বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। নির্বাচন শুধুমাত্র দেশের মধ্যে নতুন প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করে না। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই প্রতিনিধিত্বের উপস্থিতির উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বৈশ্বিক মোড়লদের সাথে উদীয়মান উঠিত শক্তিধর দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার, বাণিজ্য চুক্তিসহ কুটনৈতিক কলাকৌশল বিনির্মাণ এই নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধির স্বভাবসুলভ আচরণ, বৈশ্বিক ভাবনা-চিন্তা, দেশীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতগুলোকে ইতিবাচক গতিশীলতার মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টিতে নির্বাচন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে দেশে ও বর্হিবিশ্বে। বিশ্বরাজনীতি একটি আলোচিত ও গঠনমূলক বিষয়বস্তু। সময়ের সাথে বৈশ্বিক রাজনীতির ধরন ও কলাকৌশলে বেশ পরিবর্তন আসে। যার ছাপ বর্তমানে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। চলমান বিশ্বরাজনীতির ইতিবৃত্ত শুধুমাত্র সমরাস্ত্র, কূটনীতিক সমন্বিত চুক্তি, পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ এসব কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন বেশ প্রভাব ফেলে আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি বিশ্বরাজনীতির কাঠামো ব্যবস্থাপনায়ও। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান ২০ জানুয়ারি, যা এখনো অনেক সময় বাকি। তার পরও ট্রাম্প আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই বিশ্ব নেতারা তার কাছে পৌঁছাতে শুরু করেছিলেন। তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে শুরু করে ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত তার প্রভাবের দীর্ঘ ছায়া ফেলেছেন।
বাইডেন প্রশাসন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপের কারণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। কেউ কেউ তাকে অভিযুক্ত করেছেন যে, তিনি তার নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিশ্বমঞ্চে অনেক নেতার ভাবমূর্তি পরিবর্তন করে ফেলেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখনো তার রাজনৈতিক মিত্রদের শক্ত করার চেষ্টা করছেন। মার্কিন নির্বাচন হওয়ার পর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো শপথ নেননি। তিনি ইতোমধ্যে এমন পদক্ষেপগুলো ঘোষণা করছেন; যা বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তিনি ইতোমধ্যে দুটি মিত্র, এক প্রতিপক্ষ এবং শক্তিশালী গ্লোবাল সাউথ গ্রুপের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। গত মাসে ট্রাম্প মেক্সিকো এবং কানাডাকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, দুটি দেশ থেকে আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে; যদি না তারা আমেরিকার সঙ্গে তাদের সীমান্তজুড়ে মাদক ও অভিবাসীদের প্রবাহ রোধে ব্যবস্থা না নেয়। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট চীনকে যুক্তরাষ্ট্রে তার আমদানির ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কের হুমকিও দিয়েছেন। এই দুটি হুমকি বর্ণনা করলে বোঝা যায়, কীভাবে ট্রাম্প তার অর্থনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছেন। তিনি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর প্রতি নমনীয় এবং শত্রুদের ক্ষেত্রে কঠোর দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই দুটি ঘোষণার পর মেক্সিকো ও কানাডা উভয়কে ভাবিয়ে তুলেছিল। এবং দুটি ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক করেছিল। মেক্সিকো পারস্পরিকভাবে হুমকি দিয়েছিল, যা ট্রাম্পের কাছেও পৌঁছেছিল। যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাকে বোঝানোর জন্য মার-এ-লাগো সফর করেছিলেন, তখন তিনি তাকে বলেছিলেন, এই ধরনের শুল্ক উভয় পক্ষের জন্য ক্ষতিকর হবে। বিজয়ী ট্রাম্প আবারো নয়টি ব্রিকস গ্রুপের দেশ- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন; যারা ডলার থেকে দূরে সরে যেতে যান। তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন, আমেরিকা যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত সেই সময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এই দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন যে; তারা শক্তিশালী মার্কিন ডলার প্রতিস্থাপনের জন্য কোনো নতুন ব্রিকস মুদ্রা তৈরি করবে না বা অন্য কোনো মুদ্রা ফিরিয়ে দেবে না। যদি তারা করে তাহলে তারা ১০০ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হবে’। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানেন, ব্রিকস দেশগুলো ডলারের বিকল্প মুদ্রা চালু করা থেকে এখনো অনেক দূরে। তিনি বলেছিলেন, কোনো সুযোগ নেই। ব্রিকস বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন ডলার প্রতিস্থাপন করবে। যে দেশ এমনটি ঘটানোর চেষ্টা করবে তার উচিত আমেরিকাকে বিদায় জানানো। ডলার এখনো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রিজার্ভ মুদ্রা এবং বিশ্ববাণিজ্যের ৮০ শতাংশে এই মুদ্রা ব্যবহৃত হয়। আটলান্টিক কাউন্সিল অনুসারে মূল বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারকে কিছুটা নিরাপদ বলে মূল্যায়নের ইঙ্গিত দেয়। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, নতুন ব্রিকস রিজার্ভ মুদ্রা বৈশ্বিক লেনদেনের জন্য ব্যাপকভাবে বিশ্বাসযোগ্য হবে, যা স্থিতিশীল বা যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হবে। এটা ট্রাম্পের জন্য সমস্যা নয়। তার লক্ষ্য হলো বালুতে একটি ছবি আঁকা এবং বিশ্বকে তা অতিক্রম করার সাহস দেওয়া। তিনি বিশ্ব নেতৃত্বকে বলছেন, ‘আপনি হয় আমাদের সঙ্গে থাকেন বা বিপক্ষে থাকেন, এটি এখনই বেছে নেয়ার সময়’।
ট্রাম্পের কৌশলগুলো সরাসরি তার বই ‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিল’ থেকে এসেছে। তিনি তার প্রথম মেয়াদে এই আলোচনার কৌশলগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছিলেন। তার প্রতিবেশী এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার নতুন হুমকি আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে একটি কঠিন বার্তা। কেউ একবার ট্রাম্পের আলোচনার স্টাইলকে এমন একজনের মতো বলে বর্ণনা করেছিলেন যে, রুমে প্রবেশ করার আগে বোমা ছুড়ে ফেলার মতো। তার ক্রোধের বিষয়টি হতবাক করার মতো এবং ভারসাম্যহীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যারিফগুলো তার জন্য শুধু আলোচনার হাতিয়ার মাত্র। এটা রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করে। ট্রাম্পের নতুন নির্বাচিত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হলেন রেপ। মাইকেল ওয়াল্টজ এটিকে ট্রাম্প প্রভাব বলে অভিহিত করেছেন। তিনি টুইট করেছেন, ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া এবং কিউবার স্বৈরশাসকরা ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এমনকি হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল তাও ওয়াল্টজের জন্য। এটি ট্রাম্পের প্রভাবের ফল। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কারণে সবাই টেবিলে বসছে’। তিনি আরও বলেন, ‘তার ধ্বনিত বিজয় বাকি বিশ্বের কাছে স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে যে, বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নিরসনের দিকে কংক্রিট পদক্ষেপ দেখে আমি আনন্দিত’। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান ২০ জানুয়ারি যা এখনো অনেক সময় বাকি। তার পরও ট্রাম্প আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই বিশ্ব নেতারা তার কাছে পৌঁছাতে শুরু করেছিলেন। তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে শুরু করে ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত তার প্রভাবের দীর্ঘ ছায়া ফেলেছেন। বাইডেন প্রশাসন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপের কারণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। কেউ কেউ তাকে অভিযুক্ত করেছেন যে, তিনি তার নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিশ্বমঞ্চে অনেক নেতার ভাবমূর্তি পরিবর্তন করে ফেলেছেন।
রায়হান আহমেদ তপাদার
গবেষক ও কলামিস্ট