ডেঙ্গু বর্তমানে এক আতঙ্কের নাম। প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ বছরের শুরুর দিকে আক্রান্তের হার তুলনামূলক কম থাকলেও পরে বিগত বছরের ধারাই অব্যাহত রেখেছে। এখন সারা বছরই কমবেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। এর সঙ্গে এবার নতুন যোগ হয়েছে চিকুনগুনিয়া। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫৩ জন। ফলে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৬ জনে। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এসব তথ্য জানানো হয়েছে।এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরিশাল বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং খুলনা বিভাগীয় এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন করে মোট চারজনের মৃত্যু হয়। আর আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে ৪২ জন, ঢাকা বিভাগে ৩৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ জন, বরিশাল বিভাগে ৩০ জন, খুলনা বিভাগে ২৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে দুইজন, রাজশাহী বিভাগে ছয়জন এবং রংপুর বিভাগে একজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৬ জন। এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৯০ শতাংশ নারী।
এছাড়া, মোট ৫৬৪ জনের মধ্যে ৫১ দশমিক ৮০ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ পুরুষ। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায় এবং ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত বছর (২০২২) দেশে মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০২৩ সালে, মোট ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে, গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৭০৫ জন মারা যান, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে ডেঙ্গু জ্বরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা। এর আগে ২০১৯ সালে দেশে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমনভাবে দেখা না গেলেও, ২০২১ সালে সারাদেশে ২৮ হাজার ৪২৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যার মধ্যে ১০৫ জন মারা যান। ২০২২ সালে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ওই বছর ২৮১ জন মারা যান।
ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া কি একসঙ্গে হতে পারে : এ দুই ইনফেকশন একসঙ্গে হতে পারে, তবে ব্যাপারটি এখন পর্যন্ত বিরল। এ পর্যন্ত কিছু রোগী পাওয়া গেছে। আগেও বিচ্ছিন্নভাবে এ রকম একসঙ্গে ইনফেকশনের ইতিহাস আছে। বিভিন্ন দেশে কিছু কেস রিপোর্ট আছে, বাংলাদেশেও এ রকম কিছু রোগীর কেস রিপোর্ট হয়েছে।
কীভাবে সম্ভব : ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটি ইনফেকশনেরই বাহক একই মশা। একই সঙ্গে দুটি ভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে এ রকম একসঙ্গে ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। বাহক মশা একই সঙ্গে দুটি ইনফেকশন বহন করতে পারে। আবার ক্রস রিঅ্যাকটিভিটি নামক জটিল প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিবডি থেকে এ রকম ঘটনা হতে পারে
উপসর্গ : সাধারণ উপসর্গগুলোই বেশি লক্ষণীয়। যেমন জ্বর, মাথাব্যথা। এ ছাড়া শারীরিক দুর্বলতা, বমি বমি ভাব, শরীরব্যথা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা—এগুলোও থাকতে পারে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিতেই শরীরে র্যাশ দেখা যেতে পারে। তবে এবার চিকুনগুনিয়ায় র্যাশ বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া অনেক রোগীর শুরুর দিকে ডায়রিয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া একসঙ্গে হলে কী করবেন : এ দুটি ইনফেকশন একসঙ্গে হলে তুলনামূলকভাবে রোগের প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। দুটি ইনফেকশন আলাদা আলাদাভাবে শরীরের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আলাদা আলাদা ইনফেকশনের তুলনায় একসঙ্গে ইনফেকশনে রোগীর জটিলতা ও মৃত্যুহার সামান্য বেশি। তবে এ ব্যাপারে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে।
ডেঙ্গু উপসর্গ : জ্বরই প্রধান উপসর্গ। চামড়ায় দানা (র্যাশ), রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে কারও কারও।
জ্বর : অন্য ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গুজ্বর সাতদিনের বেশি থাকে না। প্রথমদিকে একটানা উচ্চ তাপমাত্রায় থেকে ছয়দিনের পর জ্বর চলে যেতে পারে। দুদিন পর একদিন জ্বর না থেকে আবার দুদিনের জ্বর থাকল তারপর জ্বর চলে গেল তাও হতে পারে।
অন্যান্য উপসর্গ : সব জ্বরে, বিশেষত ভাইরাস জ্বরে গা ম্যাজ ম্যাজ করে ব্যথা হয়। ডেঙ্গুতে ব্যথা বেশি হয়। অনেকের এত বেশি ব্যথা হয় যে, তারা হাড় ভাঙার সঙ্গে তুলনা করেন। এ ছাড়া রোগীর চোখের পেছনেও ব্যথা অনুভূত হয়।
রক্তক্ষরণ : চামড়ায়, মুখে, খাদ্যনালিতে, চোখে হতে পারে। তবে বেশি যা হয় তা হলো মেয়েদের মাসিক একবার হয়ে গেলেও একই মাসে আবার মাসিক হয়।
দানা (র্যাশ) : ডেঙ্গুর টিপিক্যাল র্যাশ বেরোয় জ্বরের ষষ্ঠ দিনে। তখন জ্বর থাকে না। দেখলেই চেনা যায়, খুঁজতে হয় না। এ ছাড়া জ্বরের প্রথমে গায়ে চাপ দিলে আঙুলে ছাপ পড়ে। এটাকে তিনটা ফেইজে বলা হয়।
১. ফেব্রাইল ফেইজে জ্বর ও জ্বরের উপসর্গ থাকে।
২. এফেব্রাইল ফেইজে জ্বর চলে যায়। তবে এটাকে ক্রিটিক্যাল ফেসও বলে। ডেঙ্গু হিমোরেজিক জ্বরের স্টেজটা মারাত্মক জটিল হয়। এটা দুইদিন থাকে। জ্বর না থাকলেও এ সময় সতর্ক থাকতে হয়।
৩. কনভালেসেন্ট ফেইজে অধিকংশ সেরে উঠলেও কেউ কেউ ভীষণ দুর্বল হয়। বিষন্নতায় ভোগেন।
ডেঙ্গু দুই ধরনের : ক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার : আর দশটা ভাইরাল ফিভারের মতো ভয় না পেলে কোনো সমস্যা নেই। খ. ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার : ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর সবকিছুই থাকে। রক্তনালির লিকিং হয় বলে বাড়তি কিছু সমস্যা হয়। জ্বরের সঙ্গে যদি প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম হয় এবং হিমাটক্রিট ২০ শতাংশ ভেরিয়েশন হয় তবে সেটা ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার। ডেঙ্গু হিমোরেজিক জ্বরের চারটি গ্রেড রয়েছে।
গ্রেড-১ : টুনিকেট টেস্ট পজিটিভ হওয়া ছাড়া রক্তক্ষরণের আর কোনো আলামত থাকে না।
গ্রেড-২ : দৃশ্যত, রক্তক্ষরণ থাকে। গ্রেড-৩ : ১ বা ২ এর সঙ্গে যদি ব্লাড প্রেশার কমে, পালস বাড়ে। গ্রেড-৪ : ১ বা ২ এর সাথে যদি ব্লাড প্রেশার, পালস রেকর্ড না করা যায় গ্রেড ৩ ও ৪-কে একসঙ্গে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলে।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষা : খুব টক্সিক না হলে কোনো জ্বরেরই তিনদিন আগে কোনো পরীক্ষার দরকার নেই। টিসি ডিসি হিমোগ্লোবিন ইএসআর, এসজিপিটি : ভাইরাল ফিভারে কাউন্ট বাড়ে না। যদি কাউন্ট কমে, বিশেষ করে টিসি তিন হাজারের নিচে নামে তাহলে ডেঙ্গু নিশ্চিত। এনএস ১ জ্যান্টিজেন : এটাই জ্বরের প্রথম সপ্তাহের পরীক্ষা। জ্বর থাকাকালীন পজিটিভ হয়। অ্যান্টিবডি পরীক্ষা : সাত দিন পর পজিটিভ হয় বলে এটা কার্যকরী নয়। এনএস ১ অ্যান্টিজেন করা গেলে এটার দরকার ও নেই। প্লাটিলেট কাউন্ট ও হিমাটোক্রিট : প্লাটিলেট আতঙ্ক না থাকলে অত্যাবশ্যকীয় নয়। হিমোরেজক ফিভার ডায়াগনোসিস ও ফলোআপের জন্য করা লাগে। হিমোরেজিক ফিভার হলে পেটে ও ফুসফুসে পানি নিশ্চিত করার জন্য পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও বুকের এক্স-রে করা লাগে।
নিউট্রিশন : জ্বরের সময় ক্ষুধামন্দা হয়, বমি লাগে। এ সময় ফলের রস উপকারী। স্বাভাবিক খাবার খাওয়া যাবে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু এবং গ্রেড-১ হিমোরিজিকে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। গ্রেড-২ এ অতিরিক্ত সমস্যা হলো প্রথমে ধরতে না পারলে চিকিৎসা না দিলে গ্রেড-৩ বা গ্রেড-৪ অর্থাৎ শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে। পরিমিত পানি দিতে হবে জ্বর নামিয়ে রাখতে। গ্রেড-২ তে যদি পেটের ব্যথা কমছে না, বমি হচ্ছে অথবা প্রেশার ঠিক থাকছে না তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।
রক্ত দেওয়া (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) : রক্তক্ষরণ হলে নিয়ম হলো রক্তবদল করতে হয়। সিস্টলিক ব্লাড প্রেশার ১০০-এর নিচে নামলে, পালস ১০০-এর বেশি হলে। হিমোগ্লোবিন ১০-এর নিচে নামলে ও হিমাটোক্রিট কমে গেলে রক্ত দিতে হবে। প্রতিরোধ : মশা মারতে ঘরে স্প্রে ব্যবহার করুন। তা ছাড়া ফুল হাতা কাপড় এবং পা মোজা ব্যবহার করুন। দিনে মশারি দিয়ে ঘুমান। মশার ডিম থেকে লারভা হয়ে থাকে। তাই এই পাত্র মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে জলকান্দায়, নির্মাণসামগ্রীর পানি, বৃষ্টিতে জমে থাকা রাস্তার এবং পাত্রের পানিতে স্প্রে করুন। পরিশেষে বলতে চাই, এই শীতে ডেঙ্গুর উপদ্রব।
তাই বছরের অন্য সময়ে চেয়ে এ সময়ে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে। আর শীতকাল যেমন মানুষ অতিরিক্ত গরম থেকে মুক্তি পায় তেমনি অনেক ধরনের রোগবালাইও মোকাবিলাও করতে হয়। তবে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার, কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যাবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই শীতকালে বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি