ঢাকা ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কবিতায় প্রবীণ এবং রবীন্দ্রনাথ

হাসান আলী
কবিতায় প্রবীণ এবং রবীন্দ্রনাথ

আমার মতে কবিতা হলো- ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি, বিবেচনা সংক্ষিপ্তভাবে উপমা, রূপক, অলংকার দিয়ে প্রকাশ। কবিতা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে মানুষের মুখে মুখে, সুখে-দুঃখে। দুর্বোধ্য কবিতার চাইতে সহজ সরল কবিতা সাধারণ মানুষকে অনেক বেশি আলোড়িত করতে পারে। আমি কবিতা লিখিনি, কারণ কবিতা লেখার মতো যোগ্যতা আমার ছিল না এবং কোনদিন হবেও না। সুযোগ পেলেই আমি কবিতা পড়ি। প্রবীণ বিষয়ে কাজ করি বলে কবিতায় প্রবীণকে খুঁজি। চারদিকে যৌবনের জয়জয়কার। যৌবনের বন্দনা কবি সাহিত্যিকরা সবচেয়ে বেশি করেন বলে আমার ধারণা। যৌবনই সবার আরোধ্য। যৌবনের শক্তি, তেজ, উজ্জ্বলতা, শৌর্য বীর্য, ক্ষিপ্রতা, সৃষ্টি, ধ্বংস মানুষকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।

কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ইংরেজির অধ্যাপক আমাদের পড়ালেন ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সাড়া জাগানো কবিতা ‘ক্রেবিড এইজ এন্ড ইউথ’। কবি বললেন, বার্ধক্য আর যৌবন এক সাথে যায় না। যৌবন সচল বার্ধক্য অচল। যৌবন গরম বার্ধক্য ঠান্ডা। যৌবন প্রশংসার আর বার্ধক্য ঘৃণার।

যৌবনে পৌঁছে পড়লাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘প্রবীণ ও নবীন’। কবি একজায়গায় লিখেছেন, ‘পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়,- কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায় হায়। পাকা চুল বলে, মান সব লও বাচা, আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।’ রবীন্দ্রনাথের ‘চাঁদের বুড়ি’ কবিতায় ‘এক যে ছিল চাঁদের কোনায়- চরকা কাটা বুড়ি, পুরানে তার বয়স লেখে- সাতশো হাজার কুড়ি।’

ক্ষান্ত বুড়ির দিদি শাশুড়ি কবিতায় লেখেন, ক্ষান্ত বুড়ির দিদি শাশুড়ির, পাঁচ বোন থাকে আলনায়। শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়, হাঁড়িগুলো আলানায়।’

প্রবীণরা স্মৃতি হারানো রোগ আলঝাইমার্স রোগে আক্রান্ত হলে উল্টা পাল্টা কাজ করে থাকে। কবি বোধ হয় কবিতায় এটাই বুঝাতে চেয়েছেন।

কবি তাঁর ‘অচলা বুড়ি’ কবিতায় লিখেছেন,

‘অচলা বুড়ি, মুখ খানি তার হাসির রসে ভরা,-

স্নেহের রসে পরিপক্ব অতি মধুর জরা।- ফুলো ফুলো দুই চোখ তার, দুই গালে আর ঠোঁটে। -উচলে পড়া হৃদয় যেন ঢেউ খেলিয়ে উঠে। - পরিপুষ্ট অঙ্গটি তার, হাতের গড়ন মোটা-কপালে দুই ভুরুর মাঝে উলকি আঁকা ফোঁটা।‘ ‘অচলা বুড়ি’ গাড়ি চাপায় পড়ে রাস্তার পা ভাঙ্গা কুকুরকে সেবা যত্ন করে সারিয়ে তোলেন। সেই খোঁড়া কুকুরটি পরবর্তীতে বুড়ির নিত্য সহচর। আধ-পাগলা এক ঝি ছিল তার গৃহস্থালি কাজে সহায়তা করার জন্য। গৃহকর্মী নিয়ে চরম অসন্তুষ্টির যুগে বুড়ি আধ পাগলা ঝি কে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। বিবেচনা সম্পন্ন বুড়ি পরকালের কথা ভেবে ব্রাহ্মণকে অর্থ দান করতে রাজী হননি। দাদাঠাকুরের প্ররোচনায় টাকা ধার দিতে রাজি হননি। বলেছেন, টাকা তার দরকার হবে।

গ্রামের এক মেয়ে অকালে স্বামী এবং বাবাকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভাইদের কাছে পর্যন্ত ঠাঁই হলো না।দৈন্যদশার লাজে হাসপাতালে রোগী সেবার কাজে যোগ দিল।নার্সিং ট্রেনিং নিতে অচলা বুড়ি এই উপায়হীন বিধবাকে অনুপ্রেরণা এবং সহায়তা করেছেন। সমাজের ছিঃ ছিঃ, জাত গেল, জাত গেল রবকে বুড়ি পাত্তা দেননি।

জমিদারের মায়ের শ্রাদ্ধে বেগার খাটার জন্য রাই ডোমনির ছেলেকে বলা হয়েছিল। ছেলে মিশনারী স্কুলে পড়ে কম্পোজিটরের কাজ শিখে শহরে দু’পয়সা ভালোই রোজগার করে। ছেলে কাজ রেখে জমিদারের মায়ের শ্রাদ্ধে বেগার খাটতে রাজি হয়নি ফলে জমিদার ডাক লুটের মামলায় সাক্ষ্য সাবুদ যোগাড় করে আদালতের মাধ্যমে সাত বছরের জেল দেয়। রাই ডোমনি মনের দুঃখে গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন গ্রামে বসবাস শুরু করে। অচলা বুড়ি পুরো মাসের বাজার করে রাই ডোমনি কে দেখতে যেতেন। গাঁয়ের লোকজনের সমালোচনার জবাবে বলতেন, যারা ওকে দিল দুঃখ রাশি, তাদের পাপের বোঝা আমি হাল্কা করে আসি।

অচলা বুড়ির পাতানো এক নাতনি শ্বশুর বাড়িতে ভীষণ জ্বরে ভুগছিল। বুড়ি নাতনির সেবা শুশ্রূষা করে সারিয়ে তোলেন। অবশেষে তিনি নিজে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মৃত্যুর পূর্বে বুড়ি তার জমানো টাকা পয়সা অসহায় রাই ডোমনিকে দিয়ে যান। ঘরের জিনিসপত্র, আসবাবপত্র সব কিছু আধপাগলি ঝি কে দিয়ে দেন এবং খোঁড়া কুকুরটিকে আধপাগলি ঝির জিম্মায় দিয়ে যান। মৃত্যুর পর ‘ঠাকুর বললে মাথা নেড়ে, অপাত্রে এই দান! -

পরলোকের হারালো পথ, ইহ লোকের দান।’

খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় প্রবীণদের নিয়ে কয়েকটি ছড়া ও কবিতা লিখেছেন তা হলো, বদ্যি বুড়ি, বুড়ির বাড়ি, কাতুকুতো বুড়ো।

শিশু সাহিত্যিক সুনির্মল বসু ‘গল্প বুড়ো’ কবিতায় লিখেছেন-

বইছে হাওয়া উত্তরে-

গল্প বুড়ো থুত্থুরে-

চলছে হেঁটে পথ ধরে-

শীতের ভোরে সত্বরে-

চেঁচিয়ে যে তার মুখ ব্যাথা-

‘রূপ কথা চাই, রূপ কথা’।

ভারতের তামিলনাড়ুর কবি সেলেন্টাইন রাজ মনোহর প্রবীণদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সনেট রচনা করেছেন যথা কেয়ার অব দ্য এল্ডারলি,এল্ডারলি নিড লাভ এন্ড কেয়ার।

আমাদের দেশের কবি শামসুর রাহমানের বিখ্যাত ছড়া ‘উকুনে বুড়ি’ পাঠ্যবইতে ছিল।

‘বক সাত দিন রইলো উপোষ-

ফেনিয়ে গেল জল কি?-

হেঁই উকুনে বুড়ি তোমার -

হাতে ওটা ফল কি? ‘আমেরিকার কবি ডোনাল মহনি’ এ সিনিয়র সিটিজেনস ফার্স্ট ইমেইল ‘কবিতায় শেষের দিকে লিখেছেন, আমি মারা গেলে আমার স্ত্রী তোমাকে ইমেইল করবে এবং একইভাবে তুমি মারা গেলে তোমার স্ত্রী আমাকে ইমেইল করবে। তার এসব লেখা প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে, পাওয়া যায় আমাজনে। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ইংরেজি সাহিত্যের নাম করা কবি।

কবিতার জন্য ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। তার প্রবীণদের নিয়ে বিখ্যাত কবিতা, ‘হোয়েন ইউ আর ওল্ড’। তিনি প্রবীণ জীবনকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

