক্ষতি হয় সেটাও কম নয়। এমনকি পুরো এশিয়া জুড়েই তীব্র তাপপ্রবাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত এপ্রিলে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলে মৌসুমী তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মে মাসের শেষ দিকে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভিয়েতনামের তাপপ্রবাহ জুন পর্যন্ত স্থায়ী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাবো। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০ টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা।
যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচুত্য হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের উপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় মানুষকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। পরিবেশ দূষণ কমাতে হবে এবং সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট