আগুন কখন কোথায় লাগবে সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ভবনেও আগুন লাগতে পারে সেটা কল্পনায় ছিল না। তবে গত ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড বাস্তবে পরিণত করলো। একইসাথে এই সময়ে এসে এটা জাতির কাছে একটি চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবন, যেখানে সংবেদনশীল নথি ও কাগজপত্র সংরক্ষিত থাকে, সেখানে এমন একটি ঘটনা বেশ সন্দেহজনক। এর পেছনে যে কোনো গাফিলতি বা ষড়যন্ত্র থাকতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রশ্ন হলো, অপরাধীরা ধরা পড়বে তো? নাকি এটি সময়ের আবর্তে হারিয়ে যাবে?
সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পারলাম, আগুন লেগেছে একটি নির্দিষ্ট দপ্তরে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও ততক্ষণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা চরমে পৌঁছে যায়। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত নিয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য মেলেনি, তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এটি হয়তো বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে হতে পারে। তবে এটাও লক্ষ্যণীয় যে, সচিবালয়ে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার ঘাটতি বহুদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে। ঘটনার সময় সচিবালয়ে উপস্থিত কর্মচারীদের একটি অংশ জানিয়েছেন যে, আগুন লাগার পরপরই ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। জরুরি সিঁড়িগুলোর ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হয় এবং অনেকেই সঠিক নির্দেশনার অভাবে নিরাপদে বের হতে দেরি করেন। এটি আমাদের দেশের সরকারি ভবনগুলোর জরুরি ব্যবস্থাপনায় যে বড় ধরনের ফাঁকফোকর রয়েছে তা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এখানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ ভেসে আসছে। এ ধরনের ঘটনার পেছনে বড় মাফিয়াদের হাতও থাকে। বিশেষ করে যখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এমন কিছু নথি থাকে, যেগুলো জনস্বার্থে বা উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই আমার মতে, ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি ধ্বংস করা হতে পারে। এ সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায় না, কারণ অতীতে আমরা দেখেছি, এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই দুর্নীতি বা অবৈধ কার্যকলাপ আড়াল করার উদ্দেশ্যে ঘটে।
অন্যদিকে, সচিবালয়ের মতো জায়গায় এ ধরনের ঘটনাগুলো কেবলমাত্র একটি দপ্তর বা কাজের ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে না; এটি পুরো প্রশাসনিক কাঠামোকে নাড়া দিয়ে যায়। যারা জনগণের সেবায় কাজ করার শপথ নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে এমন গাফিলতি গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের আস্থার জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকার এরই মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং দায়ীদের খুঁজে বের করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। তবে পূর্বের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের শিক্ষা দেয় এ ধরনের তদন্ত প্রায়শই দীর্ঘায়িত হয় এবং অপরাধীরা ধরা পড়লেও শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই সরকার নিশ্চয়ই ভিন্ন কিছু দেখাবেন। জনগণ এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি চায়।
সচিবালয়ে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড শুধু ভবন বা নথির ক্ষতি নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য এবং পেশাদারিত্ব অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আমরা দেখেছি, গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো রাজনৈতিক চাপ কিংবা প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়। এছাড়াও, অপরাধীদের শনাক্ত করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মচারীদের সাক্ষ্য নেওয়া ও ঘটনার আগে-পরে কাদের যাতায়াত ছিল তা বিশ্লেষণ করা জরুরি। এ ধরনের তদন্ত প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পরিচালিত না হলে জনগণের মধ্যে প্রশাসনের ওপর আস্থার অভাব তৈরি হয়। জনগণ আশা করে, সরকার এই ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করবে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।
এই ঘটনার বিচার কি হবে, কেমন হবে, আদৌ অপরাধীদের ধরা সম্ভব কি-না সেই বিষয়টা সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এই ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রশাসনিক ভবনগুলোতে অগ্নি-নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা অপ্রতুল। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা জরুরি। প্রতিটি সরকারি ভবনে নিয়মিত অগ্নি-নিরাপত্তা মহড়া, উন্নত ফায়ার এলার্ম ব্যবস্থা এবং কর্মচারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও, জরুরি নির্গমন পথগুলো সব সময় খোলা এবং ব্যবহারোপযোগী রাখা অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সতর্কতা ও কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যেকোনো ভবনে এমন দুর্ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব শুধু ওই ভবনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি সমগ্র প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নিয়ে আসে। অন্যদিকে, ভবনের নকশা থেকে শুরু করে প্রতিদিনের কার্যক্রম পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরোনো ভবনগুলোতে অবকাঠামোগত সংস্কার এবং নতুন ভবন তৈরির সময় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা উচিত। পরিশেষে বলতে চাই, সচিবালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন অগ্নিকাণ্ড জাতীয় নিরাপত্তা ও সুশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা নড়বড়ে করে দেয়। অপরাধীদের দ্রুত খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা না হলে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আবারও ঘটতে পারে। আমাদের প্রশাসনিক ভবনগুলোতে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া এ ধরনের ঝুঁকি রোধ করা সম্ভব নয়। সচেতনতা এবং জবাবদিহিতার অভাবে আমাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ক্ষতির মুখে পড়ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।