শিশু সাহিত্যিক দীন নাথ মন্ডল লিখেছেন ছড়া ‘পান্তা বুড়ি’ ‘পান্তা বুড়ি, পান্তা বুড়ি, কোথায় তুমি যাও?- তোমার ঘরে বেড়াল ছানা- মাও মাও মাও মাও!’ কবি আহমেদ মাওলার ‘পান্তা বুড়ি’ কবিতাটি জীবনকে দারুণভাবে স্পর্শ করে। ‘ছেঁড়া শাড়ি, চোখের ছানি- কাঁদবে চোখে নেই তো পানি’-

তাইতো বুড়ি ফুটপাতে... লোকের কাছে হাত পাতে কিশোর আলোতে ২০২২ সালে কবি সারাহ মাসরুবা ‘আজব বুড়ো’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কয়েকটি লাইন শহর ছেড়ে চললো বুড়ো- চাইলো না আর ফিরে। কেই-বা ভাবে বুড়োর কথা-

এত্ত কাজের ভিড়ে। “কবি রুদ্র কিশোর ২০২০ সালে ‘শেষ বয়সের ভালোবাসা’ নামে একটি কবিতা লেখেন। ‘তুমি বরং আমার বৃদ্ধ বয়সে ভালোবেসো,- আমার সাথে না হয় তুমি- শেষ হাসিটা হেসো- বৃদ্ধ বয়সে কেউ দিবে না আশা- তুমি না হয় আমার জন্য- জমিয়ে রেখো একটু ভালোবাসা”।

কবি আয়েশা আক্তার নুপুর ‘বয়স’ কবিতায় লিখেছেন ‘বয়সটা বেড়ে গেলে হারিয়ে যায় আনন্দ,- অবসরে ছোট ঘরে, একাকী নিঃসঙ্গ।’ শেষ করবো ব্রিটিশ কবি জন হুইট ওয়ার্থ কে দিয়ে। তিনি ১৯৪৫ সালে ভারতবর্ষে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রবীণদের জন্য তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘টুয়েলভ ডোন্ট ফর দ্য এইজড’।

কবিতার ভাবার্থ হলো, ‘প্রতিদিন গোসল করো, উতলা হয়ে যেওনা।

ভালোদিন গত হয়েছে এই কথা বলো না।- বক বক করে সময় নষ্ট করো না,- হঠাৎ করে দাড়ি-গোঁফ রেখো না। -উদ্ভট কাজ শুরু করতে যেও না,- রেস্টুরেন্টে গিয়ে চেঁচামেচি করো না।- ওয়েটারকে টিপস দিতে ভুলো না,- সোফায় বসে দিন পার করো না।- বিকালটায় মাতাল হয়ে থেকো না।-

শেষ পর্যন্ত হতচ্ছাড়া হয়ো না। আমি প্রবীণদের নিয়ে যে কয়টা কবিতা পড়লাম তার সব গুলোতে প্রবীণ জীবনের দুর্বলতা, অক্ষমতা, অসারত তুলে ধরা হয়েছে। কবিতা ছড়ায় শিশু হাসাতে, আনন্দ দিতে বুড়ি চরিত্রকে অবলম্বন করা দুর্বলের উপর আক্রমণ বলে মনে হয়েছে। আমাদের সমাজটাই দুর্বলকে কে আঘাত করে, অপমান করে।

শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অচলা বুড়ি’ কবিতার মাধ্যমে একজন প্রবীণ নারীকে মহৎ, মহান, অসাম্প্রদায়িক, কুসংস্কার মুক্ত, পরোপকারী, দরদী, আত্মত্যাগী, পরকাল বিমুখ একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন।

আমাদের কবিদের একটি অংশ প্রবীণদের অক্ষম, দুর্বল, করুণা, দয়ার পাত্র হিসেবে হিসেবে তুলে ধরেছেন সেটা দুঃখের। চূড়ান্ত বিচারে এটা বয়সবিদ্বেষী মনোভাব। আজকের বর্তমান তৈরি হয়েছে আজকের প্রবীণদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। তাদের সম্মান মর্যাদার সাথে কবিতায় স্থান দেয়া উচিত হবে। কোনো কারণে সম্ভব না হলে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা ঠিক হবে না। দেশে দুই কোটি প্রবীণের বসবাস, কবিরা বিষয়টি বিবেচনায় রাখেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, সংগঠক ও লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত